খুম, খুম, খুম, আমিয় খুম
আমি অবিশ্বাস্য সুন্দর দেখেছি। তাদের সংরক্ষণ করব আগামী প্রজম্মের জন্য। যেন বুক ভরা নি:শ্বাস নিয়ে গর্ব করে বিশ্ববাসীকে বলতে পারে- দেখ, দেখ-এই আমার বাংলাদেশ। কত সুন্দর তার নয়নাভিরাম প্রকৃতি। তেমন অমিয়খুম জলপ্রপাত দেখা ও আসা, যাওয়া, প্রকৃতির ভালোবাসার গল্প লিখেছেন ‘দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ’র প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম। ছবি : দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ।
খুম, খুম, খুম, আমিয় খুম- একটি আদিবাসী শব্দ। দেশকে যারা ভালবাসেন, দেশের উন্নয়ন নিয়ে যারা চিন্তা করেন, বিদেশ ভ্রমণের চেয়ে মাতৃভূমির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনুসন্ধানে যারা বেশি আগ্রহী, তাদের জন্য আমিয় খুম মহান আল্লাহ্ পাকের সৃষ্ট অনন্য নিদর্শন।
ভ্রমণ বিষয়ক ফিচার লেখক এক পরিচিতজনের মাধ্যমে আমিয় খুমের সৌন্দর্যের বর্ণনা যখন জানতে পারি, সেই থেকেই শুরু যাওয়ার প্রস্তুতি।
বান্দরবান বলতে অনেকেই মনে করেন, দু-চারবার সেখানে গেলেই সব প্রাকৃতিক নিদর্শনই বুঝি ঘুরে শেষ করা সম্ভব। এরকম ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। বান্দরবান এমন একটি জেলা, যার পরতে, পরতে ধারণ করা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে যেতে হবে কম করে হলেও শতবার।
‘দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ’র এবারের অভিযান ছিল বান্দরবানের দুর্গম অঞ্চলের প্রকৃতি ও মানুষ। যত বেশি দুর্গমে যাওয়া যাবে, তত মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকা যাবে। আরো বেশি পাহাড়ী মানুষের যাপিত জীবন সম্পর্কে নতুন ধারণা নেয়া যাবে।
পাঁচ বন্ধু মিলে এবার তিন রাত-দুদিন পার করে গিয়েছি অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যের রাণী আমিয় খুম। যাওয়া এবং ফেরার দিন দুইরাত কাটিয়েছি আদিবাসী ত্রিপুরা অধ্যুষিত যিন্নাপাড়া। রাতে পাড়ার বাসিন্দা চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বদ্বীতাকারী বিলাসের ঘরে আশ্রয় নিয়েছি। সেখানটার নতুন প্রজন্মের ছেলে, মেয়েরা সবাই স্কুল-কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। চলনে-বলনে আধুনিক অথচ পাড়ায় স্যানিটেশন ব্যবস্থা নেই! খোলা আকাশের নিচে ঝোপ-ঝাড়ে প্রকৃতির ডাকের সমাধা করতে হয়। বিষয়টি খুব খারাপ বৈকি। শহর থেকে যাওয়া ভ্রমন পিপাসুদের জন্য বিব্রতকরও।
বিলাসের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে বুঝতে পারলাম, খোলা আকাশের নিচে মলত্যাগ নিয়ে তারা তেমন ভাবুক নয়। সেসঙ্গে ঘরের ভেতর টকটক নামের প্রাণীর বিচরণ তো সারারাতের ঘুমকে করেছে হারাম।
তারপরও খুব সকালে রওনা হলাম মূল গন্তব্যে। বাঁশের লাঠি সম্বল। হেঁটে যাচ্ছি একের পর এক পাহাড় ডিঙ্গিয়ে। বিশ্রাম নিলাম-বছর পাঁচেক যাবৎ গড়ে উঠা অতিরাম পাড়ায়। সেখান থেকে তাজিংডং পাহাড় ষ্পষ্ট দেখা যায়। আমরা দেখলাম। পাড়ায় বসে যখন নুডুলস ও অন্যান্য খাবার খাচ্ছি, তখন বেশ ভালো লাগল। ছোট ছোট বাচ্চারা দূরে দাঁড়িয়ে রইল। কাউকে ডেকে দিলে নিচ্ছে, অন্যথায় নয়। পরে জানতে পেরেছি, তাদের বেশির ভাগই অভুক্ত। অথচ কত ধৈর্য্য সবার।
পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন অতিরাম পাড়া পিছনে ফেলে আবার হাটছি। বিশাল-বিশাল পাহাড়, জঙ্গল, ঝিরি মাড়িয়ে হেঁটেই চলছি। দীর্ঘপথ পরিক্রমায় সঙ্গী উজাড় করে দেওয়া প্রকৃতি তার ভেতরেও বেঁচে থাকা বুনো ফুলগুলোর সুবাস। মাঝেমধ্যে জনমানবহীন পাহাড়ে গড়ে তোলা ঝুম ঘরে বিশ্রাম নিয়েছি। এরমধ্যে দু-চারটে জোঁক দেহকে আলিঙ্গন করেছে। কামাল তো জোঁকের ভয়ে দ্রুত হেঁটেও শেষ রক্ষা পায়নি। অবশেষে তার ব্রেকড্যান্স, ভ্রমণে বাড়তি আনন্দ দিয়েছে।
আমিয় খুম যাওয়ার পথের চারপাশের প্রকৃতি খুব সুন্দর। উদার করে দেয়া প্রকৃতির পরশে পাাহাড়গুলোও খুব সুন্দর সাজে সেজেছে। প্রায় পাঁচ ঘন্টা হাঁটার পর পাহাড়ের উপর হতে আমিয় খুম প্রপাতের পানির নিয়মিত ছন্দের আওয়াজ কানে ভেসে এল। নিস্তব্ধ প্রকৃতিতে অসাধারণ লাগল। এবার খাড়া এক পাহাড় হতে নিচে নামছি। একটুু এদিক, সেদিক হলেই আলুর দম। ফলে খুব সাবধানে নামতে হল। প্রায় ৩০ মিনিট হাঁটার পর পেয়ে গেলাম এই মহা আনন্দের ক্ষণ। ওহ ! আল্লাহ্ তোমার দরবারে অশেষ শুকরিয়া। এত সুন্দর প্রাকৃতিক নিয়ামত তুমি আমাদের করেছ দান।
দুুপাশে দিগন্ত ছোঁয়া খাড়া পাহাড়। পাহাড়গুলোতে বড়, বড় গাছ আছে। নিচে বিশাল, বিশাল হরেক আকৃতির পাথর। তার মাঝে বয়ে চলছে অবিরাম ধারায় আমিয় খুম জলপ্রপাত। প্রপাতের পাথুরে পাহাড় এমনভাবে খাঁজকাটা, মনে হয়, কোন ডিজাইনার বেশ যত্ন নিয়ে সৌন্দর্যের ব্যাপ্তি ঘটিয়েছেন। প্রকৃতির খেয়ালে গড়া তার প্রমাণ পানি পড়ার এই দৃশ্যগুলো বর্ণনাতীত। হৃদয় ছোঁয়া প্রপাতের ছন্দময় শব্দ ভ্রমণের সব ক্লান্তি দূর করে দিল নিমিষে। এত সুন্দর জলপ্রপাত অথচ এদেশের অনেকেই তা জানেন না। ছবি দেখালে বিশ্বাসই করতে চান না না, এটি আমাদের গর্ব বান্দরবানের একটি অংশ। তারা না জানার কারণে কৃত্রিম প্রপাত দেখার জন্য পর্যটক হয়ে বিদেশ পাড়ি জমান। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট বিশেষ আবেদন, তারা যেন আমিয় খুমের যোগাযোগ ব্যবস্থা পর্যটনবান্ধব করতে উদ্যোগী হন।
আমিয় খুমের জলে মন ভরে অবগাহন। অতঃপর মুগ্ধতার আবেশে দুপুরকে বিকেল ভেবে ফেরার পালা।
যোগাযোগ : ঢাকা হতে বান্দরবান। বান্দরবান হতে বাসে চাঁদের গাড়িতে থানচি। থানচি হতে ট্রলারে রেমাক্রি। রেমাক্রি হতে পায়ে হেঁটে যিন্নাপাড়া। এরপর অতিরাম পাড়া। অতিরামপাড়া হতে ঘন্টা পাচেক চড়াই, উৎরাইয়ের পর ওয়াও-আমিয় খুম!
খাওয়া-থাকা : পর্যাপ্ত পরিমাণ শুকনো খাবার ও স্যালাইন এবং প্রয়োজনীয় ঔষধ। জুম চাউলের ভাত আর মোরগ-ভুনা খেতে হলে সঙ্গে যাওয়া গাইডের সাথে আলাপ করুন। রোমাঞ্চকর আমিয় খুম ট্রেইল করতে খরচ হবে জনপ্রতি ছয় থেকে সাত হাজার টাকা। প্রথম ও দ্বিতীয় রাত কাটাবেন যিন্নাপাড়া। মাথা পিছু থাকা-খাওয়া বাবদ নেবেন তারা জনপ্রতি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা।
আমাদের চাওয়া : চলার পথে কোন জীব-জন্তুকে আঘাত করবেন না # গাছ উপড়ে ফেলা বা অকারণে গাছের ডাল কাটবেন না # সঙ্গে নেয়া বিভিন্ন খাবারের মোড়ক, যেখানে সেখানে না ফেলে একটি ব্যাগে করে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলুন # আদিবাসীদের সাথে সুন্দর আচরণ করুন তাদেরকে প্রায় উলঙ্গ বা অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় দেখলে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন # গাইডের পরামর্শ ছাড়া কোন কিছু করার চেষ্টা করবেন না।
উল্লেখ্য : ইদানীং পাড়াগুলো বেশ পর্যটনবান্ধব করা হয়েছে। এখন রেমাক্রী হতে থুইসা পাড়া হয়েও আমিয়খুম যাওয়া যায়।
ওএস।