কুষ্টিয়ায় তালশাঁসের চাহিদা বাড়লেও কমছে তালগাছ
“ঐ দেখা যায় তাল গাছ
ঐ আমাদের গাঁ।
ঐ খানেতে বাস করে
কানা বগীর ছা।”
এ ছড়াটি পড়েননি বা শোনেননি এমন মানুষ এ দেশে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এ ছড়াতে তালগাছের মাধ্যমে কবি খান মুহাম্মদ মইনুদ্দীন তার গ্রামকে চিনিয়েছেন। তালগাছ দেখিয়ে কবির নিজ গ্রামকে চেনানোর মাধ্যমেই বোঝা যায় তালগাছের গুরুত্বের বিষয়টি। তবে সেই তালগাছ বর্তমানে দেশে বিলুপ্তপ্রায়। এখন আর আগের মতো তালগাছ চোখে পড়ে না। কালের বিবর্তনে সারাদেশ থেকেই ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে তালগাছ। তালগাছ বিলুপ্ত হওয়া থেকে বাদ পড়েনি সংস্কৃতির রাজধানী কুষ্টিয়া অঞ্চলও। এখন এ অঞ্চলে তালগাছ নেই বললেই চলে। তবে আশার ব্যাপার হলো সাধারণ মানুষ তালগাছের গুরুত্ব বুঝতে শুরু করেছে। তারা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে পরিবেশেকে বাঁচাতে বর্তমানে অনেকেই তালের বীজ বপন করতে উৎসাহী হচ্ছেন ইতোমধ্যে তারা তালের বীজ বপন করতেও শুরু করেছেন।
শুধুমাত্র গাছই নয় তালের রস ও কাঁচা-পাকা এই দুই অবস্থায় তাল মানুষের শরীরের জন্য খুবই উপকারী। তালের শাঁস ছোট, বড় সবারই পছন্দের একটি ফল। তালের শাঁসকে নারিকেলের মতোই পুষ্টিকর বলে বিবেচনা করা হয়। মিষ্টি স্বাদের সুস্বাদু এই ফল মানুষের শরীরের জন্য বিভিন্ন উপকারী উপাদান সরবরাহ করে। এসব উপাদান মানুষের শরীরকে নানা রোগ থেকে রক্ষা করাসহ রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
মানব দেহের জন্য এতো উপকারী তালশাঁসের উপকারিতা সাধারণ মানুষ না জানলেও সুস্বাদু হওয়ায় এই তালশাঁস খাওয়া থেকে পিছিয়ে নেই মানুষ। বর্তমানে কুষ্টিয়া জেলার হাটে, বাজারে তালের শাঁসের চাহিদা বেড়েছে ব্যাপক হারে। মৌসুমি এ ফল মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষায় ভূমিকা পালনের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ অর্থনীতিতেও অবদান রাখছে বেশ ভালোভাবেই।
কুষ্টিয়ার শহরের ৬ রাস্তার মোড়, প্রেস ক্লাবের সামনে, কাটাইখানা মোড়, সিঙ্গার মোড়, মজমপুর গেট, চৌড়হাস, ট্রাফিক মোড়, বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল চত্বর, বড় বাজার রেলগেট, মিউনিসিপ্যালিটি বাজারের সামনে, একতারা মোড়, হাসপাতাল মোড়, সরকারি কলেজের সামনে, জেলখানা মোড়, ডিসি কোর্ট চত্বর হাউজিং নিশান মোড়সহ শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে তাল বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এবার এলাকা এবং তালের আকার ভেদে তিন আঁটির (তালশাঁস) একেকটি তালের পাইকারি দাম ৬ টাকা থেকে ৭ টাকা পর্যন্ত পড়ে। কুষ্টিয়া শহরে খুচরা পর্যায়ে সেই তিন আঁটির (তালশাঁস) এবার একেকটি তাল বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকা দামে। দাম বেশি হওয়ায় এবার তালশাঁস ক্রেতাও কম। ফলে মাঝে মাঝে তাল নষ্টও হচ্ছে। দাম বেশির কারণ হিসেবে তালের সরবরাহ কমের কথা বলছেন বিক্রেতারা তবে কয়েকদিন গেলে বাজারে পর্যাপ্ত তাল উঠলে দাম কমে যাবে বলেও জানিয়েছেন কয়েকজন বিক্রেতা।
কুষ্টিয়া শহরের জেলখানা মোড়ে তালশাঁস কিনতে আসা মজিদ ফকির জানান, তালশাঁস আমার পরিবারের সবাই খুব পছন্দ করে তাই পরিবারের সবার জন্য আমাকে প্রায় দিনই তালশাঁস কিনতে হয়। অস্বস্তিকর এই গরমে তালশাঁস খেলে একটু স্বস্তি বোধ করি। গত বারের চেয়ে এবার তালের দাম একটু বেশি। গত বছর ৩ আঁটির (তালশাঁস) ১৫ টাকা নিলে এবার সেই তালের দাম ২০ টাকা নিচ্ছেন বিক্রেতারা। সে জন্য এবার তাল একটু কম পরিমান কেনা পড়ছে।
আরেক তালশাঁস ক্রেতা মোছা. মরিয়ম আক্তার বলেন, আমার ছেলে মেয়েরা তালশাঁস খেতে খুব পছন্দ করে। সেই কারণে তাল বাজারে উঠার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই তাল কিনি। এবছর তালের দাম একটু বেশি। তবে দাম বেশি হলেও সন্তানদের পছন্দের কথা চিন্তা করে তবুও কিনি।
কুষ্টিয়া শহরের মিউনিসিপ্যালিটি বাজারের সামনের তালশাঁস বিক্রেতা মো. তিজাম উদ্দিনের সাথে কথা হলে তিনি জানান, প্রতি বছর তালশাঁসের মৌসুমে তিনি বিভিন্ন এলাকা থেকে তাল সংগ্রহ করে কুষ্টিয়া মিউনিসিপ্যালিটি বাজার, সিঙ্গার মোড়সহ শহরের বিভিন্ন জায়গায় বসে তাল বিক্রি করেন। তালশাঁসের মৌসুম শেষ হলে তিনি অন্য সময় ডাব বিক্রি করেন এর পাশাপাশি ভ্যানও চালান।
তিনি আরও জানান, বর্তমানে কুষ্টিয়ায় তালগাছ কমে গেছে এখন চাহিদা অনুযায়ী তাল পাওয়া যায় না। তবুও যা তাল গাছ আছে সেই সব গাছ থেকেই তাল সংগ্রহ করতে হচ্ছে। গাছ থেকে গড় চুক্তিতে তাল কিনে নিয়ে বিক্রি করেন। গাছের তালের পরিমান অনুযায়ী একেক গাছ একেক দামে কিনতে হয়।
আবার ক্রেতাদের একেক জনের একেক রকম তালের শাঁস পছন্দ, কেউ একটু নরম তালশাঁস পছন্দ করেন, আবার কেউ একটু শক্ত তালশাঁস পছন্দ করেন। প্রতিদিন গড়ে তার ৩৫০ থেকে ৪০০ পিস তাল বিক্রি হয়। প্রতি বছর তালের মৌসুম এলেই তালশাঁস বিক্রি করে বাড়তি আয় করেন তিনি। এতে তার সংসার খরচ করেও বেশ কিছু টাকা সঞ্চয় করতে পারেন।
কুষ্টিয়া শহরের বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল চত্বর এলাকার তাল বিক্রেতা কুমারখালী উপজেলার সদকী ইউনিয়নের বানিয়াকান্দী এলকার মো. মোতালেব শেখ নামে আরেক তালশাঁস বিক্রেতা জানান, এবার গাছে তালের পরিমান কম তালগাছও কম এলাকায় তাল পাওয়া যায় না সে কারণে পাশের উপজেলা খোকসার আমবাড়িয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম থেকে তাল সংগ্রহ করে প্রতিদিন কুষ্টিয়া শহরে এসে তাল বিক্রি করেন। সে কারনে তালের দাম একটু বেশি পড়ে যাচ্ছে। এর জন্য বেশি দামে তাল বিক্রি করতে হচ্ছে৷ দাম বেশির কারনে তাল তেমন বিক্রিও হচ্ছে না। মাঝে মাঝে তাল নষ্টও হয়ে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা রফিকুল ইসলামের সাথে কথা হলে তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান, খাবার হিসেবে তাল অতুলনীয়। কাঁচা তাল শাঁস ও পাকা তালে অন্য ফলের তুলনায় ক্যালসিয়াম, লৌহ, ক্যালোরির পরিমান বেশি থাকে। তালের শাঁস সহজে হজম যোগ্য, আমাশয়, বহুমূত্র, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। তালগাছের বীজ বা চারা করে রোপন করা যায়, এ গাছ লাগানোর পর ফল পেতে ১০-১২ বছর সময় লাগে। সব ধরনের মাটিতে তালগাছ জন্মে। বজ্রপাতের হার কমাতে তালগাছের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বজ্রপাতের পরিমাণ বেড়ে গেছে যা আমাদের জন্য অশনিসংকেত। মূলত বজ্রপাতে বৈদ্যুতিক চার্জ হয়, বড় গাছ হিসেবে তালগাছের ওপর বজ্রপাত হলে সেই বজ্রপাতের বৈদ্যুতিক চার্জ তার কাণ্ড দিয়ে মাটিতে চলে যায়, অনেকটা আর্তিংয়ের মতো। দেশে তালগাছের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে সরকারের উদ্যোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দেশে প্রচুরসংখ্যক তাল গাছ রোপণ করেছে।
তিনি আরও জানান, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলয় তালগাছের রোপণের কোনো বিকল্প নাই। বাড়ির আশেপাশে ও পতিত জায়গায় তালগাছ রোপণ করে একদিকে খাদ্য পুষ্টিমান বৃদ্ধি করা যাবে। অন্যদিকে বজ্রপাতের মত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবেলায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে তালগাছ হবে বড় মাধ্যম।
এমএসপি