অবহেলায় হারাতে বসেছে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের স্মৃতিচিহ্ন
কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের জন্মস্থানের স্মৃতিচিহ্নগুলো দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে অযত্ন-অবহেলায়। খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটীতে কবির পুকুরসহ এক একরেরও বেশি জমি চলে গেছে অবৈধ দখলে।
ভৈরব নদের তীরে খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটীতে নীতিকবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার জন্মগ্রহণ করেন ১৮৩৪ সালের ১০ জুন। কবিতা লেখার পাশাপাশি শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতা করেছেন কৃষ্ণচন্দ্র। তৎকালীন ঢাকাপ্রকাশ পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন তিনি। শিক্ষকতা করেছেন ১৯ বছর। কৃষ্ণচন্দ্র ১৮৫৪ সালে বরিশালের কীর্তিপাশা বাংলা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে তিনি ঢাকার নর্মাল স্কুলে যোগদান করেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় চাকরি ছেড়ে তিনি ১৮৬০ সালে মডেল স্কুলে যোগ দেন। এভাবে তিনি বিভিন্ন স্কুলে দীর্ঘ ১৯ বছর শিক্ষকতা করেন। পেশাগত দায়িত্ব পালনে তিনি ছিলেন খুবই নিষ্ঠাবান।
আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে তার পক্ষে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। মূলত কীর্তিপাশার জমিদারের অর্থানুকূল্যে তিনি জীবনযাপন করেন। তার প্রথম ও শ্রেষ্ঠ গ্রন্হ ‘সদ্ভাব শতক’ (ঢাকা, ১৮৬১)। বইটির অধিকাংশ কবিতা নীতিমূলক, যা সুফি ও হাফিজের ফার্সি কবিতার অনুসরণে রচিত। তার ছদ্মনাম ছিল রামচন্দ্র দাস, সংক্ষেপে রাম।
তাই পরিণত বয়সে ১৮৬৮ সালে তিনি রামের ইতিবৃত্ত নামে একটি আত্মচরিত রচনা করেন। মহাভারতের ‘বাসব-নহুষ-সংবাদ’ অবলম্বনে ১৮৭১ সালে রচিত তার আরেকটি গ্রন্হ হলো মোহভোগ। কৈবল্যতত্ত্ব নামে ১৮৮৩ সালে তিনি একটি দর্শনবিষয়ক গ্রন্হ লেখেন। ১৯০৭ সালের ১৩ জানুয়ারি পরপারে পাড়ি জমান বাংলা সাহিত্যের এ অমর কবি। নাটক রাবণবধ তার মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়। তার অপ্রকাশিত গ্রন্হের সংখ্যা ১৫।
সরেজমিন দেখা গেছে, কবির জন্মস্থান সেনহাটী গ্রামের শিববাড়ি এলাকায় এখন শুধু একটি স্মৃতিস্তম্ভ, নামফলক, কংক্রিটের বেঞ্চ ও একটি ছোট্ট কামিনী গাছ ছাড়া আর কিছুই নেই। সেখানে আবার অবৈধভাবে ইট-বালু রেখে ব্যবসা করছেন দুই-তিনজন প্রভাবশালী। কৃষ্ণচন্দ্রের পুকুরসহ এক একরেরও বেশি জমি অবৈধ দখলে চলে গেছে। কবির বাড়িতে যে মন্দিরটি ছিল, সেটির অবস্থাও জরাজীর্ণ। কবির মৃত্যুর সাত বছর পর তার বাড়ির সামান্য দূরে ১৯১৪ সালে ৩৩ শতক জমির একাংশে গড়ে তোলা হয় 'কবি কৃষ্ণচন্দ্র ইনস্টিটিউট'। বাকি জায়গা খালি পড়ে আছে, সেটি এখন গরু-ছাগলের চারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে।
ইনস্টিটিউটের অবস্থাও জরাজীর্ণ, ছাদের ওপর জন্মেছে বট-পাকুড়ের গাছ। ইনস্টিটিউটের ভেতর ১০ থেকে ১২টি বই, একটি টেবিল, কয়েকটি চেয়ার ও দেওয়ালে কয়েকটি ছবি ছাড়া তেমন কিছুই নেই। কবির লেখা গ্রন্হগুলোও এখানে নেই।
কৃষ্ণচন্দ্র ইনস্টিটিউটের সাধারণ সম্পাদক শেখ মনিরুল ইসলাম বলেন, কবির বসতভিটা ও পুকুর অনেক আগেই অবৈধ দখলে চলে গেছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এর আগে কয়েকবার অবৈধ দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা সফল হয়নি। কবি জীবদ্দশায় যে পুকুরে গোসল করতেন, সেটি এখন খাদির মার পুকুর নামে পরিচিত। এটা কখনও আমরা প্রত্যাশা করিনি।
তিনি আরও বলেন, কবি কৃষ্ণচন্দ্র ইনস্টিটিউটে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় দুই বছর আগে কিছু টাকা দেয়, যা দিয়ে মেঝে টাইলস করা হয়। এর বাইরে আর কোনো সংস্কার বা উন্নয়ন হয়নি।
ইনস্টিটিউটের সভাপতি মো. আকতার হোসেন বাবলু হতাশার সুরে বলেন, সেনহাটীতে কবির স্মৃতিচিহ্ন বলতে এখন শুধু স্মৃতিস্তম্ভ ও একটি ইনস্টিটিউট আছে। তার বংশধররাও কেউ এখন আর এখানে থাকেন না। প্রশাসনের উচিত এখনও কবির যে স্মৃতিচিহ্নগুলো অবশিষ্ট আছে তা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া।
কবি কৃষ্ণচন্দ্রকে নিয়ে গবেষণা করছেন সেনহাটী এলাকার আলহাজ সারোয়ার খান ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ মো. আলতাফ হোসেন। তিনি বলেন, আগে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যপুস্তকে কৃষ্ণচন্দ্রের বেশ কয়েকটি বিখ্যাত কবিতা ছিল। তার লেখা কবিতা দিয়ে ভাব সম্প্রসারণ পড়ানো হতো। কিন্তু এখন আর তা নেই।
গবেষক আলতাফ হোসেন আরও বলেন, যে বছর মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদ বধ কাব্য প্রকাশিত হয়, সেই ১৮৬১ সালেই কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের কাব্য সদ্ভাব শতক প্রকাশিত হয়।
ইনস্টিটিউটের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোল্লা মাকসুদুল ইসলাম বলেন, কবি কৃষ্ণচন্দ্র আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছেন। তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে পাঠ্যপুস্তকে তার জীবনী ও তার লেখা বিখ্যাত কবিতাগুলো স্থান দেওয়া প্রয়োজন।
কবির জন্মস্থানকে ঘিরে একটি মিউজিয়াম ও বহুমুখী কমপ্লেক্স গড়ে তোলার দাবি জানান ইনস্টিটিউটের সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ আবদুল হাই। তিনি বলেন, যশোরের কেশবপুরে কবি মাইকেল মধুসূদন, খুলনার ফুলতলা উপজেলার দক্ষিণডিহিতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরবাড়ি এবং রূপসার পিঠাভোগ গ্রামে কবিগুরুর পিতৃপুরুষের ভিটায় রবীন্দ্র কমপ্লেক্স গড়ে তোলা হয়েছে। সে রকমভাবে এখানেও কবি কৃষ্ণচন্দ্র কমপ্লেক্স গড়ে তোলা প্রয়োজন।
এ ব্যাপারে প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা জানান, কবির জন্মস্থানটিকে গত ১০ মে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণা করা হয়েছে। শিগগিরই সেখানে নোটিশ বোর্ড ও পরিচিতি ফলক স্থাপন করা হবে, যাতে কবির সম্পর্কে নতুন প্রজন্ম, এলাকাবাসী ও দর্শনার্থীরা জানতে পারেন। এ ছাড়া জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় কবির স্মৃতিগুলো সংস্কার ও সংরক্ষণ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
এসএন