রংপুর অঞ্চলের মঙ্গা জয়ের চেষ্টা চা চাষ দিয়ে
রংপুর বিভাগের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাও, নীলফামারীর পাশাপাশি রংপুর ও লালমনিরহাটেও চা চাষ শুরু হয়েছে। এসব এলাকায় ৬ হাজার একর জমিতে চা চাষ হচ্ছে।
রংপুর জেলার তারাগঞ্জ ও নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলাসহ রংপুর বিভাগের কিভিন্ন এলাকায় পরিত্যক্ত ও উঁচু জমিতে চা চাষ করে লাভবান হচ্ছেন চাষিরা। এতে ওই এলাকার চাষিদের মাঝে অর্থনৈতিক উন্নতিতে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে।
রংপুরে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষের উদ্যোগ নেয় সিনহা অ্যাগ্রো বেইজড ইন্ডাস্ট্রিজ। ২০১৫ সালের জুন মাসে রংপুরের তারাগঞ্জ ও নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলায় পরীক্ষমূলক চা চারা গাছ লাগানো হয়। চারাগাছগুলো থেকে চা পাতা সংগ্রহের উপযোগী হওয়া পর্যন্ত সময় লাগে এক বছর। এক বছরে দেড় একর জমিতে ব্যয় হয় প্রায় দেড় লাখ টাকা। এক বছর পর এ বাগান থেকে সংগ্রহ করা হয় প্রায় ৩২২ কেজি চা পাতা। যার মূল্য আসে প্রায় ১০ লাখ ৩ হাজার ১৬৮ টাকা।
এরপর পর্যায়ক্রমে জমির পরিমাণ বাড়ানো হয়। বর্তমানে তারাগঞ্জ উপজেলায় একটি ও নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলায় বাহাগিলি ও দুরাকুঠিতে দুটি বাগান রয়েছে। এরমধ্যে উপজেলায় বাহাগিলিতে রয়েছে ৭ একর এবং দুরাকুঠিতে টি-প্ল্যান্টেশন রয়েছে ১৯ একর ও চা বাগান রয়েছে ২ একর জমিতে। এ তিনটি চা বাগান থেকে প্রতি বছর ৯ থেকে ১০ বার রাউন্ড দিয়ে চা পাতা সংগ্রহ করা হয়। আর প্রতি কেজি চা বিক্রি করা হয় ৩২ থেকে ৩৫ টাকা মূল্য পর্যন্ত। আর এ চা পাতা বিক্রি পঞ্চগড় জেলায় অবস্থিত নর্থ বেঙ্গল সেন্ট্রাল টি ইন্ডাস্ট্রিজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে।
বাংলাদেশ স্মল টি গার্ডেন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আমিরুল হক খোকন বলেন, রংপুর বিভাগের রংপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী ও লালমনিরহাটে চা চাষ সম্প্রসারণ হচ্ছে। এসব এলাকার আবাদি জমির পরিমাণ ৬ হাজার একর।
তিনি বলেন, ক্ষুদ্র চা বাগান আটটি আর মাঝারি ১২টি। এতে ৩ হাজার চাষি চা চাষের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। কারখানা রয়েছে ১৩টি। প্রতি বছর প্রস্তুত করা চায়ের পরিমাণ ৮০ লাখ কেজি। কাঁচা চা পাতার মূল্য নির্ধারণ হয় চলতি বাজারের ওপর। ফলে চা বাগান মালিকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তিনি সরকারকে সরাসরি চা বাগান মালিকদের কাছ থেকে কেনার আহ্বান জানান।
কথা হয় সিনহা অ্যাগ্রো বেইজড ইন্ডাস্ট্রিজের টি গার্ডেনের ম্যানেজার রিফাত হোসেনের সঙ্গে। তিনি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী ইউয়িনের বালাপাড়া গ্রামের বরাতির সেতুর পাশে প্রায় দেড় একর জমি চা বাগান এবং নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার বাহাগিলির ৭ একর জমিতে চাষ করা চা বাগান ঘুরে দেখান।
এ সময় তিনি বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠনটি ২০১৫ সালের জুন মাসে প্রথম পরীক্ষামূলক চা উৎপাদন শুরু করে। এ উপজেলায় চা বোর্ডের কোনো অফিস নেই। ফলে আমি নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত চা বোর্ডের অফিসে যোগাযোগ করি। তারা আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন।
এ ব্যাপারে কিশোরগঞ্জ চা বোর্ডের কর্মকর্তা জায়েদ ইসলাম সিদ্দিকীর সঙ্গে মুঠো ফোনে যোগাযোগ করা হলেন তিনি বলেন, চা চাষ একটি অত্যন্ত সহজ ও লাভজনক কৃষি। যেসব জমিতে অন্য কোনো ফসল হয় না, সেসব জমিতে সহজেই চা চাষ করে লাভবান হওয়া যায়। তারাগঞ্জের বালাপাড়া, কিশোরগঞ্জের বাহাগিলি ও দরাকুঠির এলাকায় সিনহা অ্যাগ্রো বেইজড ইন্ডাস্ট্রিজের চায়ের চাষ দেখে এ অঞ্চলের যুবকরা এখন চা চাষের দিকে ঝুঁকছেন। আমরা তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি।
লালমনিরহাটে বাংলাদেশ ব্যাংক ও স্থানীয় চা বাগান মালিকের যৌথ উদ্যোগে গড়ে উঠেছে সোমা অ্যান্ড সোমা টি প্রসেসিং লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান। পরীক্ষামূলক চায়ের চাষ হয় হাতীবান্ধা উপজেলার পূর্ব বিছনদই এলাকায়। শাহানারা বেগম সোমা শখ করেই চা গাছের চারা নিয়ে বাড়ির আঙ্গিনায় রোপন করেন। আস্তে আস্তে তিনি বাড়ির উঠানে গড়ে তোলেন চায়ের বাগান। এনজিও’র চাকরি ছেড়ে দিয়ে এ কাজেই মনোযোগ দেন সোমা বেগম ও তার স্বামী ফেরদৌস আলম।
শাহানারা বেগম সোমা জানান, প্রথম দিকে অনেকটা শখ করেই চা বাগান শুরু করেন। সেই শখই একদিন চা শিল্প গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখায়। সেই স্বপ্নকে লালন করেই সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে চলেছেন তিনি। তারা মনে করেন চা শিল্পের পুরোপুরি বিকাশ ঘটলে দেশের অর্থনীতিতে যথেষ্ট প্রভাব ফেলবে লালমনিরহাটের চা। একই সঙ্গে জেলাবাসীর আর্থসামাজিক অবস্থারও ইতবাচক পরিবর্তন ঘটবে।
এ দম্পতির প্রচেষ্টায় গড়ে উঠা চা বাগান দেখে এ অঞ্চলের অনেকেই চা বাগান করায় আগ্রহী হয়ে উঠেন। এসব আগ্রহী চাষিদের সুবিধার জন্য এ দম্পতি গড়ে তোলেন দুটি চা গাছ নার্সারি। সেখান থেকে সুলভ মূল্যে চারা সংগ্রহ করে এখন অনেক কৃষকই গড়ে তুলেছেন চা বাগান। নতুন আরও অনেকেই এগিয়ে আসছেন চা বাগান করার পরিকল্পনা নিয়ে।
হাতীবান্ধা উপজেলার পারুলিয়া এলাকার চা বাগান মালিক বদিউজ্জামান ভেলু বলেন, চা বাগানে একবার চারা রোপন করে পরিচর্যা করলেই কম খরচে অনেক মুনাফা পাওয়া যায়। আমি এখন তামাক চাষ ছেড়ে দিয়ে ২ একর জমিতে চা বাগান করেছি।
পাটগ্রাম উপজেলার বাউরা জমগ্রামের চাষি তাজুল ইসলাম, ছিট মহল দহগ্রামের চাষি বেলাল হোসেনসহ অনেক চাষি জানান, স্বল্প পরিশ্রমে ও কম খরচে অধিক মুনাফা পেতে চা চাষের বিকল্প নেই। বর্তমানে নিজ জেলায় টি প্রেসেসিং কোম্পানি হওয়ায় বিক্রি করতেও ঝামেলা নেই। তাই দিন দিন এ জেলায় চা চাষির সংখ্যা বাড়ছে বলেও মনে করেন তারা। চা শিল্পের প্রসারে লালমনিরহাটে একটি চা বোর্ড গঠনের দাবি জানান চা চাষিরা।
পাঁচ উপজেলায় ২০০ একর জমিতে গড়ে উঠেছে চা বাগান। নতুন করে আরও ৫০০ একর জমিতে চা বাগান করার প্রক্রিয়াও চলছে বলে জানান সোমা টি প্রসেসিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফেরদৌস আলম। এসব বাগানের পাতা সংগ্রহ ও পরিচর্যা করে গ্রামীণ অনেক নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
ফেরদৌস আলম আরও জানান, এ অঞ্চলে প্রতি একর জমিতে চা উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৭ মেট্রিকটন। সে অনুযায়ী বর্তমানে ২০০ একর জমিতে মোট এক হাজার ৪০০ মেট্রিকটন চা উৎপান হচ্ছে লালমনিরহাটের ৫ উপজেলায়। আর ২০০ একর জমির চা চাষি রয়েছেন ৭৫ জন। প্রথম দিকে এ অঞ্চলের চাষিদের উৎপাদিত চা পাতা বিক্রি হতো পঞ্চগড় জেলায়। দূরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতে চাষিদের পরিবহন খরচ মেটানোর পর তেমন একটা মুনাফা হতো না। তাই তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করে যৌথ উদ্যোগে নিজ গ্রামে গড়ে তুলেন সোমা অ্যান্ড সোমা টি প্রসেসিং লিমিটেড নামে চা পাতা শোধনাগার। যার কার্যক্রম শুরু হয় গত বছরের নভেম্বরে। বর্তমানে এ অঞ্চলের চাষিরা প্রতি কেজি ১৮ টাকা দরে সোমা টি প্রসেসিং এ কাঁচা চা পাতা সরবরাহ করছেন।
রংপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মোস্তফা সোহরাব চৌধুরি টিটু বলেন, রংপুর অ্যাগ্রোবেজ এলাকায় যে চায়ের চাষ শুরু হয়েছে তার গুণগত মান অত্যন্ত ভালো। ভারতের দারজিলিংয়ের চায়ের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। চা শিল্পের সঙ্গে বর্তমান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় চা চাষের জন্য সম্প্রসারণ করা যায় তাহলে মঙ্গা কবলিত বৃহত্তর রংপুরের বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের দ্বার উন্মোচন হবে। তিনি সরকারের চা বোর্ডকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
বেকারদের প্রশিক্ষণ ও বিনা সুদে ঋণ প্রদানের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
রংপুর অঞ্চল বিভাগ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ আলী জানান, রংপুর বিভাগের আট জেলার মধ্যে ৭ জেলায় চা চাষ হচ্ছে। চায়ের ফলনও বাম্পার হয়েছে। এ অঞ্চলের যে জমিতে ভালো ফসল ফলে না ওই জমিতে চা চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। পঞ্চগড় ও লালমনিহাট জেলায় ব্যাপকভাবে চা চাষ হচ্ছে। পরিত্যক্ত জমিতে চা চাষ করে ভালো ফলন পাচ্ছেন চা চাষিরা।
এসএন