নীলচাষিদের ওপর ব্রিটিশদের নির্যাতনের সাক্ষী নীলকুঠি
নীলচাষিদের উপর ব্রিটিশ নির্যাতনের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নীলফামারী সদর উপজেলার নটখানা গ্রামের নীলকুঠি। নীল চাষের জন্য কৃষকদের ওপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নির্মম নির্যাতনের চিহ্ন বহন করছে এই জরাজীর্ণ ভবনটি। সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে দুইশ বছরের পুরনো নীলকুঠি ভবন। হাজারও কৃষকের আর্তনাদ সঙ্গে নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে অবকাঠামোটি।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ইংরেজরা ২২২ বছর আগে তৎকালীন বাংলার উত্তরের জেলা নীলফামারীতে নীল চাষের জন্য ‘নীলকুঠি’ নামে একটি খামার স্থাপন করেছিল। এ অঞ্চলের মাটি উর্বর হওয়ায় সেসময় এখানে বেশি নীল চাষ হতো। এ কারণে নীলকরদের আস্তানা গড়ে ওঠে নীলফামারী সদর উপজেলার নটখানা গ্রামে। নীলকুঠি ছাড়াও নীলফামারীতে পুরাকীর্তি হিসেবে রয়েছে ভিমের মায়ের চুলা, ১০০ বছরের পুরোনো হাতির পানি খাওয়া কড়াই, নীলসাগর, কুন্দুপুকুর মাজার, হাজার বছরের পুরোনো গির্জা, রাজা হরিশচন্দ্রের প্রাসাদ, হরেন্দ্র গোস্বামী কাছারি বাড়ি ও ধর্মপালের গড়। তবে এসব দর্শনীয় স্থানও সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই কর্তৃপক্ষের।
জানা যায়, ১৮০০ সালে নটখানা গ্রামে নীল চাষের একটি বৃহৎ খামার স্থাপন করে ইংরেজরা। নীল চাষে ক্ষতিগ্রস্ত হলে নীল চাষে অনীহা প্রকাশ করেন কৃষকরা। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ইংরেজদের জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হন তারা। ১৮৫৯-৬০ সালের দিকে স্থানীয় কৃষকদের আন্দোলনের ফলে নীল চাষ বন্ধ হয়ে যায়। তখন কৃষক আন্দোলনের মুখে পালিয়ে যায় নীলকররা। সেই নীলখামার থেকে নীলফামারী নামের উৎপত্তি হয়। সেখানে এখনও দাঁড়িয়ে আছে ইংরেজদের নির্মাণ করা সেই পুরোনো ভবন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নীলকুঠি ভবনের পূর্ব দিকের অংশের প্রায় তিন শতাধিক ইট খুলে নিয়ে গেছে। স্থানীয়রা বলছেন, নীলকুঠির সঙ্গে নীলফামারীর ঐতিহ্য, ইতিহাস ও নামকরণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণের কাজটি হাতে নিয়েছে।তবে এখনো সংরক্ষণের কাজ শুরু করেনি।
পলাশবাড়ী ইউনিয়নের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. ইব্রাহিম তালুকদার বলেন, ‘সেসময় নীল চাষে বাধ্য করা হতো এই অঞ্চলের কৃষকদের। নীলকররা ওই স্থাপনাটি নির্মাণ করে কৃষকদের ধরে নিয়ে এসে সেখানে নির্যাতন চালাত। ভেতরে টর্চার সেল ছিল। আর মহকুমা অফিস ছিল জেলা শহরের কালেক্টরেট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ চত্বরে। এখন এটি অফিসার্স ক্লাব হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ছাড়া উৎপাদিত পণ্য জেলা শহরের শাখা ও মাচা নামের দুটি বন্দর দিয়ে নদীপথে আনা-নেওয়ার কাজ করত। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভবনটি সংরক্ষণের দাবি জানাই।
জনশ্রুতি রয়েছে, নীলখামার থেকে নীলখামারী, সেখান থেকে নীলফামারী জলোর নামকরণ হয়েছে।
পলাশবাড়ী ইউনিয়নের নটখানা গ্রামের বাসিন্দা মো. আফসার উদ্দিন ও আকমল হোসেন জানান, ভবনটি স্মৃতি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অযত্ন আর অবহেলায় একসময় এটি হারিয়ে যাবে। শুনেছি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণের কাজটি হাতে নিয়েছে। ১০ বছর পার হয়েছে। কিন্তু আজও বাস্তবায়ন করেনি।
নীলফামারী প্রেসক্লাবের সভাপতি তাহমিনুল হক ববি বলেন, এখনও সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়া দুই ঈদে, পূজা ও উৎসবে নীলকুঠি দেখতে আসেন দেশের বিভিন্ন স্থানের মানুষ। কারণ এটি ইতিহাসের সাক্ষী।
নীলফামারী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির সভাপতি প্রকৌশলী এসএম শফিকুল আলম ডাবলু বলেছেন, ব্রিটিশ আমলে নীল চাষের ওই নিদর্শনটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সংরক্ষণ করবে বলে শুনেছি। তবে দীর্ঘদিন হলেও কাজের কোনো অগ্রগতি নেই। যেভাবে ১০ বছর আগেও দেখিছি, এখনও তাই দেখছি। ইংরেজদের শাসন ও শোষণের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে এটি সংরক্ষণের দাবি আমাদের।
নীলফামারীর জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন বলেছেন, এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। আশা করি, অচিরে ওই পুরাকীর্তিটি সংরক্ষণের কাজ শুরু করা হবে।
এসএন