বিএসসির গাফিলতি তদন্তের দাবি
দেড়শ কোটির ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ সচল করতে লাগবে ৫০ কোটি টাকা !
‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ দীর্ঘ সময়ের জন্য অচল হওয়ায় বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) ছোট বহর আরো ছোট হয়ে পড়ল। আট জাহাজের ছোট বহর এখন সাতটিতে দাঁড়িয়েছে। ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে নোঙর করা অবস্থায় ২ মার্চ রাতে জাহাজটিতে রকেট হামলায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মেরামত করে আবার চলাচল উপযোগী কখন করা হবে তা নিয়ে বিএসসির কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। এতে জাহাজ পরিচালনার মাধ্যমে বিএসসির আয়ের পথও সংকুচিত হলো বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। শিপিং সেক্টরের অনেকেই বলছেন, বিএসসির একটি ভুল সিদ্ধান্তের কারণে এমভি বাংলার সমৃদ্ধি দীর্ঘ সময়ের জন্য অচল হয়ে পড়ল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইউক্রেন যাত্রা বাতিল করলে হয়তো এমভি বাংলার সমৃদ্ধি বড় ধরণের ক্ষতি থেকে বেচে যেত।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনামুল হক শুক্রবার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, বিএসসির গাফিলতির কারণেই জাহাজটি এত বড় ক্ষতির মুখে পড়েছে। ১৫০ কোটি টাকা মূল্যের জাহাজটি শুধু নিরাপদ জায়গায় টেনে নিতে টাগবোট খাতে প্রতিদিন ব্যয় হবে অন্তত ২০ হাজার ডলার। যে টাগবোট নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাবে সেটি প্রতিদিন ভাড়া দাবি করবে কমপক্ষে ২০ হাজার ডলার করে। গন্তব্যে এমভি বাংলার সমৃদ্ধিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার পর টাগবোটটি নিজের বন্দরে ফেরত আসা পর্যন্ত ভাড়া দাবি করবে। মেরামত বাবদ খরচ তো আছেই। সব মিলে ১৫০ কোটি টাকার জাহাজটির পেছনে ব্যয় হবে অন্তত ৫০ কোটি টাকা।
জাহাজটি রক্ষায় বিএসসির কোন গাফিলতি ছিল কি-না এ প্রশ্নে তিনি বলেন, গেল ১৫ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন–রাশিয়ার সমুদ্র এলাকাকে যুদ্ধ এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। আর জাহাজটি অলভিয়া বন্দরে গেছে ২২ ফেব্রুয়ারি। যুদ্ধ এলাকা ঘোষণার পর পরই জাহাজটিকে অলভিয়া বন্দরে যেতে নিষেধ করতে পারত বিএসসি। সেটা না করায় জাহাজটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একজন নাবিকের জীবনও গেছে। পাশাপাশি বিপুল নাবিকের জীবন পড়েছে ঝুঁকিতে।
এ ব্যাপারে শুক্রবার বিকালে বিএসসির কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চাইলে কেউ ফোন রিসিভ করেননি।
বিএসসি সূত্র জানায়, এক সময় ৪৪ জাহাজের বড় একটি বহর ছিল। তখন দেশে এবং বিদেশের বিভিন্ন সমুদ্র পথে জাহাজ পরিচালনা করে বেশ আয়ও করত বিএসসি। বেশিরভাগ জাহাজ চার্টার পার্টি এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে ভাড়ায় পরিচালনা করা হতো। কিন্তু জাহাজগুলোর বেশিরভাগের বয়স ২৫ বছর পার হওয়ায় এক সময় ভাড়ায় পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়ে। ২০০০ সালের পর থেকে বেশিরভাগ জাহাজ কারিগরি ত্রুটির কারণে অচল পড়ে থাকত চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে। ওই সময় ১২ জাহাজের ছোট বহরে আয়ের অন্যতম ভরসা ছিল দুই লাইটার ট্যাঙ্কার এমটি বাংলার জ্যোতি এবং এমটি বাংলার সৌরভ। দুটি অয়েল ট্যাঙ্কার চট্টগ্রাম বন্দর বহির্নোঙরে নোঙর করা বৃহদাকার অয়েল ট্যাঙ্কার থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল (ক্রুড) পরিবহন করত দেশের একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ণ রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) এর স্টোরেজ ডিপোতে। ওই সময় বিএসসি দুটি অয়েল ট্যাঙ্কার পরিচালনা করে প্রতি বছর মোটা অংকের অর্থ আয় করত। ২০০৭ সালের মাঝামাঝি চট্টগ্রাম বন্দর বহির্নোঙরে নোঙর করে থাকা অবস্থায় প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হয় এমটি বাংলার সৌরভে। এই বিস্ফোরণের ঘটনায় একজন ডেক ক্যাডেট ঘটনাস্থলেই নিহত হন। তার লাশ এখনো মেলেনি। এরপর এমটি বাংলার জ্যোতিই ছিল একমাত্র অয়েল লাইটার ট্যাঙ্কার। পরে মেরামত করে এমটি বাংলার সৌরভ আবার সচল করা হয়। এরই মধ্যে দুই অয়েল ট্যাঙ্কারের বাইরে বাকি জাহাজগুলোর অবস্থা একেবারে নাজুক হয়ে পড়ে। গত ১০ বছরে দুই অয়েল ট্যাঙ্কার ছাড়া একে একে প্রায় সব জাহাজ বিক্রি করে দেওয়া হয়। এরপর বিএসসি নতুন জাহাজ বহরে যুক্ত করার উদ্যোগ নেয়। নতুন জাহাজ কেনার পরিকল্পনার অংশ হিসাবে বিএসসির বহরে যুক্ত হয় এমভি বাংলার সমৃদ্ধি। বর্তমান বহরে থাকা আট জাহাজের ছয়টিই নতুন। এর মধ্যে এমভি বাংলার সমৃদ্ধি অচল হওয়ায় বহরে নতুন জাহাজের সংখ্যা দাঁড়ালো পাঁচটিতে।
এদিকে বিএসসি জাহাজ পরিচালনায় কোন গাফিলতি করেছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএমওএ)। ওই কমিটিতে বিএমএমওএ’র দুইজন প্রতিনিধিকে রাখার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। শুক্রবার সকালে চট্টগ্রাম নগরের বারিক বিল্ডিং এলাকায় বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএমওএ) কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়।
এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বিএমএমওএ’র সাধারণ সম্পাদক মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মো. শাখাওয়াত হোসেন। এমভি বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের সার্বিক পরিস্থিতি এবং নাবিকদের ফেরত আনার দাবিতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে নিহত থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হাদিসুর রহমানকে রাষ্ট্রীয় বীর ঘোষণা এবং জীবিত ২৮ নাবিককে সাহসিকতা ও বীরত্বের জন্য রাষ্ট্রীয় সম্মাননা এবং পুরস্কার দেওয়ার দাবি জানানো হয়। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিএমএমওএ’র ভাইস প্রেসিডেন্ট মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মো. মাহবুবুর রহমান, সহ সাধারণ সম্পাদক মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মো. গোলাম জিলানি ও মো. ইফতেখার আলম।
এতে বলা হয়, ১৫ ফেব্রুয়ারি জয়েন্ট ওয়ার কমিটি জায়গাটি যুদ্ধকবলিত অঞ্চল ঘোষণা করে। জাহাজটি নোঙর করে ২২ ফেব্রুয়ারি। যা গাফিলতি নিয়ে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। চার্টার পার্টি বিধিমালা অনুযায়ী কোনও জাহাজ কোম্পানি তার জাহাজের নিরাপত্তার জন্য যুদ্ধকবলিত এবং জলদস্যুপ্রবণ এলাকাতে জাহাজ গমনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে। এক্ষেত্রে জাহাজ মালিক বিএসসির পক্ষ থেকে জাহাজটিকে যুদ্ধকবলিত এলাকায় কেন গমনের অনুমতি দিল। জাহাজ পরিচালনায় বিএসসির সার্বিক অব্যবস্থাপনার কারণে আমাদের আজকে এই মৃত্যু ও নাবিকদের দুর্দশা দেখতে হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় এমভি বাংলার সমৃদ্ধির চরম ক্ষতি হয়েছে। তারা প্রশ্ন করে বলেন, এই মৃত্যুর এবং এই ক্ষয়ক্ষতির দায় কে নেবে।