আপনি কি পরিবারের বড় সন্তান? আপনাকে অভিনন্দন!

ছবি: সংগৃহীত
কিছু বিষয় আছে যা সর্বজনীন সুন্দর আর ভালোলাগার, যার বিপক্ষে বলার কোনো সুযোগ নেই, ফলে বহু কিছুতে খটকা লাগলেও বলা যায় না। যেমন, আমরা প্রায়ই দেখি পরিবারের বড় ছেলে, বাবার অবর্তমানে বা বর্তমান থাকা অবস্থায়ও যদি বাবা কিছু না করেন, তো সেই ছেলেকে সংসারের দায়িত্ব নিতে হয়।
আপনি কি ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড়? তাহলে হয়তো আপনি অনেক বেশি মনোযোগ পান। কিংবা আপনি পড়াশোনায় খুব ভালো। তবু পরিবারের প্রথম সন্তান হয়ে জন্মানোর কিছু ‘খেসারত’ আপনাকে দিতেই হবে। প্রথম সন্তানদের ব্যাপারে যেসব ধারণা প্রচলিত, সেসবের মধ্যে অন্যতম হলো তারা নির্ভুলভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করে, তাদের শিক্ষাগত এবং পেশাগত অর্জন অন্যদের তুলনায় ভালো হয়, তারা ভাইবোনদের যত্ন নেয়, বাড়ির ছোটরা সবাই তাদের নিয়মে চলে। মোটকথা, বলা চলে তারা বাড়ির ‘ছোট মুরব্বি’। কথাগুলো অনেকের ক্ষেত্রে সত্য।
অনেক সময় মা–বাবারা বড় সন্তানকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতেও ব্যর্থ হন। ফলে বড় সন্তানেরা সাধারণত বিশেষ ধরনের মনস্তাত্ত্বিক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যান। বড়রা বড় হন খানিকটা অলক্ষ্যে। বড় হওয়ার ভার অনেকটা নিজেদের কাঁধে নিয়েই বড় হন তাঁরা। ফলে অনেক সময় তাঁদের ভেতর দেখা যায়
তবে এক গবেষণায় দেখা গেছে, বড় সন্তানদের কাছে পরিবার ও সমাজের এসব প্রত্যাশা সারা জীবনই তাদের ওপর কিছু প্রভাব ফেলে, যেসব নিয়ে আমরা হয়তো চিন্তাও করি না।
গবেষক দলটির অন্যতম প্রধান কার্সটেন বার্টলেট এক সাক্ষাৎকারে তাঁদের এই গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেছেন। এই গবেষণা কীভাবে পারিবারিক জীবনে আমাদের উপকারে আসতে পারে, সে বিষয়েও কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। বার্টলেট ও তাঁর সঙ্গী আরও তিন বিজ্ঞানী ‘এপিক রিসার্চ’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে গবেষণাটি পরিচালনা করেন। তাঁরা ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্ম নেওয়া ১ লাখ ৮২ হাজার শিশুর ওপর গবেষণা চালান!
গবেষকদের উদ্দেশ্য ছিল, একজন ব্যক্তি তার ভাইবোনদের মধ্যে কততম, এই বিষয়ের সঙ্গে তার মানসিক অবস্থার সম্পর্ক খুঁজে দেখা। বিশেষ করে আট বছরের মতো শিশুরা দুশ্চিন্তা ও বিষণ্নতার মতো সমস্যায় কেন আক্রান্ত হচ্ছে, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করাও ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য।
গবেষণাটিতে বেশ কিছু বিষয় বিবেচনা করা হয়েছে। যেমন শিশুর বয়স, লিঙ্গ, জাতীয়তা; পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কারও দুশ্চিন্তা ও বিষণ্নতাসহ অন্যান্য অসুখ–বিসুখ আছে কি না; শিশু অপরিণত অবস্থায়, অর্থাৎ নির্ধারিত সময়ের আগেই জন্ম নিয়েছিল কি না; জন্মের সময় ওজন কত ছিল ইত্যাদি। আর্থসামাজিক বিষয়গুলোও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল। যেমন শিশুর নামে কোনো বিমা আছে কি না; শিশু যে এলাকায় বাস করে, সেখানকার পরিবেশ কেমন ইত্যাদি।
গবেষকেরা দেখেছেন, বাদবাকি সব বিষয়ে মিল আছে, এমন শিশুদের মধ্যেও যারা পরিবারের বড় সন্তান, তাদের সঙ্গে বাদবাকিদের মানসিক অবস্থার বেশ পার্থক্য আছে।
গবেষণাটি বড় সন্তানদের সম্পর্কে কী বলে
এতে দেখা গেছে, পরিবারের বড় সন্তানদের মধ্যে কয়েকটি মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। যেসব বড় সন্তানের ছোট ভাইবোন আছে, তাদের দুশ্চিন্তায় ভোগার আশঙ্কা তাদের ভাইবোনদের চেয়ে ৪৮ শতাংশ বেশি। বিষণ্নতার ক্ষেত্রেও তারা ভাইবোনদের চেয়ে ৩৫ শতাংশ বেশি ঝুঁকিতে আছে।
মা–বাবার একমাত্র সন্তানদের ক্ষেত্রেও এসব ঝুঁকি অনেক বেশি। যাদের ভাইবোন আছে, তাদের চেয়ে একমাত্র সন্তানদের দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ৪২ শতাংশ এবং বিষণ্নতায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ৩৮ শতাংশ বেশি।
অর্থাৎ একমাত্র সন্তান কিংবা বড় সন্তানদের দুশ্চিন্তা ও বিষণ্নতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে বেশি।
কখন এসব পরিবর্তন শুরু হয়
প্রশ্ন হলো, বড় সন্তানেরা কি জন্ম থেকেই এ রকম? নাকি এসব মানসিক সংকট ছোট ভাইবোনদের জন্মের পর থেকে শুরু হয়? এই প্রশ্নের উত্তর এই গবেষণায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। গবেষণাটিতে শিশু গর্ভে থাকা অবস্থায় কী ধরনের যত্নআত্তি পেয়েছে, তা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। তবে এর আগের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু পরিবর্তন গর্ভাবস্থা থেকেই শুরু হয়। যেমন ২০২৪ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে দেখা গেছে, যেসব শিশুর মা গর্ভাবস্থায় প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে ছিলেন, সেসব শিশুর মস্তিষ্কে প্রদাহ সৃষ্টির আশঙ্কা বেশি ছিল। অর্থাৎ সেসব শিশু বড় হলে দুশ্চিন্তা ও বিষণ্নতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এর সঙ্গে যুক্ত হয় পারিবারিক কিছু প্রত্যাশার চাপ।
বড় সন্তানদের ওপর মা–বাবারা চাপ দেন এবং তাদের বেশ কিছু দায়দায়িত্ব দিয়ে থাকেন। মা–বাবার প্রত্যাশা, পড়াশোনার চাপ, পরিবারের দায়দায়িত্ব—সব মিলিয়ে তাদের মনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে।
গবেষণাটিতে লিঙ্গের কোনো উল্লেখযোগ্য প্রভাব দেখা যায়নি। ছেলে ও মেয়েদের কাছে পরিবার ও সমাজের প্রত্যাশা এক হয় না। এসব পার্থক্য তাদের মানসিক গঠনে প্রভাব ফেলে। কিন্তু লিঙ্গভেদে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এসব প্রত্যাশার কোনো নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায়নি।
