ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে ইইউয়ের জ্বালানির কী হবে
ছবি: সংগৃহীত
রাশিয়া ইইরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রাকৃতিক গ্যাসের ৪০ শতাংশ সরবরাহ করে থাকে। এমনিতেই গ্যাসের দাম ইউরোপ এবং বিশ্বব্যাপী সেপ্টেম্বর থেকে রেকর্ড মাত্রায় বেড়েছে, যেটা ইউরোপ মহাদেশের বিদ্যুতের দামকে সর্বকালের উচ্চতায় ঠেলে দিয়েছে।
এর ওপর এখন শুরু হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেন উত্তেজনা অব্যাহত থাকলে রাশিয়ার নিজস্ব অর্থনীতি এবং জ্বালানি ভবিষ্যৎ যেমন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে তেমনি ইউরোপের জ্বালানি নিরাপত্তার দৃশ্য খুবই অস্বস্তিকর হয়ে উঠতে পারে।
ইউরোস্ট্যাট পত্রিকার মতে, রাশিয়ার ইউরোপে চাহিদার ৩০ শতাংশ তেল রপ্তানি করে। এস্তোনিয়া, পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া এবং ফিনল্যান্ড তাদের চাহিদার ৭৫ শতাংশ তেল রাশিয়া থেকে পায়। রাশিয়ার রাষ্ট্র-মালিকানাধীন কোম্পানি গ্যাজপ্রম ইউরোপে তেল ও গ্যাস রপ্তানি করে।
কোভিড লকডাউন থেকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে যাচ্ছে ইউরোপের দেশগুলো। নানামুখী চাপে আছে তারা। রাশিয়া এই চাপকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। দেশটি গ্যাস বিক্রি কমিয়েছে এবং ইউরোপে তার মালিকানাধীন ভূগর্ভস্থ স্টোরেজ সুবিধাগুলো রিফিল করছে না। রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে নতুন লড়াই কেবল দাম বাড়িয়ে দেবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্ব তিন কারণে ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহ বিঘ্নিত করতে পারে। প্রথম হলো দ্বন্দ্বের কারণে অবকাঠামে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যে কারণে ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে গ্যাস সাপ্লাই ব্যাহত হতে পারে। বর্তমানে ইউরোপের মোট জ্বালানি আমদানির ১৩ শতাংশ ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে স্থাপিত পাইপলাইন দিয়ে হয়। এর মধ্যে রয়েছে দ্রুজবা তেল পাইপলাইনের দক্ষিণ শাখা যা রাশিয়া থেকে বেলারুশ দিয়ে পশ্চিম ইউক্রেন হয়ে স্লোভাকিয়া, চেক রিপাব্লিক এবং হাঙ্গেরিতে চলে গেছে।
দ্বিতীয়টি হল যে, রাশিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে একটি সামরিক-রাজনৈতিক অভিযানের অংশ হিসেবে জ্বালানি সরবরাহ কমাতে পারে। এটি হয়ে থাকলে বেলারুশ হয়ে পোল্যান্ডে আসা গ্যাস এবং বাল্টিক সাগরের নিচে নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনকে সরাসরি জার্মানিতে প্রভাবিত করবে। নতুন নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইন, যা ইউক্রেনীয় ট্রানজিটের বেশিরভাগ প্রয়োজনীয়তা প্রতিস্থাপন করবে, প্রযুক্তিগতভাবে প্রস্তুত কিন্তু এখনও কার্যক্রম শুরু করতে জার্মানিতে আইনত অনুমোদিত হয়নি।
তৃতীয় কারণ হলো নিষেধাজ্ঞা। রাশিয়ার সামরিক পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায়, ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তি স্থানান্তর ব্লক করবে, বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে লেনদেন ইতোমধ্যে নিষিদ্ধ করেছে এবং নির্দিষ্ট ক্রেমলিন-সংযুক্ত ব্যক্তি এবং তাদের সম্পদ জব্দ করেছে।
রাশিয়ার পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের ডেপুটি স্পিকার নিকোলে ঝুরাভলেভ বলেছেন যে, যদি তার দেশ সুইফট ব্যাংকের মেসেজিং সিস্টেম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে ক্রেতারা আমাদের পণ্য তেল, গ্যাস, ধাতু পাবেন না। তবে ইউরোপ এবং বিশেষ করে জার্মানি তাদের প্রয়োজনীয় গ্যাস আমদানি ব্লক করার বিষয়ে সতর্ক থাকবে, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তেলের দাম আরও বেশি দেখতে চান না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা সম্ভবত রাশিয়ান ব্যাংকগুলোর সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে যে কোনো বিধিনিষেধ থেকে জ্বালানি সম্পর্কিত লেনদেনের জন্য একটি ছাড় দিতে পারে।
২০০৯ সালে ইউক্রেনের মাধ্যমে রাশিয়ান গ্যাসের বাধা এবং ২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে সংযুক্ত করার পর থেকে, ইইউ সফলভাবে তার গ্যাস নেটওয়ার্কগুলোকে পুনরায় কনফিগার করেছে যাতে মস্কো বেছে বেছে দেশগুলোকে বিচ্ছিন্ন করতে না পারে এবং পশ্চিম থেকে বিপরীত প্রবাহের মাধ্যমে ইউক্রেনকে সরবরাহ করা যেতে পারে।
তুলনামূলকভাবে বিচ্ছিন্ন বাজার, যেমন লিথুয়ানিয়া এবং ক্রোয়েশিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কাতার, আলজেরিয়া এবং নাইজেরিয়ার মতো প্রধান রপ্তানিকারকদের থেকে ট্যাঙ্কারে জ্বালানি আনার জন্য তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি টার্মিনাল তৈরি করেছে।
কিন্তু সিস্টেমে দুর্বলতা রয়ে গেছে। স্পেন, যার অতিরিক্ত এলএনজি আমদানি ক্ষমতা রয়েছে এবং আলজেরিয়া থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস গ্রহণ করে, ফ্রান্স এবং মহাদেশের বাকি অংশের সঙ্গে শুধুমাত্র সীমিত সংযোগ রয়েছে। নেদারল্যান্ডসের মূল গ্রোনিংজেন ক্ষেত্র, যা কম্পনের কারণে অনেকাংশে বন্ধ হয়ে গেছে, জরুরি অবস্থায় পুনরায় চালু করা যেতে পারে।
হামলার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় অতিরিক্ত এলএনজি সরবরাহের জন্য চাপাচাপি করা হয়েছে। কাতার খুব সম্প্রতি বিশ্বের বৃহত্তম জ্বালানি রপ্তানিকারক দেশ, ২০১১ সালে ফুকুশিমা দুর্ঘটনার পর জাপানকে সাহায্য করার জন্য উৎপাদন বাড়িয়েছিল। ফুকুশিমা দুর্ঘটনার পর ২০১১ সাল থেকে জাপানকে সহযোগিতা করছে কাতার।
কিন্তু এখন দোহা এবং অন্যান্য প্রধান রপ্তানিকারক, যেমন অস্ট্রেলিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বর্তমান ঊর্ধ্বগতির বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে ইতোমধ্যেই কাজ করছে। দাম বেশি হওয়ায় সরবরাহকারীরা জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন এবং অন্যান্যদের সঙ্গে চুক্তির বাধ্যবাধকতা ভঙ্গ করতে বা পুনঃআলোচনা করতে ইচ্ছা পোষণ করতে পারে। ইউরোপ পূর্ব এশিয়া থেকে কার্গোগুলোকে আকৃষ্ট করতে পারে তবে অবশ্যই বেশি দাম দিয়ে।
ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি নবায়ন সরাসরি গ্যাসের বাজারকে প্রভাবিত করবে না, তবে প্রতিদিন প্রায় ১ দশমিক ৩ থেকে ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন ব্যারেল তেল রপ্তানি দেশটি বাড়াতে পারবে। যা রাশিয়া সরবরাহ কমালে যে ক্ষতি হবে তা কিছুটা লাঘব করতে পারে। এটি ইউক্রেন এবং আরব উপসাগরে সমসাময়িক জটিল সংকটের ঝুঁকিও এড়াতে সক্ষম হতে পারে।
কামার এনার্জির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ‘দ্যা মিথ অব দ্যা অয়েল ক্রাইসিস’ গ্রন্থের রচয়িতা রবিন এম. মিলস ইউর্যাক্টিভ নামের একটি ম্যাগাজিনে লিখেছেন, তেলের কম দাম হলে সেটা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ওপর রাজনৈতিক চাপ কমিয়ে দেবে এবং রাশিয়ার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরও ফলপ্রসূ করতে পারবে। যদি রাশিয়ান তেল রপ্তানি ব্যাহত হয়, তাহলে তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেকভুক্ত দেশগুলো উৎপাদনের মাত্রা সমন্বয় করে, বিশেষ করে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইরাক ক্ষতিপূরণের জন্য উৎপাদন বাড়াবে কিনা তা ঠিক করতে হবে।
এক বা দুই বছরের মধ্যে ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অতিরিক্ত এলএনজি সরবরাহ আসবে। কাতার এবং সম্ভবত সংযুক্ত আরব আমিরাতও তাদের ক্ষমতা বাড়াচ্ছে। কিন্তু এগুলো শুধুমাত্র ২০২৬ সালের দিকে প্রস্তুত হবে।
সূত্র: ইউরোপের বিভিন্ন ওয়েবসাইট
আরইউ/আরএ/