মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানিতে আবারও অনিশ্চয়তা
নানা জটিলতায় মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানিতে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। অতীতের মতোই মূলত সিন্ডিকেট ব্যবস্থা বহাল রাখার কারণে সৃষ্টি হয়েছে এমন জটিলতা। বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এ নিয়ম মানবে না বলে জানিয়েছে।
এদিকে, সরকারও মালয়েশিয়ার সিন্ডিকেট ব্যবস্থা বহাল রাখার প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে জানিয়ে দিয়েছে যে সিন্ডিকেট বহাল থাকুক এমনটা চায় না বাংলাদেশ। যাদের লাইসেন্স আছে তারা সবাই জনশক্তি রপ্তানিতে যোগ্য। বাংলাদেশের এমন অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে মালয়েশিয়া সরকার এখনো কিছু জানায়নি।
জানা যায়, ১৪ জানুয়ারি এক চিঠিতে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমেদকে ২৫টি বাংলাদেশি রিক্রুটমেন্ট এজেন্সির (বিআরএ) মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরুর আহ্বান জানিয়েছেন মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী এম সারাভানান।
এ প্রেক্ষাপটে ১৮ জানুয়ারি মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রীর চিঠির জবাাব দেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ। চিঠিতে ইমরান আহমদ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রাসঙ্গিক সনদ অনুযায়ী সর্বদা স্বচ্ছ, ন্যায্য ও নিরাপদ অভিবাসনের পক্ষে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে লিখেছেন, আমাদের প্রতিযোগিতা আইন-২০১২ সমস্ত বৈধ লাইসেন্সপ্রাপ্ত বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সির জন্য সুযোগ উন্মুক্ত রেখে গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়।
রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো যা বলছে
জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বায়রার সদস্যরা বলছেন, ২০১৬ সালে লুণ্ঠনকারী সিন্ডিকেটটি এবারও সক্রিয়। এ সিন্ডিকেট বন্ধ করতেই হবে।
বায়রার সভাপতি ড. মোহাম্মদ ফারুখ বলেন, ২০১৬ সালে লুণ্ঠনকারী সিন্ডিকেটটি এবারও দুই দেশের নীতি নির্ধারকদের ভুল তথ্য দিয়েছে এবং শক্তি ও অর্থ দিয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কর্মী রপ্তানির জন্য চুক্তিতে একটি শর্ত জুড়ে দিয়েছে। শর্তটি হলো বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানিকারকদের নির্বাচন করার ক্ষমতা মালয়েশিয়া সরকারের হাতে রাখা। এ শর্তের কারণে আবারও সিন্ডিকেট হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং সিন্ডিকেটকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
সব বৈধ লাইসেন্সধারী রিক্রুটিং এজেন্সিকেই শ্রমিক রপ্তানির সুযোগ দেওয়ার দাবি জানিয়ে বায়রা সভাপতি বলেন, কোনো প্রকার সিন্ডিকেট, মনোপলি ও শ্রেণি বিভাজন ছাড়া বৈধ এজেন্সির জন্য সব শ্রমবাজার উন্মুক্ত রাখা সরকারের কর্তব্য।
বায়রার মহাসচিব মোস্তফা মাহমুদ বলেন, ২০১৯ সালের আইন অনুযায়ী আমাদের সরকার শ্রমিকদের লাইসেন্স দেবে। কিন্তু কারা ব্যবসা করবে সেটা ঠিক করবে মালোয়েশিয়ার সরকার।
এটাকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন হিসেবে অভিহিত করে মোস্তফা মাহমুদ বলেন, আমার দেশ থেকে কারা কাজ করবে, সেটা নির্ধারণ করব আমরা, মালয়েশিয়ান সরকার বা অন্য কোনো সরকার নয়।
এ অবস্থায় বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে মালয়েশিয়া যেভাবে কর্মী নেয় সেভাবেই বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়ার দাবি জানিয়েছে বায়রা। সম্প্রতি 'বায়রার সদস্য বৃন্দের' ব্যানারে রাজধানীতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করেন বায়রার সাবেক সভাপতি আবুল বাশার।
প্রতিবাদ জানিয়েছে টিআইবি ও টিআইএম
২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারের মধ্যে সই হওয়া সমঝোতা স্মারকের বিস্তারিত বিষয়সমূহ জনসাধারণের জন্যে প্রকাশে আনতে যৌথভাবে আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল মালয়েশিয়া (টিআইএম)।
এ দাবি জানিয়ে সংগঠন দুটি গণমাধ্যমে যৌথ সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল গত ৮ ফেব্রুয়ারি। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণসহ সম্ভাব্য সব দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে দুই দেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয় যাতে বাংলাদেশের শ্রমিক ও মালয়েশিয়ার নিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষিত হয়।
টিআইবি ও টিআইএম গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সিদের (বিআরএ) একটি অংশ তাদের মালয়েশীয় সহযোগীদের অসাধু প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় প্রবাসী কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়াকে কুক্ষিগত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। অথচ দুই দেশের সরকার জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট এ সমঝোতা স্মারকের বিষয়বস্তু ও শর্তাদি প্রকাশে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
বিভিন্ন দেশে চলতি অর্থবছরে আট লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের লক্ষ্য নির্ধারণ করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় গত ১৯ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের কর্মী পাঠানোর সমঝোতা স্মারক সই করে।
দীর্ঘ তিন বছর পর মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার খোলার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় উচ্ছ্বসিত ছিলেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ এর আগে সিন্ডেকেটের অপকর্মের কারণে দেশটিতে জনশক্তি রপ্তানিই বন্ধ ছিল।
জানা যায়, এর আগে জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে কর্মী নিতে ২০১৬ সালে সমঝোতা স্মারক সই করে দুই দেশ। চুক্তির মেয়াদ ৫ বছর থাকলেও ১০টি জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেট করে ২০০ কোটি রিঙ্গিত হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠায় ২০১৮ সালের পর আর ভিসা দেয়নি মালয়েশিয়া।
এবারও সেই সিন্ডিকেট সক্রিয় বলে অভিযোগ করেছে বায়রার সদস্যরা। মালয়েশিয়া সরকার চায় ২৫টি বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী নিতে। মালয়েশিয়ার এ মনোভাবের বিপক্ষে অবস্থা নিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ চায় উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যোগ্য এজেন্সির যে কেউ কর্মী পাঠাতে পারবে।
আরইউ/এসএন