চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডের ৩ বছর
কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি পুরান ঢাকা
চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ৩ বছর পার হলো। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ৭১টি তাজা প্রাণ পুড়ে ভস্ম হয় পুরান ঢাকার এই স্থানে। পুরান ঢাকায় ছোট-বড় সবমিলিয়ে ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে, যার বেশিরভাগই পুরান ঢাকায়। বলতে গেলে এখনো মৃত্যুপুরিতে বসবাস করছেন সেখানকার অধিবাসীরা। প্রতিবারই বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটলে কেমিক্যাল গোডাউন অপসারণের কথা বলা হয়। তবে বাস্তবতা হলো–এর ফলাফল শূন্য। এমনকি ফায়ার সার্ভিসের সুপারিশমালাও ফাইলবন্দি হয়ে আছে। কার্যত কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি পুরান ঢাকা।
পুরান ঢাকার অধিবাসীরা জানান, কেমিক্যালের ব্যবসা হস্তান্তর করার কথা থাকলেও এখনো তা হয়নি। যেসব বিল্ডিংয়ে আগুন লেগেছিল সেসব বিল্ডিং এখন ব্যবহারযোগ্য। তাদের মতে, আবারও পুরান ঢাকায় আগের মতো বসবাস করা হচ্ছে। কেমিক্যাল গোডাউনও রয়েছে আগের মতোই। যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলি ও ২০১৯ সালে চুড়িহাট্টায় ঘটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। নিমতলিতে আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয় ১২৪ তাজা প্রাণ, আর চুড়িহাট্টায় ৭১। দুবারই সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বলা হয়েছিল খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পুরান ঢাকা থেকে দাহ্য রাসায়নিকের ব্যবসা স্থানান্তর করা হবে। তবে এখনো দাহ্য কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের হাত থেকে মুক্ত হয়নি পুরান ঢাকা।
দিন যত গেছে সেই তৎপরতা ততই কমেছে এবং কমতে কমতে এক সময় থেমে গেছে। চকবাজার যেমন ছিল তেমনই আছে, তেমনই আছে পুরান ঢাকা। কিছুই সরেনি, কিছুই নড়েনি। ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলিতে অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর পরও এমনটাই ঘটেছিল। প্রাণের পর প্রাণ ঝরে, পুরান ঢাকা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল সরে না। সংবাদমাধ্যমের খবরে ও মানুষের মনে দগদগে ঘায়ের মতো এসব স্মৃতি যত শুকিয়ে যায়, কর্তৃপক্ষের দায়দায়িত্বও ততই যেন ফুরিয়ে যায়।
প্রায় ২৫ হাজার রাসায়নিক দাহ্যপদার্থের গোডাউনের উপরই বসবাস করছে বিশাল জনগোষ্ঠী। যদিও এসবের মধ্যে মাত্র আড়াই হাজার গুদামকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন ঢাকার বাইরে আলাদা কেমিক্যাল জোন গড়ে তুললে তারা ব্যবসায়িকভাবেও লাভবান হবেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সারি সারি প্লাস্টিকের ড্রাম আর দাহ্য রাসায়নিক পদার্থে ঠাসা দোকান। কোনো কোনোটিতে আবার বস্তাভর্তি দাহ্য কেমিক্যাল। তার ঠিক ওপরেই এলোমেলোভাবে ঝুলছে অসংখ্য বৈদ্যুতিক তার। দোকানের উপরেই রয়েছে বাসাবাড়ি। পুরান ঢাকার আরমানিটোলা, লালবাগ, কোতোয়ালি, বংশাল, চকবাজারসহ বেশিরভাগ এলাকার কেমিক্যাল দোকানগুলোর দৃশ্য এমন।
দৃশ্যটা কেবল এমনই নয়, পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আবাসিক ভবনগুলোর নিচতলা বেশিরভাগই বিভিন্ন কারখানা ও গোডাউন। এসব গোডাউনেই মজুদ থাকে প্লাস্টিকের ড্রাম আর দাহ্য রাসায়নিক পদার্থে ভর্তি বস্তা। এসব গুদামে রয়েছে গ্লিসারিন, সোডিয়াম অ্যানহাইড্রোস, সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, মিথাইল ইথাইল কাইটন, থিনার, আইসোপ্রোইল ইত্যাদি। আগুনের সংস্পর্শে এলে ভয়ংকর হয়ে উঠে এসব রাসায়নিক পদার্থ।
ফায়ার সার্ভিসের সুপারিশ
অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদনে উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলো হলো–অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে আবাসিক এলাকায় যে কোনো ধরনের রাসায়নিকের দোকান বা গুদাম স্থাপন করা যাবে না। পুরান ঢাকার সব রাস্তা ও গলিপথ বাধামুক্ত করে কমপক্ষে ২০ ফুট প্রশস্ত করতে হবে। এসব রাস্তায় স্ট্রিট হাইড্রেন্ট স্থাপন করে নির্দিষ্ট দূরত্বে পানির প্রবাহ নিশ্চিত রাখতে হবে। কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের সেই সুপারিশের বাস্তবায়ন ঘটেনি আজও।
শিল্প ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গত বছর দাখিল করা একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ড ঠেকানোর ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন জানান, ‘চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের পর ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটি বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরে। এর মধ্যে অন্যতম সুপারিশ ছিল অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে আবাসিক এলাকায় যে কোনো ধরনের রাসায়নিকের দোকান বা গুদাম স্থাপন করা যাবে না; কিন্তু সুপারিশে থাকা স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত হলেও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা যায়নি। এখনো সরানো যায়নি রাসায়নিকের সব দোকান-গুদাম। অন্য সুপারিশগুলোর অধিকাংশেরই যে বাস্তবায়ন ঘটেনি এটাও বলা ভুল হবে না। ফলে এখনো পুরান ঢাকাকে অগ্নি ঝুঁকিমুক্ত বলা যাচ্ছে না।’
এদিকে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাজধানীর পুরান ঢাকায় ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন বা রাসায়নিক পণ্যের গুদাম রয়েছে। এ সবের মধ্যে ১৫ হাজার আছে বাসাবাড়িতে।
ব্যবসায়ীরা বলেন, ‘নিমতলি ট্র্যাজেডির পর সরকার আমাদের নির্দিষ্ট জায়গা দেওয়ার কথা বলেছিলেন; কিন্তু আমরা আজ পর্যন্ত তা বুঝে পাইনি। যে পরিবেশে এ ব্যবসাটা করা উচিত আমরা এখনো তা গড়ে তুলতে পারিনি। পুরো প্রক্রিয়া একটা এলাকার মধ্যে থাকলে ঝুঁকি কমবে।’
এদিকে গোয়েন্দা পুলিশের ধারণা, বর্তমানে কেমিক্যাল আমদানি নীতিমালাও পুরোপুরিভাবে সংস্কার করা হয়নি। দেশে ৯ ধরনের কেমিক্যাল আমদানি করা হয়ে থাকে; কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ৩ ধরনের কেমিক্যালের বহন, ব্যবহার ও সংরক্ষণের জন্য নীতিমালা রয়েছে। বাকি ৬ ধরনের কেমিক্যাল কোনো নীতির তোয়াক্কা না করেই ব্যবহার করা হয়। এ ৬ ধরনের কেমিক্যালের আড়ালে বিভিন্ন বিস্ফোরক ও নেশাজাতীয় কেমিক্যাল আমদানি করা হচ্ছে।
২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলিতে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নারী ও শিশুসহ ১২৩ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর পুরান ঢাকার অবৈধ রাসায়নিক দ্রব্যের দোকান অপসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৫ সালে কেরানীগঞ্জের সোনাবান্দায় ২০ একর জমিতে কেমিক্যাল পল্লী গঠনের কথা থাকলেও প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতির কারণে ওই জমি আইটি পার্ক করার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়।
কেমন আছে চুড়িহাট্টা
চুড়িহাট্টা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সবকিছু স্বাভাবিক। আতঙ্কের ছাপ নেই। অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হওয়া সেই ওয়াহিদ ম্যানশনের নিচে নেই স্বজন হারানোদের ভিড়। ভবনটিকেও নতুন রূপে ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে।
চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির পর কয়েক দফা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে পুরান ঢাকায়। দুর্ঘটনা হলেই রাসায়নিক কারখানা স্থানান্তরের বিষয়ে আলোচনা হয়। কয়েক দিন পর তা থেমে যায়। ২০১৯ সালে ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল গোডাউন উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। পরে এফবিসিসিআইর অনুরোধে ডিএসসিসি উচ্ছেদ অভিযান সাময়িক স্থগিত করে। এর পর আর অভিযান শুরু হয়নি।
বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ ও সিটি করপোরেশনের মত
এ বিষয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের জানান, করপোরেশনের উদ্যোগে ১ হাজার ৯২৪ জন ব্যবসায়ীর তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এ তালিকা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। পরে স্থানান্তরের বিষয়ে তারা পদক্ষেপ নেবে।
আবু নাছের বলেন, ‘দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩, ৪ ও ৫ নম্বর অঞ্চলে এসব কেমিক্যাল গোডাউনগুলোর অবস্থান। এর মধ্যে এগারোশর অধিক কারখানার অবস্থান অঞ্চল ৩-এ।’
২০১০ সালে নিমতলিতে অগ্নিকাণ্ডের পর দুর্ঘটনা রোধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব ইকবাল খান চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটি কেমিক্যাল গোডাউন অপসারণসহ ১৭ দফা নির্দেশনা দেয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই সুপারিশমালা দীর্ঘ ১১ বছর ধরে ফাইলবন্দি। এর মধ্যেই ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে নিমতলির ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে চকবাজারের চুড়িহাট্টায়। এ সময়ও বেশকিছু সুপারিশ করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি। এতে আগুনের জন্য ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় গুদামজাত করা বিপুল পরিমাণ রাসায়নিককে দায়ী করা হয়।
বাপার নির্বাহী সহসভাপতি আব্দুল মতিন বলেন, ‘পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউন সরাতে বাপা একাধিকবার কথা বলেছে। কিছু উদ্যোগ নেয়া হলেও এখন আর কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের গবেষণায় প্রায় ২৫ হাজার অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে। এগুলো না সরালে কিছুতেই অগ্নিকাণ্ড ঝুঁকি কমবেনা। আমরা বারবার সরকারকে এ বিষয়ে তাগিদ দিয়ে আসছি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বুয়েটের বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. আশিকুর রহমান ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ড একটি ভয়াবহ ঘটনা। আমাদের দেশে একটি ঘটনা ঘটার পর মানুষ কিছুদিন সতর্ক থাকে। পরে আর এসব ঘটনাকে কিছু মনে করে না। আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়। সতর্ক না হওয়ার কারণে আবারও বিস্ফোরণ বা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার শিকার হতে হয়। তাছাড়া আমাদের বড় বড় ঘটনা গুলো প্রথম দিকে একটু ভালো মনিটরিং হয় পরে আর কোন মনিটরিং করা হয় না, যদি নিয়মিত মনিটরিং থাকতো তাহলে জনসচেতনতা বৃদ্ধি পেত যেটা একেবারেই নাই বললে চলে। এটি না থাকার কারণে আবারও সেখানে পরবর্তীতে বিস্ফোরণের আশঙ্কা থাকে।’ জনসাধারণ সতর্ক না হলে বিস্ফোরণের ঘটনা কমবে না বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।
কেএম/এসএ/