৩ মাসে সড়কে প্রাণ গেছে ১৩১৫ জনের
কুমিল্লার ময়নামতিতে ট্রাকচাপায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার ৫ যাত্রী নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও দুজন। শুক্রবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) ভোরে কুমিল্লা-সিলেট অঞ্চলিক মহাসড়কের ময়নামতি তুত বাগান এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। সারাদেশে প্রতিনিয়তই এমন দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। দেখা গেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চালকদের গাফিলতি এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ। সরকারি ও বেসরকারিভাবে বারবার সর্তক করা হলেও সড়ক এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, গত ৩ মাসে সড়কে প্রাণ গেছে ১৩১৫ জনের।
ফাউন্ডেশনের দাবি, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, তরুণ ও যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতি এবং গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজির কারণে প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
ফাউন্ডেশনের হিসাব মতে, ২০২১ সালের নভেম্বর, ডিসেম্বর এবং চলতি বছরের জানুয়ারি মোট তিন মাসে ১১৮৯টি সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। যার কবলে পড়ে নিহত হয়েছেন ১৩১৫ জন। আহতের সংখ্যা দেড় হাজারেরও বেশি।
তাদের তথ্যমতে, ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে ৩৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১৩ জন নিহত হয়েছেন। গড়ে প্রতিদিন নিহত হয়েছেন ১৩ দশমিক ৭৬ জন। ডিসেম্বর মাসে ৩৮৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪১৮ জন। গড়ে প্রতিদিন নিহত হয়েছেন ১৩ দশমিক ৪৮ জন। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে সারা দেশে মোট সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪২৭টি। এতে নিহত হয়েছেন ৪৮৪ জন। আহত হয়েছেন ৬৭৩ জন। গড়ে নিহত হয়েছেন ১৫ দশমিক ৬১জন।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৮ তারিখ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। তথ্যমতে জানা যায়, এ সড়ক দুর্ঘটনায় ২৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।
এদিকে ট্রাফিক পুলিশ বলছে, বিভিন্নভাবে তারা চালকদের সতর্ক করছেন এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানোর জন্য মামলাও দেওয়া হচ্ছে। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করছেন তারা। ট্রাফিকের দাবি, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আগের চেয়ে রাস্তায় তাদের তৎপরতা বেড়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সড়কে ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অসতর্কতা ও অদক্ষ চালকের কারণে প্রতিদিন এসব দুর্ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। দেখে গেছে, সারাদেশে সড়কে অকালমৃত্যুর প্রতিবাদে বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা একের পর এক অবরোধ করে আন্দোলন করছে কিন্তু তাতে তেমন কোনো সুফল আসেনি।
সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক সাধারণ এবং হতদরিদ্র মানুষও মারা যাচ্ছেন। যার কারণে ধ্বংস হচ্ছে একেকটি পরিবার। বাস, মিনিবাস, ট্রাক, ট্রাক্টরের মতো ভারী গাড়িগুলো মারাত্মক দুর্ঘটনার জন্য অধিকতর দায়ী।
বুয়েটের এক সমীক্ষা বলছে, ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও অদক্ষ চালকের কারণে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। ওইসব গাড়ির মধ্যে সব চেয়ে মিনিবাসই বেশি দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘দেখা যায়, যতগুলো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে অধিকাংশই হয়ে থাকে চালকের জন্য। অনেক সময় ঘুম না হওয়ার কারণে তাদের মেজাজ খিটখিটে থাকে। অনেক সময় আমরা জানতে পারি, চালকরা অতিরিক্ত মদ পান করে এবং বিশ্রাম না থাকায় ঘুমিয়ে পড়ে। যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। এমন সব নানান বিষয় রয়েছে, যার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। তবে দিনদিন সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো–এ সেক্টরে কোনো নিয়ম-নীতি নেই। এজন্য একটি শক্ত নিয়ম-নীতির প্রয়োজন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে সাধারণত ড্রাইভারদের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা যাচাই করা হয় না। ড্রাইভারদের মধ্যে কিছুটা শিক্ষাগত যোগ্যতা যাচাই করা হলে সড়ক দুর্ঘটনা কিছুটা কমে আসবে। বর্তমান বিআরটিএ ড্রাইভারদের ক্ষেত্রে একটি ডোপ টেস্টের পরিকল্পনা নিয়েছে, যেটা খুবই প্রশংসামূলক কর্মকাণ্ড। ডোপ টেস্টের ভয়ে অনেক ড্রাইভার মদ পান থেকে বিরত থাকবে। যার কারণে কিছুটা হলেও সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে।’
এ অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আমরা দেখেছি ঢাকা এবং সিলেটে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। তা ছাড়া অনেক এলাকার রাস্তাঘাট তেমন ভালো না। যদি আরও ভালোভাবে সড়কের উন্নতি করা যায় তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকখানি কমে আসবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘সড়কে নিয়মিত অসংখ্য মানুষের প্রাণ ঝরছে। এর জন্য মূলত দায়ী নৈরাজ্য। যদি সরকার দীর্ঘমেয়াদি একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে সেই ক্ষেত্রে হয়তো সড়ক দু্র্ঘটনা কমে আসবে। যদি সড়কে সরকার পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের জন্য একটি কঠোর আইন বাস্তবায়ন করতে পারে, তাহলে অনেক চালক ও পরিবহন সেক্টরের সংশ্লিষ্টরা ভয়ে থাকবে এবং তারা সবসময় শ্রমিকদের সতর্কভাবে গাড়ি চালাতে বলবে। পরিবহন সেক্টরের কাছে অনেক মানুষ জিম্মি। তা ছাড়া পুলিশের চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে সব নৈরাজ্য বন্ধ হলেই সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এদিকে বিআরটিএরও সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে এবং গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজির কারণে নিয়মিত দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সড়ক দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেতে হলে চালক ও সাধারণ মানুষকে অতিরিক্ত সতর্ক হতে হবে এবং সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলেই সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে।’
কেএম/এসএ/