সেলফিতে ডিজিটাল প্রতারণার ফাঁদ!
সামজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক জনপ্রিয় হওয়ায় ক্রমেই বাড়ছে সেলফির (নিজের ছবি নিজে তোলা) ব্যবহার। যে কোনো আনন্দঘন মুহূর্ত এক ক্লিকেই ক্যামেরাবন্দী করে রাখে সেলফি প্রেমীরা। আর এই সেলফি সোশ্যাল মিডিয়ায় হাজারও মানুষের ওয়ালে ওয়ালে ভেসে বেড়ায় দিনের পর দিন। দর্শকরা লাইক-কমেন্টের মাধ্যমে জানাতে পারে তাদের অনুভূতি। এই জনপ্রিয়তার সুযোগ নিয়ে প্রতারণায় মেতেছে একটি চক্র। বেড়েছে নানা অপরাধ। এমনটাই মনে করেন রাজনীতি ও অপরাধ বিশ্লেষকরা।
তাদের দাবি, অনেক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা আছেন যারা তাদের কর্মচারীকে চেনেন না। কেউ কেউ তাদের সঙ্গে সেলফি তুলে ফেসবুকে দিয়ে ওই কর্মকর্তার নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন প্রতারণামূলক কাজ করে থাকেন। যে বিষয় ওই কর্মকর্তা নিজেও অবগত নয়। এ ছাড়াও এমন রাজনৈতিক নেতা আছেন যারা তাদের কর্মীকে ভালোভাবে জানেন না। কোনোভাবে তার সঙ্গে ছবি তুলে মানুষের সামনে নিজেকে নেতার খাস লোক বলে পরিচয় দেন। পরে ওই সব ছবি দেখিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেন তারা।
রাজনীতি ও অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, সারাদেশে ২০ শতাংশ মানুষ বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রতারিত হচ্ছে। তা ছাড়া কৌশলে হাই প্রোফাইল মানুষদের সঙ্গে ছবি তুলে প্রতারকরা সরল মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে।
এদিকে সাধারণ মানুষের দাবি, এসব বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী তৎপর না হলে সাধারণ মানুষ আরও প্রতারিত হতে পারে। তারা মনে করেন, বিশেষ করে প্রভাবশালী মানুষের সঙ্গে ছবি তুলে গ্রামে গিয়ে বা অন্য কোথাও বেড়াতে গিয়ে চাকরি পাইয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার চেষ্টা করছে প্রতারকরা।
এমনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলার মোছা. মাকসুদা বেগম। তার প্রতারিত হওয়ার অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বলেন, ২০১৫ সালে জাপার নেতা জি এম কাদেরের সঙ্গে এক ভদ্রলোকের (প্রতারক) ছবি দেখেন তিনি। এরপর তাকে ধরেন ইউনিয়ন ব্যাংকের চাকরির জন্য। প্রতারক তাকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ৫ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়। এরপর ভুক্তভোগী মাকসুদাকে এক বছর পরে ভুয়া জয়েন্ট লেটার ধরিয়ে দেয়।
কথা হয় ফুলবাড়িয়ার আরেক ভুক্তভোগী মো. আলামিনের সঙ্গে। তিনিও প্রতারিত হওয়ার ঘটনা তুলে ধরে বলেন, তখন সে ছাত্র অবস্থায় একটি কোম্পানিতে অল্প বেতনে কাজ করতেন। কম বয়সে সরকারি চাকরি ও অতিরিক্ত টাকার নেশায় কোম্পানির চাকরিটা ছেড়ে দেন। প্রতারক কামাল হোসেনের সঙ্গে কথা হলে একটি মন্ত্রণালয়ের চাকরির জন্য ৪ লক্ষ টাকা প্রদান করেন তিনি। অবশেষে কৌশলে টাকা নিয়ে প্রতারক যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে টাকার শোকে হতাশায় ডুবছেন আলামিন।
বিভিন্নভাবে এমন প্রতারণার শিকার হন ঢাকা কলেজের ছাত্র নাসিম। তার এলাকার এক ব্যক্তির সঙ্গে তখনকার আইজিপি শহিদুল হকের একটি ছবি দেখেন। বেকারত্ব দূর করার লক্ষ্যে সে বাড়ি থেকে জমি বন্ধক রেখে একটি প্রাইভেট বাংকের চাকরির জন্য ওই প্রতারককে ধরেন, পরে তার কাছ থেকে কৌশলে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। যা এখনও ফেরত পাননি তিনি।
সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে হাইপ্রোফাইল ও বড় বড় প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন প্রোগ্রামের কৌশলে একাধিক ছবি তোলেন প্রতারকরা। নেতাদের সঙ্গে সেলফি থাকায় প্রতারকরা নিজেদেরকে নেতা বলে দাবি করে সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলে। এমন প্রতারণার শিকার হওয়া বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। এসময় ভুক্তভোগীরা বিভিন্ন অভিযোগ করেন।
ভুক্তভোগী বাইজিত আহমেদ নামের এক ব্যক্তি অভিযোগ করে বলেন, বিএনপির নয়া পল্টন অফিসে কথিত এক সাংবাদিকের সঙ্গে পরিচয় হয়। বিএনপির একাধিক নেতাদের সঙ্গে তার ‘সেলফি’ দেখি। কিশোরগঞ্জ জেলায় দলীয় পোস্ট পাবার আশায় ওই সাংবাদিককে ২০ হাজার টাকা দিয়েছি। মিলছে না কোনো পদ।
এদিকে, বরিশাল জেলার যুবদলের কমিটিতে পদের আশায় মনির নামে এক ব্যক্তি বিএনপির পল্টন অফিসের এক কর্মচারীকে ১৫ হাজার টাকা দিয়েছেন। তিনি বলেন, 'তার নাম বলতে চাই না কারণ আমি টাকা দিয়ে অপরাধ করেছি। তবে আমি তার সঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিবের একাধিক ছবি দেখেছি এজন্য তাকে বিশ্বাস করে টাকা দিয়েছিলাম। পরে শুনি সে পল্টন অফিসের কর্মচারী। লজ্জায় আর টাকা ফেরত চাই না।'
তিতুমীর কলেজের মো. আকবর হোসেন নামের এক ছাত্রনেতা কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক হওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা হাফিজকে ৫০ হাজার টাকা দেন, যদিও এর প্রমাণ পাওয়ার পর হাফিজকে ওই পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে যুবলীগে পদের আশায় গত কমিটিকে এক লক্ষ টাকা দিয়েছেন যশোর জেলার যুবলীগ নেতা ফয়সাল। সে একই সংগঠনের রাজনীতি করতেন। ভালো পদের জন্য টাকা দিয়েছেন। পরে কমিটিতে তার নাম না আশায় সে প্রতারকের কাছে টাকা ফেরত চাইলে তাকে বহিষ্কারের কথা বলেন যুবলীর সাবেক নেতা মনির।
বনানী থানার সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সাবের হোসেন বলেন, যুবলীগের বড় নেতার সঙ্গে অনেক ছবি দেখে নতুন কমিটিতে থাকার জন্য এক প্রতারককে কিছু টাকা দিয়েছিলাম পরে দেখি সে নিজেই পদ পায়নি।
এদিকে, লেখক ও বড় প্রোফাইলের মানুষদের সঙ্গে একাধিক ছবি দেখে পরিবারের খোঁজ-খবর না নিয়ে শামীম নামের এক ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেন মহাখালী এলাকার কাজী রফিকুল ইসলাম। পরবর্তীকালে সে জানতে পারে ওই ছেলের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর। বাড়িতে শুধু ভিটামাটি ছাড়া আর কিছু নেই। অথচ বিয়ের আগে ওই ছেলে বিভিন্ন প্রভাবশালীদের ছবি দেখিয়ে তার মামা, চাচা, ফুফা বলে পরিচয় দিয়েছেন। ৬ মাস ঘর সংসারের পর ওই ছেলের কাছ থেকে মেয়েকে ডিভোর্স করান তিনি।
বিশেষ করে বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে ‘সেলফি’ ইতিবাচকের চেয়ে নেতিবাচকের প্রভাবই বেশি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বড় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে সেলফিবাজি করে নিজেকে ‘ত্যাগী’ প্রমাণ করে অনেকে পদ বাগিয়ে নিচ্ছেন। অনেকে আবার ডিজিটালভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাতের সেলফি তুলে নানা মাধ্যমে ছড়িয়ে দলের নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন অনেকে। এই অভিনব কৌশলকে ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করে কেউ কেউ নেমেছেন প্রতারণায়। সহজসরল মানুষকে টার্গেট করে হাতিয়ে নিচ্ছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ।
প্রভাবশালী বড় বড় রাজনৈতিক ব্যক্তি ও সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমে ব্যবহার করে প্রতারণার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তাসহ রাজনৈতিক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞগণ বিভিন্ন মত দিয়েছেন।
রাজনৈতিক নেতারা যা বললেন:
এ বিষয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রধান সদস্য নাজমুল হাসান জুয়েল বলেন, 'আমাদের সংগঠনের নিয়ম-শৃঙ্খলা খুবই কড়াকড়ি। কারণ এর আগের কমিটিতে সমালোচনা ছিল। বর্তমান যুবলীগ চেয়ারম্যান স্যার ও সাধারণ সম্পাদকদের নেতৃত্বে খুব সুনাম অর্জন করেছে এবং এটি সুসংগঠিত। এ সংগঠনের পদ-পদবির জন্য কারও নিকট থেকে টাকা নেওয়া হয় না। সাংগঠনিক যোগ্যতায় পদ-পদবির নির্ধারণ করা হয়।
জানতে চাইলে খালেদা জিয়ার প্রেস উইং সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সেলফি বা ছবি থাকতে পারে, এটা স্বাভাবিক। এটা নিয়ে প্রতারণার কিছু নেই। মানুষ সচেতন হলেই হয়।
সেলফি প্রতারণার বিষয়ে অপরাধ বিশেষজ্ঞদের ভাবনা
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিশেষজ্ঞ তহিদুল হক বলেন, সোশ্যাল মিডিয়াতে ছবি দেখিয়ে অথবা রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সেলফি দেখিয়ে অনেকে প্রতারণা করার চেষ্টা করছে, অনেকে প্রতারিত হচ্ছেনও। কারণ আগের দিনে এই ডিজিটাল ব্যবহার ছিল না এজন্য এটাকে নতুন মাত্রা বলা যায়। যেহেতু এটা নতুন কৌশল, এ কারণে সরল মানুষদের অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। কোনো কিছুতে প্রতারণার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, এমনটা মনে করলে সেই ক্ষেত্রে সচেতন মহলের সহযোগিতা নিতে পারে।
তিনি আরও বলেন, 'এমন ধরনের প্রতারণা করে যারা ধরা পড়ে তারা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বের হয়ে যায়। প্রতারকদের দমনে শক্তিশালী কোনো আইন না থাকায় দিন দিন এ অপরাধের সংখ্যা বাড়ছে। যার কারণে অনেক পরিবার অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রযুক্তির যুগে যদি এসব বিষয়ে কঠিন আইন ও শাস্তির বিধান থাকে তাহলে হয়তো এ ধরনের অপরাধ কমে আসবে।'
সারাদেশে কত সংখ্যক মানুষ এমন প্রতারণার শিকার হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'এটা নির্দিষ্ট করে বলা খুবই কঠিন। তবে ২০ শতাংশ মানুষ এমন প্রতারণার শিকার হতে পারেন। এই প্রতারণার শিকার হন সহজ-সরল মানুষ। যদি দুয়েকটা ঘটনার সঠিক মতো বিচার হয় তাহলে এ ধরনের অপরাধ কমে আসবে। সর্বশেষ বলব এসব প্রতারণা থেকে বাঁচতে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।'
যা বললেন আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা:
গুরুত্বপূর্ণ ও অভিজাত ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে ফেসবুকে দিয়ে তাদের নাম ভাঙিয়ে হরহামেশাই প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে প্রতারকরা।
এ বিষয়ে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, এমন প্রতারণার শিকার যারা হচ্ছেন তাদের অতিরিক্ত লোভ-লালসা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। লোভের কারণে তারা এমন ধরনের অপরাধের শিকার হচ্ছেন। তা ছাড়া যদি কেউ কোনো হাই প্রোফাইল ব্যক্তির ছবি দেখিয়ে চাকরি বা অন্যান্য বিষয়ে সহযোগিতা করতে চায়, আর যদি নিজের সুবিধার জন্য কেউ লেনদেন করে সেক্ষেত্রে প্রতারকরা এর সদ্ব্যবহার করে থাকে।
প্রতারক থেকে এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়ে তিনি আরও বলেন, কেউ যদি এমন অপরাধের শিকার হন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিন। প্রয়োজনে আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের পরামর্শ নিতে পারেন। তবে পুলিশের কাছে এমন অভিযোগ এলে পুলিশ সেগুলো আমলে নিয়ে কাজ করে।
জানতে চাইলে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সহকারী পরিচালক আ ন ম ইমরান খান বলেন, অনেক সময় বিভিন্ন ফাংশনে হাই প্রোফাইল মানুষের সঙ্গে অনেকের দেখা হয় এবং সেখান অনেক মানুষ ছবি তোলেন। ছবি তোলা অন্যায় নয়, তবে এর অপব্যবহার অবশ্যই অন্যায়।
প্রতারক ব্যাপারে সচেতনা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি আরও বলেন, যদি কোনো হাই প্রোফাইল মানুষের সঙ্গে সেলফি দেখে কারো দ্বারা কেউ প্রতারণার শিকার হয় সেক্ষেত্রে দায়ভার ওই প্রতারিত ব্যক্তিরই, কারণ সে সচেতন না। যদি সে আগে থেকে সাবধান থাকত তাহলে হয়তো এ ধরনের প্রতারণার শিকার হতো না। এ ক্ষেত্রে সকলকে সচেতন হতে হবে এবং তাহলেই এ ধরনের ডিজিটাল অপরাধ অনেকটা কমে আসবে।
কেএম/টিটি