‘ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে’ চলে যাচ্ছে শিশুরা
হঠাৎ করেই ডেঙ্গু ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। আর তাতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে পড়েছে শিশুরা। এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে যত সংখ্যাক লোক মারা গেছে তারমধ্যে ৩৫ শতাংশই শিশু। আক্রান্তদেরও ৩৮ শতাংশ শিশু। চিকিৎসকরা বলছেন, আক্রান্ত হওয়ার পর খুব অল্প সময়েই ডেঙ্গু ‘শক সিনড্রোম’-এ চলে যাচ্ছে শিশুরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হলে রোগীদের অনেকেই মারা যাচ্ছে। আগে যেমন ডেঙ্গুর একটা প্যাটার্ন ছিল। একটার পর একটা লক্ষণ বোঝা যেত এখন সেটা হয় না। এখন পুরো প্যাটার্নটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন দেখা যায় একদিন দুই দিনের জ্বরেই ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে চলে যায় রোগী এবং তাদের অনেকে মরণাপন্ন হয়ে পড়ে।
চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে যে গাইডলাইন থাকে সেটা অুনসরণ করে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে পর্যাপ্ত ইকুইপমেন্ট ও জনবলের সংকট থাকায় সেটা সম্ভব হচ্ছে না।
চিকিৎসকরা বলছেন, এখন দেখা যায় একদিনেই একটা শিশু খারাপ অবস্থার দিকে যাচ্ছে। যা হওয়ার কথা না তাই হচ্ছে। যখন জ্বর কমে আসে তখন থেকে ৫-৭ দিন পর্যন্ত যে সময় থাকে তখনো শিশুর শারিরীক অবস্থা খারাপ হতে পারে। তাই জ্বর যখন কমে আসবে তখনো সাবধানে থাকতে হবে যাতে ‘শক সিনড্রোম’ বা খারাপ সময় আসতে না পারে।
নেই সঠিক গাইডলাইন
ডেঙ্গু সম্পর্কে ডাক্তারদের ওরিয়েন্টেশন দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে এবং একটা গাইডলাইনও তৈরি করেছে সরকার। কিন্তু সবার জন্যই একই গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিটি রোগীই আলাদা। কাজেই একটি ইন্ডিভিজুয়াল গাইডলাইন তৈরি করে বসে থাকলে সব রোগীকে ম্যানেজ করা যাবে না। একেক রোগীর একেক রকম প্রকাশ এবং তাদের ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রেও হয়ত কিছু ডিফিকাল্টি আসছে।
আরেকটা হচ্ছে প্রেডিকশন। চিকিৎসকরা ধরেই নিচ্ছেন এই কয়টা ব্যবস্থা নিলেই ডেঙ্গু থাকবে না। কিন্তু এটা বুঝতে হবে যে এটি কোনো সময় খারাপ হবে তার কোনো নির্দিষ্ট প্যাটার্ন নেই।
পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই, সংকট জনবলেরও
চিকিৎসকরা বলছেন, হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্টের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও তেমন নেই। যেমন ঘণ্টায় ঘণ্টায় ব্লাড প্রেসার মাপা, রোগীকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখা ইত্যাদি।
ডেঙ্গু রোগীকে অনেক সময় প্রেসার বাড়ানোর জন্য স্যালাইন দিতে হয়। ওই সময় হয়তো রোগী ভাল হয়। কিন্তু পরে রোগীর নানা সমস্যা তৈরি হয়। পরবর্তীতে পেটে বা ফুসফুসে পানি চলে আসে।
এবার মারাত্মক লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার আগেই আক্রান্ত শিশুদের শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। একারণেই ওই সময়টায় আইসিইউ প্রয়োজন হচ্ছে। কিন্তু আইসিইউ তো বাংলাদেশে অল্প কয়েকটা হাসপাতালে আছে। ফলে ওই ধরনের ম্যানেজমেন্টে পাচ্ছে না এবং আলটিমেটলি বাচ্চার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
সব ডেঙ্গু তো ক্রিটিকাল স্টেজে যাচ্ছে না। যে ডেঙ্গুগুলো ক্রিটিকাল স্টেজে যাচ্ছে তাদেরকে ম্যানেজ করার জন্য পর্যাপ্ত জনবল-হাসপাতাল-বেড স্বল্পতা রয়েছে বাংলাদেশে।
জানতে চাইলে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আব্দুল্লাহ আল-মামুন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, এখন সবাই চিন্তিত প্লাটিলেট কাউন্ট নিয়ে। রক্ত দেওয়া বা এটা-সেটা সেগুলো। এই ব্যাপারটা ঠিক এমন না।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে যেটা হয় সেটা হলো প্লাজমা লিকেজ। মানে আমাদের রক্তনালী থেকে কিছু উপাদান বাইরে চলে যায় এবং শরীরের প্রেসার ধরে রাখার জন্য যেগুলো দরকার সেগুলো বাইরে চলে যায়। আল্টিমেটলি ব্লাড প্রেসার কমে যায় এবং প্রেসার স্বাভাবিকে ফেরত নিয়ে না আসতে পারলে শিশুর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।
ডা. আল মামুন বলেন, আরেকটি বিষয় হলো ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্টের জন্য যে ধরনের হাসপাতাল বা যে ধরনের প্রিপারেশন দরকার যেমন ঘণ্টায় ঘণ্টায় ব্লাড প্রেসার মাপতে হবে। এখন কোনো পাবলিক হাসপাতালে ঘণ্টায় ঘণ্টায় ব্লাড প্রেসার মাপা যায়?
শুধুমাত্র আইসিইউ ছাড়া কোথাও ঘণ্টায় ঘণ্টায় ব্লাড প্রেসার মাপা, সার্বক্ষণিক যে জিনিসগুলো প্রয়োজন এগুলো আসলে সম্ভব না।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত মশাবাহিত এ রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে ৮৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর বলেছে, হাসপাতালে ভর্তির তিন দিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪৮ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। তিন থেকে ছয় দিনের মধ্যে ১৮ জন, ছয় থেকে নয় দিনের মধ্যে ছয়জন এবং নয় থেকে ৩০ দিনের মধ্যে তিনজন মারা গেছে।
এ সময় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৩ হাজার ৫৯২ জন। আক্রান্তের দিক থেকে যা গত দুই বছরের চেয়ে বেশি।
সর্বশেষ রবিবার (১৬অক্টোবর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে মারা গেছেন পাঁচ জন। একই সময়ে আক্রান্ত হয়েছেন ৮৫৫ জন।
আরএ/