বিশেষ সাক্ষাৎকারে মতিয়া চৌধুরী
বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ভেতো বাঙালি লড়াকু বাঙালিতে পরিণত হয়েছিল
মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস আজ ২৬শে মার্চ। বাঙালি জাতির জীবনে অনন্যসাধারণ একটি দিন। সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায় এই দিনটি। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্বাধিকারের দাবিতে জেগে ওঠা নিরীহ বাঙালির ওপর চালিয়েছিল নির্মম হত্যাযজ্ঞ। এরপর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তারের আগমুহূর্তে ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সেই দিনের সেই ঘোষণা কোথায় ছিলেন কী অবস্থায় ছিলেন তার স্মতিচারণ করেছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মতিয়া চৌধুরী। তিনি বলেন, সেদিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর আহ্বান বাঙালি অকাতরে জীবন দিয়েছে, ভেতো বাঙালি লড়াকু বাঙালিদের পরিণত হয়েছে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার শাহজাহান মোল্লা।
ঢাকাপ্রকাশ: ভয়াল সেই ২৫শে মার্চ আপনি কোথায় ছিলেন? তখনকার কোনো স্মৃতি কথা যদি বলেন।
মতিয়া চৌধুরী: ৭ই মার্চে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে সেখানে বঙ্গবন্ধুর যে আহ্বান এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। সেটাই আমাদের ভেতরে আমাদের যে দিকনির্দেশনা, এটা বঙ্গবন্ধু তরফ থেকে সেটা পরিষ্কার করে দিয়েছেন। কিন্তু একই সঙ্গে আলোচনা চলছিল এবং আলোচনায় ফলাফল কী হবে সেটা খুবই অনিশ্চিত ছিল বরং নেতিবাচকের দিকে যাবে সেটা প্রত্যেকটি বাঙালি জানতো। এই অবস্থায় ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার যে প্রক্রিয়া সেখানে বাঙালি তার প্রস্তুতি নিয়েছিল। আমি তখন থাকতাম সিদ্দিক বাজার। কিন্তু নানান কাজে তখন ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় থাকতাম। ২৫শে মার্চ রাতে আমি ছিলাম খিলগাঁও আমার খালার বাড়ি। তখন এত দালানকোঠা ওঠে নাই। খিলগাঁও রেলগেট থেকে রাজারবাগের কিছু অংশ সকাল বেলা দেখা যেত। তখন তো মানুষের পদচারণ এতটা ছিল না। বিশেষ করে রেললাইনের এখানে আসলে রাজারবাগ পুলিশ লাইন এটা একেবারে পরিষ্কার দেখা যেত। ওই রাতে যখন গুলি শুরু হয় রাজারবাগের পুলিশরা তারা বীরত্বপূর্ণভাবে তাদের থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে এটা প্রতিরোধের চেষ্টা করে এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা প্রতিরোধের সেই লড়াই চালিয়ে যায়। কিন্তু তারা তো (পাক সেনারা) এসেছে মেশিনগান, এসএমজি নিয়ে, সেই অবস্থায় এটা কতক্ষণ টিকতে পারে? ওই রাতেই আমি প্রথম ট্রেসার বুলেট দেখলাম। কীভাবে ম্যাগনেসিয়াম প্লেয়ার দিয়ে আকাশটা একদম ঝকঝকে পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছে। অন্ধকারের ভেতর লোকেশনগুলো খুঁজে বের করা। এগুলো পরে শুনেছি ।
তখন তো দেখেছি হঠাৎ আকাশ সকালের চাইতেও ফর্সা। অর্থাৎ লক্ষ্যবস্তুকে খোঁজার জন্য তারা এটা ব্যবহার করেছে। সারারাতই হত্যাযজ্ঞ চলে এবং ভোরের দিকে যখন তারা টিকতে পারেনি। ওদিক দিয়ে যেহেতু খোলা ছিল। রাজারবাগ থেকে লুঙ্গি পরা, গেঞ্জি গায়ে সিভিল ড্রেসে সব আসতে থাকে। সেই অবস্থায় অনেককেই আমরা তখন পানি খাওয়াই। কারণ সারারাত তারা লড়াই করে ক্লান্ত। তাছাড়া বহুদূর হেঁটে তারা আসছেন। কিন্তু আমি একবারও কাউকে বলতে শুনি নাই যে আমরা পারব না। তারা তাদের সঙ্গী-সাথী যারা ছিল যারা মারা গেছেন কিন্তু তারপরেও বলছে যে যাইয়া নিই, গ্রামে যাইয়া নিই দেখুম পাক বাহিনীদের, পশ্চিমাদের। ওইভাবে কথাটা বলতো। সেইদিন অনেক জায়গায় এই যে ক্রল করে হাঁটা বা এভাবে আগানো এটাও সেই রাত্রেই আমার প্রথম দেখা। মাঝে মধ্যে খিলগাঁও থেকে আগানোর চেষ্টা করেছি, দেখার চেষ্টা করেছি রিস্ক ছিল কিন্তু তবুও একদিকে আমাদের প্রতিরোধের যে স্পৃহা। সেই স্পৃহা আবার অন্যদিকে আমাদের সোলজারদের বিশেষ করে সেই পুলিশ ভাইয়েরা তারা যে লড়াই করতেছে সেটা দেখেছি। আমি একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী।
সেই রাতে তারা যেভাবে অকাতরে মারা গেছে, অকাতরে তারা জীবন দিয়েছে। এটা খুব স্বাভাবিক মেশিনগানের সামনে কতক্ষণ টিকে? আর এদের তো এদেশের সাপ্লাইয়ার ছিল, কিন্তু রাজারবাগে পুলিশের যা ছিল তা-ই ছিল, তাদের-তো সাপ্লাই ছিল না। ৭ই মার্চের পর থেকে খানসেনারা নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র আরও বাড়িয়ে নিয়েছিল। অন্যদিকে একটা গাড়ি সামনে পড়ে তাতে তারা একটু কাবু হয় এরপর পেছনের গাড়িটারে সামনে আসে। কিন্তু বাঙালি খালি হাতে সত্য কথা বলতে গেলে নিরস্ত্র বাঙালির সশস্ত্র করার যে একটা ভাব এটা ছিল রাজারবাগ পুলিশ ফাঁড়ির সেই ২৫শে মার্চের রাত থেকে ২৬শে মার্চ। সেদিন থেকেই নিরস্ত্র একজন আনসার সে একটা লাঠি নিয়ে প্যারেড করেছে। তারপর পুলিশ আসে তাও ডিউটি করে সে অস্ত্র জমা দিয়ে আসতে হয়। সেই অস্ত্র কিন্তু সে নিজে বহন করতে পারত না। পুলিশ যখন সে ছুটিতে যায় সে অস্ত্র জমা দিয়ে যেতে হতো। ওরা (পাকিস্তানিরা) ভাবছিল বাঙালিরা ৩ দিনে শেষ হয়ে যাবে। সেদিন খালি রাজারবাগ না, সেই রথখোলা বংশাল এ সমস্ত জায়গায় নারকীয় হত্যাকাণ্ড তারা করেছিল। বিভিন্ন জায়গায় যেভাবে টার্গেট করেছিল, ইউনিভার্সিটিতে তখনতো হলে থাকার মতো অবস্থা ছিল না। কিন্তু তারপরেও ওরা.. মোটকথা ইয়াহিয়া খান বলেছিল যে, ‘আদমি নেহি মান্তা’ মানে আমি মানুষ চাই না মাটি চাই। তবে মানুষ আছে, শেষ হয় নাই, মাটিও আমাদের আছে। এটি হলো ২৬শে মার্চের সেই ভয়াল স্মৃতির শিক্ষা। মাটিও আছে, মানুষ আছে শেষ হয় নাই।
ঢাকাপ্রকাশ: আপনারা কখন স্বাধীনতার যুদ্ধের বিষয়টা বুঝতে পারেন?
মতিয়া চৌধুরী: পাকিস্তানিরা তো যাবে না। নারী মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং এর ছবিটা দেখছেন। নারীরা ডামি রাইফেল নিয়ে প্যারেড করেছে। পাকিস্তানিরা তারা বেলুচিস্তানে ঈদের নামাজের জামাতে বোম্বিং করে নাই? ঈদের জামাতে বেলুচিস্তানে প্লেন থেকে বোম্বিং করা হয়। যুদ্ধ বিমান থেকে বোম্বিং করা হয়। এটা-তো ইতিহাস, লিপিবদ্ধ আছে, ডকুমেন্টারি। বঙ্গবন্ধু এইজন্য ১০ জানুয়ারিতে বলেছিলেন ভুট্টো সাহেব আপনারা সুখে থাকেন। তার ভাষণে কিন্তু এই কথাটা ছিল। পাকিস্তান নামের যে মোহ সৃষ্টি হয়েছিল সেই মোহ বাঙালির পুরা হয়নি।
ঢাকাপ্রকাশ: বঙ্গবন্ধু যখন গ্রেপ্তার হয় তখন আপনাদের মধ্যে কোন চিন্তার ভাঁজ পড়ে ছিল কিনা?
মতিয়া চৌধুরী: বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হয়ে বাঙালি লড়াইয়ের আন্দোলন-সংগ্রামের বিজয়ী হয়ে আমাদের ভেতরে আসতেন। তিনি তো বলেছিলেন আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, হুকুম তো তিনি এটা দিয়িই দিয়ে গেলেন। কাজেই হুকুম দেওয়ার জন্য মুখে বলার সময় টুকু যদি নাও পান কিন্তু তাঁর আহ্বানটা তো সেই নির্দেশনাতেই দিয়ে গেলেন। হুকুম দেবার নাও পারি তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। আর কীভাবে বোঝাবেন। এত সহজে তিনি কথা বলেছেন। এটা বুঝতে আর কারো কোন সমস্যা হওয়ার কথা না।
ঢাকাপ্রকাশ: স্বাধীনতাবিরোধীরা অনেকেই বলে বঙ্গবন্ধু আত্মসমর্পণ করেছিলেন, এবিষয়ে কী বলবেন?
মতিয়া চৌধুরী: হ্যাঁ। কিন্তু তাদের কারও তো.. তাদের কি কেউ এভাবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পড়েছিল? তাদেরকে কেউ এভাবে.. সে রাত্রের কথা চিন্তা করেন, বেগম মুজিবের কথা? সে রাত্রে চিন্তা করেন শেখ হাসিনা, রেহেনা এদের কথা, কী অবস্থা। এই অবস্থার ভেতরে যদি তিনি কি ইয়ে করতেন তাহলে তো তারা অনেক খাতির তোয়াস করত। এগুলি অক্ষমের আস্ফলন। এটা নিয়ে কথা না বলাই ভালো। অক্ষমের আস্ফলন নিয়ে কথা না বলাই ভালো।
ঢাকাপ্রকাশ: মুক্তিযুদ্ধের সময় বাম জোটের যারা ছিলেন তাদের প্রশিক্ষণ নিতে কোনো জটিলতা তৈরি হয়েছিল কি-না?
মতিয়া চৌধুরী: প্রশিক্ষণ। যখন আমরা ভারতে গেলাম তখন আরকি, তখনতো আলাদাভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছিল। ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, কৃষক শ্রমিক লীগ, ছাত্র ইউনিয়ন। কেন মহাবুবের ছবি দেখেন নাই ডাকসুতে? ব্যবস্থা যদি না হয় তাহলে রাইফেলটা এলো কোত্থেকে তার হাতে? আসলে যারা কিছু পারে না তারাই এ সমস্ত ছোট চিন্তা করে। মহৎ জিনিসকে খাটো করে দেখে। সবার অবদান কেউ অস্বীকার করবে না। আর অস্বীকার করলেই বা কি হবে সেটা ইতিহাসে থাকবে। সূর্যটা কে? কা-রে কেন্দ্র করে বাঙালি জেগেছিল? ৬ দফা কে দিয়েছিল? ৬ দফা তো বঙ্গবন্ধু দিয়েছিল, অন্য কেউ তো দেন নাই। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের সময় ফাঁসির মঞ্চে, আগরতলাতে তাঁর ফাঁসি দিতে পারতো। যারা এটা বলেন, ইয়াহিয়ার ভাষণটা দেখেন, সেদিন কী বলেছিল ইয়াহিয়া, মুজিব উইল নট গো অন পানিস্ট। সেখানে তো আর কোন নেতার নাম বলে নাই? দিস টাইম মুজিব উইল নট গো অন পানিস্ট। কেন্দ্রবিন্দু একজন তিনি হলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর আহ্বানে বাঙালি অকাতরে জীবন দিয়েছে। ভেতো বাঙালি লড়াকু বাঙালিতে পরিণত হয়েছে।
ঢাকাপ্রকাশ: যে লক্ষ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছিলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে?
মতিয়া চৌধুরী: সব পেয়েছির দেশে আমরা আছি সেটা আমি বলব না, কিন্তু দু ‘বেলা দু’মুঠো ভাত, মাথা গোঁজার ঠাঁই পরনে কাপড় এবং শিক্ষাব্যবস্থাটা প্রধানমন্ত্রী নিশ্চিত করেছেন। দেখুনতো পৃথিবীতে কয়টা দেশ বছরের প্রথমে নতুন বইয়ের গন্ধ শুকতে পারে। আসলে শেখ হাসিনা যা করেন আমাদের কাছে, অনেকের কাছেই মূল্যবান। কিন্তু অনেকের কাছে সেটা মনে হয় এটা কি? কিছুই না। তা মূল্যহীন। কিন্তু যারা বাইরে থেকে দেখে তারা বোঝেন। আসলে মানুষ সুখ পেলে দুঃখের দিন ভুলে যায়। শেখ হাসিনা সুখের দিনগুলি দিচ্ছেন, ফলে আমরা দুঃখের দিন ভুলে যাচ্ছি।
এসএম/