নিষিদ্ধ হওয়ার পরও অনেকটা প্রকাশ্যেই জঙ্গি হিযবুত তাহরীর
দেশের শীর্ষ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও ঢাকা মেডিকেল কলেজকে কেন্দ্র করে নতুন প্রচারণায় নেমেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীর। ডেকেছে অনলাইন সম্মেলন। তথ্য মতে, শুক্রবারের (১৮ মার্চ) অনলাইন সম্মেলনকে ঘিরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বুয়েট আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্টারিং করেছে হিযবুত তাহরীর।
দেখা গেছে, রাজধানী জুড়ে লিফলেট সাঁটিয়েছে এ জঙ্গি সংগঠন। ঢাকা নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা জুড়ে হাজার হাজার পোস্টার। তারা অনলাইনে সম্মেলনের ডাক দেওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সরব হলে ঘাপটি মারে নিষিদ্ধ এই সংগঠনটি। হটাৎ আবারও রাজধানী জুড়ে পোস্টার সাঁটানোর নমুনা দেখা গেছে। যা নিয়ে নড়েচড়ে বসেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, মাঝে মধ্যে অনলাইনে তাদের কিছু কর্মকান্ড চোখে পড়ে আবার মাঝে মাঝে পোস্টারও সাঁটায়। তবে এ সংগঠন গভীর নজরদারিতে রয়েছে। নিষিদ্ধ এ সংগঠনের তেমন সাংগঠনিক শক্তিও নেই।
একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, রাজধানীর শাহবাগ, মোহাম্মদপুর, পান্থপথ, ধানমন্ডি, রমনা, কাওরান বাজার, বাড্ডা, উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকায় ঝুলছে শত শত পোস্টার। পোস্টারগুলোতে যথারিতি খেলাফত আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছে।
রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার সাজ্জাদ হোসেন জানিয়েছেন বলেন, গভীর রাতে এ পোস্টারগুলো লাগানো হয়েছে। যেসকল এলাকাতে পুলিশ ডিউটি ছিল না সে এলাকাগুলোতে সুযোগ বুঝে লাগিয়েছে তারা।
এদিকে অনলাইন অ্যাকটিভিস্টরা বলছেন, অনলাইনে যেভাবে জঙ্গিরা কার্যক্রম পরিচালনা করছে তাতে করে নজরদারী আরো বাড়ানো প্রয়োজন। এরা ওইভাবে প্রকাশ্যে আসতে পারেনা কিন্তু নাশকতা করতে অনলাইন প্লাটফরমই বেছে নেয় তারা। তারা বলেন, ঘটনার পর প্রতিকারের চাইতে আগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ।
বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ফোরামের (বোয়াফ) সভাপতি কবীর চৌধুরী তন্ময় বলেন, আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এ বিষয়ে কয়েকবার বলেছি। অনলাইনে জঙ্গিরা ক্রমেই সংগঠিত হচ্ছে।
এদিকে, গত ৩ ডিসেম্বর অনলাইনে সম্মেলন করে হিযবুত তাহরীর। তবে ওই সময় পুলিশ কাউকেও আটক করতে পারেনি। ফেসবুকে ‘স্ট্যান্ড ফর খলিফা’ নামক পেজ থেকে এর প্রচার প্রচারণা চালানো হয়। সম্মেলনে ‘পশ্চিমাদের নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার পতন ঘণ্টা’ নামে শিরোনাম দিয়েছিল নিষিদ্ধ এ সংগঠন।
তবে, গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠার চেষ্টা করছে নিষিদ্ধ এ জঙ্গি সংগঠনটি। প্রকাশ্যে না আসতে পারলেও মাঝে মধ্যে অনলাইন ও পোস্টারিং করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার চেষ্টা করছে।
ফের চাঙ্গা হচ্ছে হিযবুত তাহরীর
র্যাব পুলিশের গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যেও মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা সক্রিয় থেকে কর্মী সংগ্রহ ও প্রকাশ্যে লিফলেট বিতরণ করছে বাংলাদেশের নিষিদ্ধ এই সংগঠনটি। শীর্ষ নেতারা কারাবন্দি থাকলেও মাঠে থাকা কর্মীরা সংগঠনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। র্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক সূত্র বলেছে, হিযবুত তাহরীর সব সময়ই তাদের নজরদারিতে থাকে। তবে এর মধ্যেও গোপনে তাদের কিছু কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে বলে তাদের কাছে খবর আছে।
যেসব এলাকায় তাদের ঘাঁটি
জানা যায়, রাজধানীর উত্তরা, আজমপুর, খিলক্ষেত, বাড্ডা, এয়ারপোর্ট, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, রমনা এলাকায় বর্তমানে হিযবুত তাহরীরের বেশি কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে। এই সকল এলাকায় বিশেষ করে শুক্রবার জুম’আর নামাযের পর হিযবুত তাহরীর কর্মীরা ওই এলাকার বিভিন্ন মসজিদে লিফলেট বিতরণ করে। কখনো তারা নিজেরা আবার কখনো ভাড়া করা লোক দিয়ে এই লিফলেট বিতরণ করে।
রাজধানীর উত্তরা, আজমপুর, খিলক্ষেত, বনানী, গুলশান-১, গুলশান-২, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, তুরাগ উত্তরখান, শ্যামপুর, মিরপুর, খিলক্ষেত, দক্ষিণখান, আশুলিয়া, আবদুল্লাহপুর, নামাপাড়া, নিকুঞ্জ, মোল্লারটেক, ও কামারপাড়া এলাকায় পোস্টার চোখে পড়েছে। ওই সকল এলাকায় হিযবুত তাহরীরের কর্মীদের শক্ত অবস্থানও রয়েছে বলে জানা গেছে।
যা বলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা
এ বিষয়ে সিটিটিসির উপ-পুলিশ কমিশনার আব্দুল মান্নান বলেন, নিষিদ্ধ সব সংগঠনই গোয়েন্দা পুলিশের নজরদারিতে থাকে। সেক্ষেত্রে হিযবুত তাহরীর ও জেএমবিও রয়েছে।
তিনি বলেন, এই সংগঠন দুটির কার্যক্রম অমাদের নজরদারির মধ্যে থাকে। যখনই এরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে তখনই গ্রেপ্তার করা হয়।
তবে এই মূহুর্তে তাদের সাংগঠনিক অবস্থা কি এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, যেহেতু তারা নজরদারির মধ্যে রয়েছে সেহেতু তাদের নাশকতা বা রাষ্ট্রের জন্য হুমকি স্বরূপ কোন কিছু করার মত শক্তি তাদের নেই। তারপরও আমরা এই বিষয়গুলো দেখছি।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন জানান, হিযবুত তাহরীরের কর্মকান্ড তারা নজরদারিতে রেখেছেন। বর্তমান সময়ে লিফলেট, পোস্টার সাঁটানোর খবর তারা পেয়েছে। এ বিষয়ে র্যাব কাজ করছে। তিনি আরও জানান, হিজবুত তাহরীর এখন যারা কর্মকান্ড পরিচালনা করছে তাদেরকে গ্রেপ্তারে র্যাবের বিশেষ টিমও কাজ করছে।
২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মাথাচাড়া দেয় হিযবুত তাহরীর
তথ্য মতে, ২০০৭ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত সময়ে দেশের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মাথা চাড়া দেয় হিযবুত তাহরীর। পরবর্তীতে সরকার বিরোধী নানা কর্মকান্ডের কারণে ২০০৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এ সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। গ্রেপ্তার করা হয় হিযবুত তাহরীরের শীর্ষ নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মহিউদ্দীন ছাড়াও আরো বেশ কয়েকজনকে। কিন্তু তারপরও থেমে থাকেনি এদের কার্যক্রম।
রাজধানী ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে পোস্টার, লিফলেট ছড়ানো থেকে শুরু করে প্রকাশ্য মিছিল পর্যন্ত এরা করে থাকে। শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা তাদের নানা পরিকল্পনা এদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে থাকে।
নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীর ডেকেছে অনলাইন সম্মেলন
রাজধানীর শাহবাগের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল পুলিশ বক্স। সেই পুলিশ বক্সের চারদিকে একশ গজের মধ্যেই নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের শ-খানেক পোস্টার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এখানে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করলেও যেন পুলিশের চোখে পড়েনি। তবে পুলিশ বলছে, এ ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠনের প্রচারণার বিভিন্ন কৌশল রয়েছে তা রোধে তারা কাজ করছে।
শুক্রবার (১৮ মার্চ) অনলাইন সম্মেলনকে ঘিরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বুয়েট আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্টারিং করেছে হিযবুত তাহরীর। তবে, এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বুয়েট কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছেন, আমরা সচেতন রয়েছি। বিচ্ছিন্ন প্রচারণা চালালেও ক্যাম্পাসে কোনো প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীকে কার্যক্রম চালাতে দেওয়া হবে না।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ড. আব্দুর রহিম বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অন্ধকারের শক্তির বিরুদ্ধে সদা জাগ্রত। এ কারণে ক্যাম্পাসে কোনো অন্ধকারের শক্তি আসতে সাহস পায় না।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষক সালাউদ্দিন সেলিম বলেন, বারবার লাইভ সম্প্রচারের প্ল্যাটফর্ম ও ইউআরএল পরিবর্তনের কারণে অনলাইনে জঙ্গিবাদী তৎপরতা বন্ধ করা যাচ্ছে না।
জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার ফারুক হোসেন বলেন, বড় নাশকতার সক্ষমতা হারিয়েছে হিযবুত তাহরীর। তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। ২০০৯ সালে দেশে হিযবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে তাদের বিভিন্ন কার্যক্রম আমাদের নজরে রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে পোস্টার লাগানো বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, ‘এরা আসলে দিনের আলোয় আসতে পারে না, এজন্য রাতের আঁধারে চোরাপথে এসব কাজ করে থাকে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সবসময় সজাগ রয়েছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, নিষিদ্ধের এক যুগ পেরিয়ে গেলেও হিযবুত তাহরীরের দৃশ্যমান কর্মকাণ্ড নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। আর পুলিশ বলছে, প্রচারণা থাকলেও বড় নাশকতার সক্ষমতা নেই জঙ্গি সংগঠনটির।
কেএম/এএস