মিরপুরে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত লাগামহীন
রাজধানীতে বেপরোয়া ৭৮টি কিশোর গ্যাংয়ের সক্রিয় সদস্য রয়েছে। তারা সংঘবদ্ধ একটি চক্র। এদের সংখ্যা প্রায় দুই হাজারের বেশি। পুলিশ বলছে, প্রতিদিন অসংখ্য কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য আটক হচ্ছে। তারপরও দিনদিন এর সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করছেন তারা। পাড়া মহল্লায় কিশোর গ্যাং সামাল দিতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ।
এদিকে কিশোর অপরাধ ঠেকাতে বিশেষ অভিযান পরিচালনা হলেও তাতে তেমন কোনো কাজ হচ্ছে না। কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) দফায় দফায় আলোচনা করেছে। কিন্তু কিছুতেই তা নিয়ন্ত্রেণের মধ্যে নেই। এ গ্যাংয়ের আক্রমণের শিকার হচ্ছেন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ। শুধু আক্রমণ নয় খুনের ঘটনাও ঘটছে। এদের দ্বারা গত ২১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পল্লবীতে হত্যার শিকার হন গার্মেন্টসকর্মী রায়হান ওরফে রাজ।
পুলিশ জানায়, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সারা রাজধানীতে ৭৮টি কিশোর গ্যাংয়ের গ্রুপ শনাক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি তাদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে যারা রয়েছে তাদের ও চিহ্নিত করা হয়েছে। এ বিষয়ে জোরালো পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
পুলিশের তালিকা অনুযায়ী রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং রয়েছে মিরপুর এলাকায়। আর সবচেয়ে কম গুলশানে। এ ছাড়া তেজগাঁও বিভাগে যথাক্রমে ১৪টি, মিরপুরে ২৩টি, উত্তরায় ১১টি, গুলশানে ১টি, ওয়ারীতে ৬টি, মতিঝিলে ১১টি, রমনায় ৮টি ও লালবাগে ৪টি গ্রুপকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
সাম্প্রতি সময়ে এ গ্যাংয়ের সদস্যদের পৃষ্ঠপোষক বা রাজনৈতিক গডফাদারদের নামও তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। পুলিশের তালিকায় কিশোর গ্যাংয়ের রাজনৈতিক শেল্টারদাতা বা পৃষ্ঠপোষক হিসেবে অর্ধশত ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে।
কেউ কেউ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে সুবিধার জন্য সরকারি দলের সাইনবোর্ড সর্বস্ব পদ-পদবিও নিয়েছেন। তালিকায় নাম আছে এমন নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- শিল্পাঞ্চল থানা ছাত্রলীগের সভাপতি জিল্লুর রহমান ওরফে জীবন, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর তালুকদার সারোয়ার হোসেন, মোহাম্মদপুর এলাকার চন্দ্রিমা হাউজিং ও সিলিকন হাউজিংয়ের মালিক ছারোয়ার ও নাজিব আমজাদ এবং গ্রামবাংলা হাউজিংয়ের মালিক কবির, ড্রিমল্যান্ড হাউজিংয়ের মালিক সাদিকুর রহমান ওরফে বকুল, শেরেবাংলা নগর থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আসাদুজ্জামান ওরফে আসাদ। আদাবর এলাকার ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল কাশেম, ১০০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি পাপ্পু প্রমুখ।
জানা যায়, কিশোর আইন হালনাগাদ হচ্ছে। ওই আইন বলছে, একজন ব্যক্তি ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু হিসেবে গণ্য হয়। কিন্তু বর্তমানে দেশে আইন চেঞ্জ করার কারণে যেটা হয়েছে, তাতে ১৮ বছরের যে যুবকে পরিণত হয়েছে তাকেও শিশু হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। ফলে কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়াটা কঠিন হয়ে পড়েছে।
সাধারণ মানুষ একটু সচেতন হলে এ ধরনের অপরাধ কমে আসবে বলে মনে করেন শৃঙ্খলা-বাহিনীর সদস্যরা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, কিশোরদের যদি পারিবারিকভাবে সচেতন করা যায় এবং বিভিন্ন আইন সম্পর্কে যদি তাদের পড়াশোনা করানো যায় তাহলে, হয়তো এমন অপরাধ থেকে তারা ফিরে আসবে।
এ বিষয়ে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মুক্তা ধর বলেন, কিশোর গ্যাং এর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের তালিকা ধরে আমরা কাজ করছি। এর পেছনে যারা রয়েছে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আমরা সবাই সমন্বয়ভাবে কাজ করছি।
পুলিশ বলছে, কিশোর গ্যাংয়ের অদ্ভুত সব নামের কী মর্মার্থ তা অনেকেরই জানা নেই। তবে নামের ধরন দেখে তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে যে কারও নেতিবাচক ধারণা তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লিডারের নামে গ্রুপের নামকরণ হয়ে থাকে। ইভটিজিং, মারধর, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ছাড়াও মাদক ব্যবসা, ছিনতাই এমনকি খুনের মতো অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে কিশোর গ্যাং। তাদের উৎপাত আর অপরাধ কর্মকাণ্ড দিন দিন বাড়ছে। অনেক এলাকায় কিশোর গ্যাং সামাল দিতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ।
রাজধানীতে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, উঠতি বয়সি ছেলেরা নানাবিধ অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। ছোটখাটো ছিনতাই থেকে শুরু করে মাদক সেবন, মেয়েদের টিজ করা এমনকি নিজেদের মহল্লায় জুনিয়র-সিনিয়র সংঘাতের কারণে অল্প বয়সে খুন পর্যন্ত করছে তারা। সম্প্রতি এটা আরও বেশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তাই আমরা তালিকা তৈরি করে ব্যবস্থা নিচ্ছি।
জানতে চাইলে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান (র্যাব) মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, গ্যাং কালচার থেকে কিশোরদের মুক্ত করতে হবে। এমন অপরাধীদের খুঁজে বের করে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তিনি বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকদের ছাড় দেওয়া হবে না।
এ বিষেয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বলেছেন, কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নতুনভাবে ভাবা হয়েছে। পুলিশপ্রধান বলেছেন, গত তিন বছর ধরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রেক্ষাপটে কিশোর গ্যাং একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। সংসদে নতুন নতুন আইন প্রণয়ন হচ্ছে। আদালতও অনেক নির্দেশনা দিয়েছে। বর্তমানে আইন অনুযায়ী, কিশোর অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। তাদের সংশোধনাগারে পাঠাতে হবে। সংশোধনাগারের সংখ্যাও কম। ফলে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তবুও আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। আশা করছি, এটিও নিয়ন্ত্রণে আসবে।
অভিভাবকদের উদ্দেশে পুলিশ বলছে, সন্তানের জন্য বাবা-মায়েরও দায়িত্ব রয়েছে। তারা কী করে, কোথায় যায়, কার সঙ্গে মেশে- এগুলো দেখা প্রতিটি পরিবারের দায়িত্ব। পারিবারিকভাবে সবাই সচেতন হলে এসব অপরাধ অরেক কমে আসবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, করোনাকালে কিশোর গ্যাংয়ের বেশি বিস্তার ঘটেছে। এর পেছনে পাতি নেতা থেকে শুরু করে স্থানীয় অনেক নেতা-কর্মীরা জড়িত রয়েছে। যার কারণে স্কুল-কলেজ বিভিন্ন সময় বন্ধ থাকায় কিশোররা না বুঝে এমন ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।
তিনি বলেন, যার কারণে রাজধানীতে বেড়েছে চুরি ছিনতাই। সারাদেশে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। ঘটছে বড় বড় অপরাধ। এসব অপরাধ দমনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি সবাইকে সচেতন হতে হবে।
তৌহিদুল হক বলেন, কিশোর অপরাধ দমন করতে হলে পরিবার ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে সচেতন হতে হবে এবং এ ধরনের অপরাধের শিকার হলে সঙ্গে সঙ্গে আইনে সহায়তা নিতে হবে তাহলেই এসব অপরাধ কমে আসবে।
কেএম/টিটি