২ শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় 'নাপা' কিনতে রাজধানীবাসীর ভয়
‘নাপা সিরাপ’ খেয়ে ২ শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় সারাদেশ থেকে নির্ধারিত ব্যাচের (ব্যাচ নং-৩২১১৩১২১) নাপা সিরাপের নমুনা সংগ্রহের নির্দেশ দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এরপর থেকে বহুল প্রচলিত এই ওষুধটি কিনতে ভয় পাচ্ছেন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার মানুষ। ইতোমধ্যে তারা নাপার বিকল্প খুঁজছেন।
রবিবার (১৩ মার্চ) রাজধানীর বিভিন্ন ফার্মেসি ঘুরে এসব চিত্র ছিল চোখে পড়ার মত। তবে দেখা গেছে বেশিরভাগ মানুষ নাপা ওষুধের বিকল্প হিসেবে অন্যান্য গ্রুপের ওষুধ খুঁজছে।
আজিমপুর বটতলা সারোয়ার ফার্মেসিতে ওষুধ নিতে এসেছেন আলাউদ্দিন মিয়া তিনি বলেন, আমার মেয়েটার শরীরে ছোট গোটা জাতীয় কি জানি উঠেছে ব্যথা হয়েছে এবং সেইসঙ্গে জ্বর। সাধারণত জ্বর হলে নাপা ওষুধ খাওয়াই। এখন নাপা খেয়ে দু'জন মারা গেছে তাই নাপা ওষুধ খাওয়াতে ভয় পাচ্ছি।
আজিমপুর ইউনিক ফার্মেসির মালিক জব্বার হোসেনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, নাপা ওষুধ বিক্রি বা ব্যাচের ওষুধ বিক্রি করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেটি আমাদের এলাকায় নাই। তবে আজ অনেক ক্রেতা নাপা ওষুধ না নিয়ে এইস প্লাস বা অন্যান্য গ্রুপের ওষুধ বেশি ব্যবহার করছেন।
আজিমপুরের হারবাল ফার্মেসির মালিক বেলাল রহমান বলেন, অনেকে এখন নাপা সিরাপ কিনতে ভয় পাচ্ছে। তারা নাপার বিকল্প ওষুধ খুঁজছে।
আজিমপুর মেটারনিটি হাসপাতালের বিপরীতে আল্লাহর দান ফার্মেসির মালিক গোলাম রাব্বি বলেন, নাপা সিরাপের পরিবর্তে অনেকে নাপা ওষুধ কিনে নিয়ে যাচ্ছে। আমি কয়েকজন কাস্টমারের সঙ্গে কথা বলেছি তারা বলছেন, ছোট বাচ্চাকে নাপা ট্যাবলেট পানির মধ্যে মিশিয়ে খাওয়াবো কিন্তু নাপা সিরাপ খাওয়াবো না। নাপা সিরাপ খেয়ে দুজন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এ জন্য সিরাপ এর পরিবর্তে সে ট্যাবলেট খাওয়াবে।
বাংলামোটর বিয়াম গলিতে রাজন ফার্মেসির বিক্রেতা মোহন বলেন, অনেকে মনে করছেন নাপা সিরাপ খেলে তাদের বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে এজন্য তারা বিকল্প ওষুধ খুঁজছে।
তেজগাঁও তেজকুনিপাড়ার মেডিসিন কর্নারের বিক্রেতা সোহেল বলেন, আজকে নাপা ওষুধের চাহিদা একেবারেই কম। অনেকে এই ওষুধটি নিতে এখন ভয় পাচ্ছে।
সাতরাস্তা মোড়ে স্বপন ফার্মেসির বিক্রেতা জাহিদ মিয়া বলেন, আজ সারাদিনে একটি ও নাপা ওষুধ বা সিরাপ কোনোটাই বিক্রি হয় নি। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নাপা সিরাপ’ খেয়ে ২ শিশুর মৃত্যুর ঘটনা জানাজানি হওয়াতে এমন হয়েছে।
এদিকে কথা হয় মহাখালী এলাকার শাপলা ফার্মেসির মালিক রফিকুল ইসলামের সঙ্গে তিনি বলেন, যেকোনো নাপা ওষুধ নিতে সাধারণ মানুষ ভয় পাচ্ছে।
কড়াইল এলাকার কাজী ফার্মেসির মালিক রিপন হোসেন জানান, নাপা ওষুধ খেয়ে দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে কেউ নাপা ওষুধ কিনতে চাচ্ছে না। সবাই ভয় পাচ্ছে।
কথা হয় মালিবাগ লাজ ফার্মার বিক্রেতা ফয়সাল আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের এখান থেকে অনেকে এখন নাপা সিরাপ কিনতে চাচ্ছে না। নাপার বিকল্প ওষুধ আছে কিনা জানতে চাচ্ছে অনেকে।
মহাখালী টিভি গেটে রাহাত ফার্মেসির প্রোপ্রাইটার ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘নাপা সিরাপ’ খেয়ে ২ শিশুর মৃত্যুর খবরে আজ নাপা ওষুধের কোনো চাহিদা নেই। তিনি বলেন, নাপার ব্যাচ নং-৩২১১৩১২১ সিরাপের নমুনা সংগ্রহের নির্দেশ দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এরপর থেকে এই ওষুধ কিনতে মানুষ ভয় পাচ্ছে।
মিরপুরের ফয়সাল নামের এক ওষুধ ক্রেতা বলেন, আমার মেয়েটার দুদিন ধরে জ্বর। শুনেছি নাপা খেয়ে দুজনে শিশু মারা গেছে এজন্য বাসা থেকে বলছে নাপা সিরাপ না নিতে।
মহাখালীতে ওষুধ ক্রেতা রবিন হোসেন বলেন, নাপা সিরাপের পরিবর্তে নাপা ট্যাবলেট নিয়েছি।
রাজধানীর কাজী পাড়ায় কথা হয় রাজধানী ফার্নিচারের মালিক আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার ছেলের বয়স ৮ বছর। ৩ তিন দিন ধরে জ্বর। নাপা ওষুধ খেয়েছে কিন্তু জ্বর কমছে না এজন্য ডাক্তারের কাছে এনছি। আর আজ শুনতে পেলাম নাপা খেয়ে দুজন মারা গেছে।
জানতে চাইলে ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটালের চিকিৎসক প্রফেসর আব্দুল মালেক বলেন, আজ সারাদিনে অনেক রোগী দেখেছি সেই সঙ্গে বেশ কয়েকজন শিশু রোগী ছিল। তারা শরীরে জ্বর নিয়ে এসেছে। আমি সন্ধ্যায় তাদের জ্বর কমাতে নাপা ওষুধ দিতে চেয়েছি কিন্তু শিশুদের পরিবারের সদস্যরা বললেন নাপা সিরাপ খেয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তাই ওই ওষুধটি পরিবর্তন করে দিতে অনুরোধ করেন তারা।
তিনি বলেন, হয়তো যেকোনো ভাবে শিশু দুটির মৃত্যু হয়েছে। তবে এ বিষয়ে মানুষ একটু সচেতন হলে এসব ঝামেলা থেকে রেহাই পেতে পারেন।
এদিকে কারও কাছে নাপা (ব্যাচ নং-৩২১১৩১২১) সিরাপ ও ট্যাবলেট থাকলে দ্রুত নিকটস্থ কেমিস্ট অফিসকে অবহিত করতে এবং তা বিক্রি থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক আইয়ুব হোসেন এ নির্দেশনা দেন।
এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, নাপা বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ওষুধ। নাপা সিরাপের ব্যাচ-৩২১১৩১২১ সম্বলিত ওষুধ কারও কাছে থাকলে দ্রুত নিকটস্থ কেমিস্ট অফিসকে জানাতে হবে এবং তা বিক্রি থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করছি।
তিনি বলেন, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সব বিভাগীয় এবং জেলা কার্যালয়ে কর্মরত কর্মকর্তাদের স্ব স্ব নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় অবস্থিত পাইকারি ও খুচরা ফার্মেসি পরিদর্শন করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, দুই শিশুর মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে ইতোমধ্যে অনুসন্ধানে নেমেছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। শনিবার (১২ মার্চ) সরকারি ছুটির দিনে মহাপরিচালকসহ সব পরিচালককে নিয়ে দিনব্যাপী নানা আলোচনা-পর্যালোচনা শেষে ঘটনার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করতে আলাদা দুটি টিম গঠন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর জানিয়েছে, অনুসন্ধানী একটি টিম যাবে ঘটনাস্থল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে আর অপর টিম যাবে নাপা সিরাপের মূল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসে।
কেএম/এএস