‘ঢাকাই মসলিন’ ফিরছে স্বরূপে
রাজধানীর ফার্মগেট থেকে সুলতানা কামাল সেতুর দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার। সেতু থেকে নেমে বাম দিকে শীতলক্ষ্যা নদীর তীর ধরে প্রায় ৩০০ গজ সামনে এগোলেই দেখা মিলবে বিজেএমসি’র বন্ধ জুটো ফাইবার গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজের। এখন যেটি নাম পরিবর্তন করে রূপ নিয়েছে ‘ঢাকাই মসলিন হাউস’-এ।
একেবারে শীতলক্ষ্যা নদীর তীর ঘেঁষে বিজেএমসি’র ২ দশমিক ৮৫৪৬ একর জমির উপর বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়েছে ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই মসলিনের এই কারখানা। যেটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের কথা রয়েছে।
যেভাবে ঢাকাই মসলিনকে পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ
২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সচিবালয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে যান। ওই সময়ে প্রধানমন্ত্রী প্রায় নিয়মিতই বিভিন্ন মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে যেতেন। এরই ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ১২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করেন। ওই দিন তিনি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সবাইকে ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই মসলিন তৈরির প্রযুক্তি পুনরুদ্ধারের নির্দেশ দেন।
এরপর মসলিন পুনরুদ্ধারে ২০১৮ সালে ১২ কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রীর ওই নির্দেশনার পর শুরু হয় ঢাকাই মসলিন তৈরির প্রযুক্তি পুনুরুদ্ধারের তোড়জোড়। বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যানকে আহবায়ক করে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড, বিটিএমসি, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠন করা হয় বিশেষজ্ঞ কমিটি।
এর পরপরই সারাদেশে ‘ফুটি কার্পাস’ জাতের তুলার অনুসন্ধান শুরু করে গবেষক দল। গাজীপুরের কাপাসিয়া, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বাগেরহাট সদর, লালমনিরহাটের মোঘলহাট, নীলফামারীর ডিমলা, রাজশাহী, নওগাঁর মান্দা এবং তুলা উন্নয়ন বোর্ডের রংপুর জার্মপ্লাজম সেন্টারে ‘ফুটি কার্পাস’ জাতের তুলার সন্ধান চালিয়ে এসব স্থান থেকে প্রয়োজনীয় ৩৯টি নমুনা তুলা ও জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করে চাষাবাদ করা হয়। এই ৩৯টি নমুনা থেকে ৬টি জাত সনাক্ত করা হয়।
এরপর বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্যদের চেষ্টায় বিভিন্ন উৎস হতে চারটি মসলিন কাপড়ের সংগৃহিত নমুনা সুতা এবং ছয়টি জাতের ডিএনএ সিকুয়েন্স বের করা হয়। এরমধ্যে ‘ফুটি কার্পাস’ এর ডিএনএ সিকুয়েন্সের সঙ্গে মসলিন কাপড়ের সুতার ডিএনএ পর্যালোচনা করে মিল পাওয়া যায়।
তারপর সনাক্তকৃত ফুটি কার্পাস জাতের তুলা পরীক্ষামূলকভাবে চাষাবাদ শুরু হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের গবেষণা মাঠ, তুলা উন্নয়ন বোর্ডের শ্রীপুর খামার এবং বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের নরসিংদীর পলাশে।
চলছে সুতা উৎপাদন
ফুটি কার্পাস জাতের তুলা চাষ করে সেই তুলা থেকে এখন পুরোদমে চলছে সুতা তৈরির কাজ। শীতলক্ষ্যার পাড়ে বিজেএমসি’র যে জমিতে ‘ঢাকাই মসলিন হাউস’ গড়ে তোলা হয়েছে সেখানে ছায়াঘেরা নিবিড় পরিবেশে নারী শ্রমিকরা একমনে সুতা তৈরি করছেন।
কঠিন এবং কঠোর পরিশ্রমের এই কাজ করতে ৩০০ নারীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এই নারীদের একটা অংশকে সংগ্রহ করা হয়েছে কুমিল্লার চান্দিনা ও দেবীদ্বার উপজেলা থেকে। আর কিছু স্থানীয় রূপগঞ্জ, তারাবো, নারায়ণগঞ্জ এলাকার।
এসব প্রশিক্ষিত নারীরা মসলিন হাউসের বিশাল শেডের নিচে একটি কক্ষে বিশেষ এক ধরনের চরকা দিয়ে হাতের সাহায্যে মসলিনের সুতা তৈরি করছেন। এজন্য তাদের গভীর মনোযোগ দিতে হয়। একটু অন্যমনস্ক হলেই ছেদ পড়ে সুতা তৈরির কাজে। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চলে তাদের এই সুতা তৈরির কাজ।
মসলিন শাড়ি তৈরি হচ্ছে যেভাবে
‘ঢাকাই মসলিন হাউস’-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন না হলেও, এমনকি মসলিন হাউসের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাদের কাজের বিল না পেলেও ইতিমধ্যে মসলিন শাড়ি তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেছে পূর্ণ উদ্যোমে।
গত ২ মার্চ শীতলক্ষ্যা তীরের তারবোতে বিজেএমসি’র জমিতে গড়ে উঠা ঢাকাই মসলিন হাউস সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ‘মলমল খাস স্পিনিং ও উইনিং শেড’-এর ভেতর একটা বড় অংশ জুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে ২০টি তাঁত। এর মধ্যে ১১টি তাঁত ইতিমধ্যে চালু হয়ে গেছে। একটি তাঁতে একসঙ্গে দুজন তাঁতি কাজ করতে পারেন। অর্থাৎ একটি মসলিন শাড়ি তৈরি করতে দুজন তাঁতি লাগে।
সরেজমিন দেখা গেল, ১১টি তাঁতে একাগ্র চিত্তে শাড়ি তৈরি করছেন ২২ জন তাঁতি। তাদের মধ্যে দুজন নারী।
মসলিনের কারিগররা যা বললেন
একেকটি তাঁতে দুজন করে বসে নিবিড় মনে শাড়ি বুনছেন মসলিনের কারিগররা। অদ্ভুত সুন্দর সব নকশি দেওয়া শাড়ি বুনছেন আপন মনে। মাথার উপর সুতার রোল। শাড়িতে এক পেছ সুতা বুননের সঙ্গে সঙ্গে রোল ঘুরে নেমে আসে আরেক হাত সুতা। খুবই সতর্কতার সঙ্গে সেই সুতা বুনতে হয়। ছিঁড়ে যাওয়ার ভয় থাকে সব সময়।
মফিজুল ইসলাম। বাড়ি সোনারগাঁও। শাড়ি বুনেই পার করে দিয়েছেন ২৪ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি বেশ কিছু মসলিন শাড়ি তৈরি করেছেন। নিজের তাঁত ছিল। পাশাপাশি অসংখ্য জামদানি শাড়ি বুনেছেন। এখন তিনি আবার মসলিন শাড়ি বুননের কাজ করছেন। তাঁত বোর্ডের মসলিন হাউসে তিনি শাড়ি তৈরির একজন কারিগর হিসেবে চাকরি করছেন।
মফিজুল জানালেন, আগে অনেক মসলিন কাপড় তৈরি করে বিক্রি করেছেন। এরপর সুতাসহ অন্য কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়া এবং মসলিন তৈরি করা কঠিন হয়ে পড়ায় তিনি মসলিন তৈরির কাজ বাদ দিয়ে দেন; কিন্তু গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে তিনি আবারও সরকারি প্রতিষ্ঠানে মসলিন শাড়ি তৈরির কাজে হাত দিয়েছেন।
মফিজুল জানালেন, নিজের তাঁতে কাজ করার সময় গত দুই যুগে তিনি অন্তত ৮০টি মসলিন শাড়ি তৈরি করেছেন। বেশি নকশা না হলে বছরে অন্তত তিনটা শাড়ি তৈরি করা যায়। বললেন, নিজের তাঁতে কাজ করলেও বেশিরভাগ সময়ই ফরমায়েশি কাজ করেছেন। অনেকে অর্ডার করে শাড়ি তৈরি করাতেন। এতে তার খুব বেশি লাভ হত না। এতে থার্ড পার্টির লাভই বেশি হত। তিনি শুধু শ্রমের মূল্য পেতেন। তিনি আরও জানান, তিনি যখন নিজের তাঁতে মসলিন শাড়ি বুনতেন সেই সময় একেকটা শাড়ি ৪৫ থেকে ৪৮ হাজার টাকায় বিক্রি হত।
মফিজুল এখন সরকারি প্রতিষ্ঠানে মসলিনের একজন কারিগর হিসেবে যোগ দিয়েছেন। গত নভেম্বর থেকে মসলিনের জন্য তৈরি কারখানায় মসলিন শাড়ি বুনার কাজ করছেন। এর আগেও নিজের বাড়িতে বসে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের হয়ে মসলিন শাড়ি তৈরির কাজ করেছেন।
মসলিন বুনার পাশাপাশি নিজের কষ্টের কথা জানাতেও ভুললেন না মফিজুল। বললেন, ‘একটা শাড়ি বুনতে যে কষ্ট হয়, সেই তুলনায় যে বেতন পাই সেটা দিয়ে সংসার চলে না। ছেলেমেয়েদের লেখাপাড়ার খরচ চালাতে পারি না।’
একেবারে প্রথম তাঁতে আপন মনে শাড়ি বুনছেন আছিয়া বেগম ও সালমা বেগম। আছিয়া বলছিলেন, তিনি একেবারেই নতুন। চার মাস ধরে কাজ করছেন। এর আগে মসলিন কাপড় বুনার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
বললেন, দুই বছর ধরে মসলিনের কাপড় তৈরির কাজ করছেন। আর এখানে কাজ করছেন চার মাস ধরে। চার মাসে মাত্র পাঁচ হাত শাড়ি বুনছেন। বাকি সাত হাত বুনতে আরও চার থেকে পাঁচ মাস লাগবে। অর্থাৎ পুরো শাড়িটি তৈরি করতে তাদের দুই জনের সময় লাগবে আট থেকে নয় মাস।
আছিয়া জানালেন, হালকা নকশি বা কম নকশির শাড়ি হলে বছরে দু্ই থেকে তিনটা শাড়ি তৈরি করা যায়। আর যদি গর্জিয়াস বা জাঁকজমকপূর্ণ নকশির হয় তাহলে বছরে একটা শাড়ি তৈরি করা যায়। তাও অনেক কষ্ট হয়।
আছিয়া বলেন, সকাল আটটা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত কাজ করেন। মাসিক বেতনে চাকরি করেন। আগে বাড়িতে নিজের তাঁতেই কাজ করতেন। তখন জামদানি শাড়ির পাশাপাশি মসলিনের শাড়ি, ওড়না ও রুমাল তৈরি করতেন।
মসলিন যাবে বর্হিবিশ্বে
ঢাকাই মসলিনকে পুনরুদ্ধার করা হচ্ছে তার রং গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে। আজ থেকে প্রায় ১৭০ বছর আগে এই ‘ঢাকাই মসলিন’ ছিল বাংলাদেশের সোনালী ঐতিহ্য ও বিশ্ববিখ্যাত ব্রান্ড। হারিয়ে যাওয়া সেই ঐতিহ্য আবার ফিরিয়ে আনা হচ্ছে।
মসলিনের অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি বিদেশের বাজারে এর চাহিদা বিবেচনায় রপ্তানি করা হবে। মসলিনের কারিগররা বলছেন, এখন যে মানের মসলিন তৈরি হচ্ছে তাতে একেকটা শাড়ির যে মূল্য পড়বে, সেই হিসেবে দেশের বাজারে এটা খুব একটা বিক্রি করা সম্ভব হবে না। এটা বিক্রি করতে হবে বিদেশের বাজারে।
তাঁতিরা জানান, শাড়ি তৈরি হচ্ছে মূলত বিদেশের বাজারে রপ্তানির জন্য। যার মধ্য দিয়ে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ‘ঢাকাই মসলিন’ যাবে বাংলাদেশের বিখ্যাত ব্র্যান্ড হিসেবে। বাংলাদেশের সুনাম ছড়িয়ে পড়বে দেশে দেশে। তাঁতিদের আশা, চলতি বছরেই তাদের হাতে বুনা মসলিন যাবে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের নানান দেশে।
যেমন হতে পারে মসলিনের দাম
‘ঢাকাই মসলিন’ শুধু নামে নয়, দামেও থাকবে আকাশ ছোঁয়া। মসলিন এর কারিগররা যেমনটা জানালেন, এখন যে মানের মসলিন তৈরি হচ্ছে তার একেকটির মূল্য সাত-আট লাখ টাকার কম হবে না। তবে সরকার সেটি কি মূল্যে বিদেশে রপ্তানি করবে সেটা নির্ভর করবে রপ্তানির সময় সরকারের সিদ্ধান্তের উপর।
তাঁতিরা জানান, সাধারণ একটি মসলিন যেগুলো খুব একটা নকশা থাকবে না সেগুলোর দাম কম পড়বে। কিন্তু চোখ ধাঁধানো সব নকশি করা ঢাকাই মসলিন এর দাম হবে সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। তবে দেশের ভিতরে শুধু সৌখিন ক্রেতারা কিনতে পারবেন।
প্রস্তুত কারখানা, উদ্বোধনের অপেক্ষা
শীতলক্ষ্যার পাড়ে তারাবোতে ‘ঢাকাই মসলিন হাউস’ এখন পুরোদমে প্রস্তুত। রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের অপেক্ষায়। ইতিমধ্যে এই মসলিন হাউসে নির্মাণ করা হয়েছে একটি ‘মলমল খাস স্পিনিং ও উইনিং শেড’। যেখানে ২০টি তাঁত এবং মহিলাদের সুতা তৈরির একটি কক্ষ। থাকবে মসলিনের একটি আধুনিক প্রদর্শনী কেন্দ্র, বেবি ডে-কেয়ার সেন্টার। এ ছাড়া মসলিন হাউসে ঢুকতেই প্রধান ফটকে চোখে পড়বে প্রধানমন্ত্রীর একটি ম্যুরাল। সব মিলিয়ে এখন শুধুই অপেক্ষা ঢাকাই মসলিনের উদ্বোধন এবং তার বাজারজাতকরণের।
এসএ/