নারী দিবসের বিশেষ সাক্ষাৎকারে ডিবি কর্মকর্তা নাজিয়া ইসলাম
'যোগ্যতা প্রমাণে পুরুষের চেয়ে নারী অধিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন'
‘নারীদের পুরুষের সমকক্ষ নয় বরং অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। কারণ, একজন মেয়েকে সারাজীবন যে পরিমাণ প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে হয়, তা অকল্পনীয়। নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হলে তাকে একজন পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়।'
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে ঢাকাপ্রকাশ-এর সঙ্গে আলাপকালে এ মন্তব্য করেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের রমনা বিভাগের কর্মকর্তা নাজিয়া ইসলাম।
নাজিয়া ইসলামের জন্ম ঢাকার শাহাজানপুর রেলওয়ে কলোনিতে। বাবা ছিলেন রেল কর্মকর্তা। মা জাকিয়া ইসলাম। তিন বোনের মধ্যে নাজিয়া বড়।
মাঝে কয়েক বছর বাবার চাকরির সুবাদে কাটিয়েছেন চট্টগ্রামে। আহসান উল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে কম্পিটার সাইন্সে গ্রাজুয়েশন করেন। পুলিশে যোগদানের আগে তিনি একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি করতেন। ৩৪তম বিসিএসে ২০১৬ সালে তিনি পুলিশ ক্যাডারে মনোনীত হয়ে ওই বছর ১ জুলাই চাকরিতে যোগ দেন।
তিনি ২০২১ সালের ১৭ এপ্রিল রমনা বিভাগের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ টিমের সহকারী পুলিশ কমিশনার হিসেবে যুক্ত হন। অনলাইন জুয়া চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার, বিদেশি ভেজাল মদ, বিদেশি অস্ত্র উদ্ধার, ডাকাতির প্রস্তুতিকালে ডাকাত ধরা, অস্ত্রসহ ভুয়া ডিবি পুলিশ আটক করে পুরস্কার ও সুনাম অর্জন করেছেন। মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় এক বছরেরও কম সময়ে অন্তত ৫ বার পুরস্কৃত হয়েছেন। অজ্ঞানপার্টি ও মলম পার্টি গ্রেপ্তার করে সব শেষ জানুয়ারি মাসে মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় শ্রেষ্ঠ হয়েছেন।
নারী হয়ে বেশির ভাগ সময় অপরাধীদের নিয়ে কাজ করা কতটা চ্যালেঞ্জ জানতে চাইলে নাজিয়া বলেন, ক্রাইমে একটা মেয়ের জন্য কাজ করা খুবই কঠিন। অনেকে এখনও মেনে নিতে পারে না। একটা মেয়ে ক্রাইমে কাজ করছে। রাতবিরাতে বাইরে থাকছে। এটা এখনও মানুষের মানসিকতার সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে না।
তিনি বলেন, আমাকে অনেক প্রতিবন্ধকতা ফেস করতে হয়েছে। মেইন যেটা ফেস করছি- আসামিদের আনার পরে তারা লেডি অফিসারের আন্ডারে ইন্টারোগেট করার সময় কোনো কিছু কো-অপারেট করতে চায় না। এমন একটা রিঅ্যাক্ট করে যে আমি তাদের ইন্টারোগেট করতে পারব না। তারা গ্রাহ্য করে না। এমনিতেই তো অপরাধীরা অনেক দুষ্ট প্রকৃতির হয়।
নাজিয়া বলেন, প্রথমদিকে পরিবার খুব দুশ্চিন্তায় থাকত। দায়িত্বের কারণে দেখা যাচ্ছে তিন-চার দিন আমি বাসায় যেতে পারি না। প্রথম দিকে বাবা এটায় খুবই রিস্ক ফিল করতেন। এমনও হয়েছে তিন-চার দিন ধরে টানা মাঠে থাকতে হয়েছে। অপরাধীকে ফলো করছি, তো করছি। একটা বিষয় নিয়ে কাজ শুরু করলে তা শেষ না করা পর্যন্ত লেগে থাকতে হয়।
একটু এদিকে-সেদিক হলে অপরাধী ধরা মুশকিল হয়ে যায়। একজনকে টার্গেট করেছি। সে মুভ করছে। তার পেছনে আমিও মুভ করছি। মুভ করতে করতে একপর্যায়ে গিয়ে হয়তো তাকে ধরতে পারছি। স্যারদের নির্দেশনায় আল্লাহর রহমতে আমার সাকসেস রেট ৯৯ শতাংশ।
সবশেষ ভুয়া ডিবি পুলিশ পরিচয়ে বিদেশি অস্ত্রসহ ডাকাত দল গ্রেপ্তার করেন তিনি। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, শেষ অপারেশনটা খুব রিস্কি ছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম নরমাল অস্ত্র। শেষ পর্যন্ত জানতে পারলাম লোডেড বিদেশি পিস্তল রয়েছে। আমরা বারবার ক্রস চেক করে দেখলাম যে আসলেই লোডেড পিস্তল। সর্বোচ্চ ৩০ সেকেন্ডের টার্গেট নিয়ে তাদের ধরি। কারণ ওই সময়ের মধ্যে ধরতে না পারলে তারা গুলি করে দেবে। গাড়ি থেকে কেউ না নামার আগে অপরেশনে যখন যাই তখন মাথা কাজ করে না। শুধু একটাই চিন্তা অপরাধী ধরতে হবে।
মেয়ে হয়ে পুলিশে আসা কেন জানতে চাইলে নাজিয়া বলেন, আমি খুবই কনজারভেটিভ পরিবারের মেয়ে। আমার বাবা মা খুবই কনজারভেটিভ। তারা কখনোই চাননি। তারা চেয়েছেন-তাদের মেয়ে ব্যাংকার হবে অথবা টিচার হবে। নিরিবিলি কোনো জব তাদের পছন্দ ছিল।
আমি যখন বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই চিন্তা ছিল যে আমি এমন একটা জায়গায় কাজ করব যে আমার মেধা আর সাহস কাজে লাগাতে পারব। যেটায় অ্যাডভেঞ্চার আছে। ক্রাইম রিলেটেড অ্যাডভেঞ্চার। এ কারণে আসলে পুলিশে আসা। আমাকে যখন ভাইবা বোর্ডে জিজ্ঞেস করা হয়, তুমি কেন পুলিশে আসতে চাও। তখন আমার মনে হয়েছে পুলিশে আসলে আমি কিছু দিতে পারব।
তিনি বলেন, আমি নিজেকে কখনো মেয়ে মনে করি না। এমনও হয়েছে অপারেশন করতে করতে আমার টিমের ছেলেরা টায়ার্ড হয়ে গেছে। কিন্তু আমি তো ঠিক আছি। তখন তারা আবার নতুন উদ্দীপনা পেয়েছে। স্যার যদি পারে আমি পারব না? আমার মা বলেতেন তুমি যাই কর তা যেন মানব কল্যাণে হয়। একটা মানুষেরও যদি মঙ্গল করতে পারো তাই তোমার অর্জন। বিশেষ করে মা আমাকে সব সময় এতো সাপোর্ট দেন যা বলার মতো না। যতো রাত হোক যতো সমস্যা হোক আমি সব শেয়ার করতে পারি। আর তিনিও আমাকে সাপোর্ট দেন। মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক বন্ধুর মত।
বিসিএস ভাইবায় আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, নারীর ক্ষমতায়নের উদাহরণ দাও। উত্তর দিয়েছিলাম, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কখনো হার না মেনে এগিয়ে চলা এক নারী। আমৃত্যু এটাই বিশ্বাস থাকবে।
নাজিয়ার মাথায় সব সময় কাজ করে অপরাধী ধরা। তিনি বলেন, আমার রাতের স্বপ্নগুলোও এরকম হয় যে আমি এক দিন বোনের সঙ্গে ঘুমাচ্ছি, আমি নাকি বলে উঠেছি ঘুমের মধ্যে যে, ইস ধরতে পারলাম না। আমার ঘুমের মধ্যেও মাথায় এগুলো ঘুরতে থাকে। স্বপ্নের মধ্যে দেখা যাচ্ছে যে অভিযান পরিচালনা করছি। লাইফটা একেবারে দায়িত্ব পালনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে।
অপরাধী ধরা এখন অনেক চ্যালেঞ্জের উল্লেখ করে নাজিয়া বলেন, আগে টেকনোলজি ব্যবহার করে যতটা সহজে অপরাধী ধরা যেত এখন তা আরো কঠিন। কখনো তারা ডিজিটাল কখনো ম্যানুয়ালি চলে আসতেছে। ম্যানুয়াল এবং টেকনোলজি দুটি ব্যবহার করতে হচ্ছে।
নাজিয়া বলেন, ২০২২ এ এসেও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে নারীরা এখনো বৈষম্যের শিকার। আমি নারীদের পুরুষের সমকক্ষ নয় বরং অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। কারণ, একজন মেয়েকে যে পরিমাণ প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে হয় সারা জীবন, তা অকল্পনীয়। নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হলে তাকে একজন পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। তাই বলে মেয়েরা থেমে নেই, থামা যাবেও না। যত কষ্টই হোক, বাধা-বিপত্তি আসুক, নিজেকে নিয়ে যেতে হবে নিজের স্বপ্নের সীমানায়।
কেএম/এএস