ফেলানীর ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত
সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত ফেলানী খাতুনের ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়েছে। শুক্রবার (০৭ জানুয়ারি) উপজেলার রামখানা ইউনিয়নের দক্ষিণ রামখানা কলোনিটারী গ্রামে নিজ বাড়িতে তার কবর জিয়ারত, দোয়া ও মিলাদ অনুষ্ঠিত হয়। এতে যোগ দেয় ঢাকাস্থ নাগরিক পরিষদ।
২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ফুলবাড়ী উপজেলার উত্তর অনন্তপুর সীমান্তে ৯৪৭ নং আন্তর্জাতিক ৩ নং সাব পিলারের পাশ দিয়ে মই বেয়ে কাটাতার ডিঙ্গিয়ে বাবার সঙ্গে দেশে ফিরছিল ফেলানী। এ সময় টহলরত চৌধুরীহাট ক্যাম্পের বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষ তাকে গুলি করে হত্যা করে। দীর্ঘক্ষণ কাটাতারে ঝুলে থাকে ফেলানীর নিথর নিস্তব্ধ দেহ। তখন দেশি-বিদেশি মিডিয়া ফলাও করে প্রচার করে সীমান্তে নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের সংবাদ।
গত কয়েক বছর ফেলানীর মৃত্যু দিবসে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে কর্মসূচি পালন করলেও এবারে প্রথম ফেলানীর আত্মার মাগফেরাৎ কামনায় নিজ বাড়িতে তার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে এ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছে ঢাকাস্থ নাগরিক পরিষদ।
এ সময় নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক মোহাম্মদ শামসুদ্দীন সীমান্ত হত্যা বন্ধ ও ৭ জানুয়ারি ফেলানী দিবস পালনের দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘ফেলানী হত্যাকারী বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষের ফাঁসি, ফেলানীর পরিবারসহ সীমান্ত আগ্রাসনে ক্ষতিগ্রস্ত সকল ব্যক্তি ও তাদের পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন পার্ক রোড এর নাম ফেলানী সরণী রাখতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘ মহাসচিব বরাবর বিশ্বব্যাপী সীমান্ত হত্যা বন্ধ ও ৭ জানুয়ারি ফেলানী দিবস পালনের জন্য ২০১৫ সালে তারা একটি স্মারকলিপি প্রদান করেছিলেন। পরবর্তীতে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয় এটি বাস্তবায়নের জন্য জাতিসংঘের সদস্য যে কোনো রাষ্ট্রকে প্রস্তাব আনতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। এবারেও দেশব্যাপী ফেলানী দিবস পালনের দাবিতে গত ১ জানুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আমরা মানববন্ধন করেছি। কুড়িগ্রামের অনন্তপুর সীমান্তের নাম ফেলানী সীমান্ত করার দাবিতে ৬ জানুয়ারি কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক বরাবর একটি স্মারকলিপি পেশ করেছি আমরা।’
ফেলানীর বাবা নূরুল ইসলাম ও মা জাহানারা বেগম হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘সেদিনের দুঃসহ স্মৃতির কথা আজও ভুলতে পারিনি আমরা। চোখের সামনে আমাদের মেয়েকে তারা পাখির মতো গুলি করে মেরেছে। এখনও ঘুমের মধ্যে তার আর্তচিৎকার শুনতে পাই। গভীর রাতে আচমকা ঘুম ভেঙে যায়। দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে। বিষাদে ভরে যায় মন। হতভাগা আমরা। মেয়ে হত্যার বিচার চেয়ে মানবাধিকার সংস্থাসহ বহুজনের কাছে গিয়েছি কিন্তু ১১ বছরেও কাঙ্খিত বিচার পেলাম না। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই।’
উল্লেখ্য, এ ঘটনায় ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট কোচবিহার জেলার বিএসএফ’র ১৮১ সদর দপ্তরে স্থাপিত জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্টে ফেলানী হত্যার বিচারকার্য শুরু হয়। ৫ সেপ্টেম্বর অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে নির্দোষ ঘোষণা করে। রায় প্রত্যাখ্যান করে ১১ সেপ্টেম্বর ফেলানীর বাবা ভারতীয় হাই কমিশনের মাধ্যমে সে দেশের সরকারকে ন্যায় বিচারের আশায় পত্র দেন। আবারও ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পুনঃবিচার কার্যক্রম শুরু হলেও বিভিন্ন কারণে তা একাধিকবার স্থগিত হয়।
২০১৫ সালে আইন ও শালিস কেন্দ্র এবং ভারতের মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ আরও একটি ক্ষতিপূরণ মামলা করে। সে বছরের ৩১ আগস্ট ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সে দেশের সরকারকে ফেলানীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৫ লাখ রুপি প্রদানের অনুরোধ করে। এর জবাবে সে দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলামকে দায়ী করে বক্তব্য দেয়। এরপর ২০১৬ এবং ১৭ সালে কয়েক দফা শুনানি পিছিয়ে যায়। পরে ২০১৮ সালের ২৫ জানুয়ারি শুনানির দিন ধার্য হলেও শুনানি হয়নি এখনও।
ফেলানী হত্যা মামলার বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সদস্য মানবাধিকার কর্মী, কুড়িগ্রাম জেলা জর্জ কোর্ট পাবলিক প্রসিকিউটর এ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন বলেন, ‘ভারতের সুপ্রিম কোর্টে ফেলানী হত্যার রিটটি কার্যতালিকার তিন নম্বরে ছিল। নানা কারণে শুনানির ধার্য দিন পিছিয়ে গেছে। এখন করোনাকালে নিয়মিত শুনানি সম্ভব নয়। প্রত্যাশা করছি দ্রুত রিট আবেদনটির শুনানি কার্যতালিকায় নিয়ে আসবে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। শুনানি হলে দুই দেশের সম্পর্ক আরও জোরদার হবে। মামলাটির দ্রুত নিষ্পত্তি হলে তা উভয় রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক।’
এছাড়া ২০১৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ফেলানী হত্যা ঘটনায় স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচার এবং ক্ষতিপূরণ আদায়ে ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম ১ম ও বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপ্রধান অ্যাডভোকেট সালমা আলী ২য় বাদী হয়ে আইন ও বিচার বিষয়ক মন্ত্রণালয় (ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া) এর সচিব এবং বিএসএফ এর মহাপরিচালককে বিবাদী করে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নয়াদিল্লিতে ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩২ অনুযায়ী একটি ফৌজদারী মামলা করেন। তারা ২০১৫ সালের ২১ জুলাই ফেলানীর বাবার জন্য অন্তবর্তীকালীন ক্ষতিপূরণ চেয়ে আরও একটি আবেদন করেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপ্রধান মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সালমা আলী মুঠোফোনে জানান, এখন পর্যন্ত পরিবারের ক্ষতিপূরণসহ স্বচ্ছ বিচার না পাওয়ায় ওই মামলার একজন বাদী হিসেবে আমি দুঃখ প্রকাশ করছি। আশা করছি আমরা কাঙ্খিত বিচার পাবো।’
নাগেশ্বীর উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তফা জামান বলেন, ‘বিষয়টি আন্তর্জাতিক। আমি চাই ফেলানী হত্যার সুষ্ঠু বিচার। এছাড়া সীমান্তে সকল হত্যা বন্ধেরও দাবি জানাই আমি।’
/এএন