অন্যের এনআইডিতে শতাধিক কৃষকের নামে ঋণ!
ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলার তাহেরহুদা গ্রামের মোজাম্মেল হক একজন পানচাষি। তিনি আলু চাষের জন্য ঋণ নিয়েছিলেন ৫০ হাজার টাকা। পরবর্তীতে তিনি ঋণ পুনঃ তফসিলীকরণ করে নেন আরো এক লক্ষ টাকা। কিন্তু ব্যাংকের খাতায় তার নামে আড়াই লক্ষ টাকার ঋণ বকেয়া দেখানো হয়।
একই গ্রামের মজনু জোয়ারদার ২০২০ সালের ২৪ ডিসেম্বর জনতা ব্যাংক থেকে এক লক্ষ ১৫ হাজার টাকা আলু চাষের জন্য ঋণ গ্রহন করেন। ঋণের গোটা অর্থ পরিশোধ করে ২০২২ সালের ১০ ফেব্রয়ারি আবারো তিনি এক লক্ষ ৬০ হাজার টাকা নতুন ঋণ নেন। কিন্তু তার আগের ঋণের ১ লক্ষ ১৫ হাজার টাকার মধ্যে ৬০ হাজার টাকা বকেয়া দেখানো হয়।
মোজাম্মেল কিংবা মজনু নয়, ওই এলাকাসহ ঝিনাইদহ ও শৈলকুপার মানুষের এনআইডি ব্যবহার করে শতাধিক কৃষকের নামে ভৌতিক ঋণ দেখিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে। তবে কত টাকা আত্মসাৎ হয়েছে তা খোলসা করে বলতে পারেননি ব্যাংকের বর্তমান শাখা ব্যবস্থাপক মলয় কুমার রায়। তিনি একটি আনুমানিক ধারনা দিয়ে জানিয়েছেন, শতাধিক কৃষকের নামে ৭০ লক্ষ থেকে এক কোটি টাকা আত্মসাৎ হতে পারে। ঢাকা অফিসের তদন্ত শেষে বিষয়টি জানা যাবে বলেও মলয় জানান।
এদিকে অভিযোগ উঠেছে ঝিনাইদহ জনতা ব্যাংকের এরিয়া অফিসের ডিজিএম মোঃ হামিদুল্লাহ ঋণ জালিয়াতির তথ্যটি ধামাচাপা দিয়ে দায়ি ব্যক্তিদের রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাছাড়া তিনি প্রতি অর্থ বছরে চাহিদার বেশি পরিমান টাকা শাখাগুলোতে বরাদ্দ দিলেও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারেননি। অভিযোগ উঠেছে ডিজিএমের নেতৃত্বে ঝিনাইদহে একটি বড় জালিয়াতি চক্র জনতা ব্যাংকে বাসা বেঁধেছে। তদন্ত করলে অনেক শাখায় এমন লুটপাটের তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে।
এদিকে ভবানীপুর শাখায় ঋণ জালিয়াতির বিষয়টি জানাজানি হলে, গত সেপ্টেম্বর মাসে জনতা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি সরেজমিন তদন্ত করে ঋণ জালিয়াতির সত্যতা পান।
এ ঘটনায় শাস্তির পরিবর্তে বদলী করা হয় ভবানীপুর ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক জালিয়াতি চক্রের মুল হোতা ইউনুস আলী ও রুরাল ক্রেডিট অফিসার আব্দুল আজিজকে। তারা এখনো বহাল তবিয়তে দাপটের সঙ্গে চাকরী করে যাচ্ছেন।
তথ্য নিয়ে জানা গেছে, শাখা ব্যবস্থাপকের সহায়তায় জাল কাগজপত্র তৈরী ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষর জাল করে দীর্ঘদিন ধরে ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। শৈলকুপার আবু হুরাইয়া ও ঝিনাইদহ পৌরসভার কর্মচারি চাঁদ আহম্মেদের এনআইডি ব্যবহার করে ক্রেডিট অফিসার আব্দুল আজিজ ঋণ উত্তোলন করেন বলে অভিযোগ।
ঋণ পরিশোধের জন্য জনতা ব্যাংক থেকে ওই দুই ব্যক্তির কাছে ফোন করা হলে তারা কিংকর্তব্যবিমুড় হয়ে যান। পরে আবু হুরাইরা ও চাঁদ আহম্মেদের নামে তোলা ঋণ পরিশোধ করেন আব্দুল আজিজ।
এদিকে ব্যাংকের অফিসার বদল হলে কৃষকদের বাড়ি বাড়ি যাওয়া হয় ঋণ আদায়ের জন্য। আর তখনই ধরা পড়ে এই ঋণ জালিয়াতির কারবার। হরিণাকুন্ডু উপজেলার তাহেরহুদা গ্রামের আবু মুছাব ওরফে মোশাররফ জানান, তিনি ভবানীপুর ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার টাকা গ্রহণ করেছিলেন। সব টাকা পরিশোধও করেছিলেন। কিন্তু সুদের ৭ হাজার ৭০০ টাকা জমা করেনি আদায়কারী আব্দুল আজিজ। পরে ব্যাংকের তদন্ত কর্মকর্তারা সেটা ঠিক করে দিয়েছেন।
কৃষক বাহার আলী জানান, তিনি ৩৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। তাকে ৭০ হাজার টাকা পরিশোধের নোটিশ দেওয়া হয়। তিনি জানান, তার নামে ৩৫ হাজারের স্থলে জালিয়াতির মাধ্যমে ৭০ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়। এভাবে ব্যাংক এলাকার ধুলিয়া, শ্রীপুর, ভবানীপুর ও তাহেরহুদাসহ ৮/১০টি গ্রামের কৃষকের নামে মিলেছে ভৌতিক ঋণ, যা তারা গ্রহন করেননি।
এদিকে তথ্য নিয়ে জানা গেছে, ভবানীপুর ব্যাংকের সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক ইউনুস আলীর ঝিনাইদহ শহরের আরাপপুরে দুইটি ও ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট আছে। মুন্সিগঞ্জ ও শৈলকুপাসহ বিভিন্ন শাখায় তিনি এভাবে ঋণ জালিয়াতি ও বড় ঋণের বিপরীতে ঘুষ নিয়ে অঢেল সম্পদ গড়ে তুলেছেন। তার এই আয় বহির্ভুত সম্পদ নিয়ে জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা কর্মচারিদের মাঝে এখন কানাঘুষা শুরু হয়েছে। দুর্নীতির পাহাড়সম অভিযোগ থাকলেও তাকে ভবানীপুর শাখা থেকে সরিয়ে এরিয়া অফিসে এনে জামায় আদরে রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে ভবানীপুরের সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক ইউনুস আলী ঋণ জালিয়াতির খবর অস্বীকার করে জানান, তিনি ওই শাখায় মাত্র এক বছর ছিলেন। তার আগে আরো দুই ম্যানেজার দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের সময় থেকে এই জালিয়াতি চলে আসছে। ম্যানেজারের সিল ও স্বাক্ষর জাল করে রুরাল ক্রেডিট অফিসার আব্দুল আজিজ এই অপকর্ম করেছেন বলে ইউনুস আলী দাবী করেন।
অন্যদিকে রুরাল ক্রেডিট অফিসার আব্দুল আজিজ জানান, আমি এ ঘটনার সঙ্গে মোটেও জড়িত নয়। বরং আমার স্বাক্ষর জাল করে ব্যবস্থাপক ইউনুস আলী ঋণ জালিয়াতি করেছেন। ঘটনাটি তদন্তে ধরাও পড়েছে।
তিনি বলেন, এ ঘটনার পর ডিজিএম হামিদুল্লাহ আমার গ্রামের বাড়িতে এসে ও লোক পাঠিয়ে হুমকি দিচ্ছেন। আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আমাকে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে জনতা ব্যাংকের খুলনা অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, দুর্ঘটনায় আমার দুইবার পা ভেঙ্গেছে। এই অবস্থায় আমাকে বাগেরহাট বদলী করে অবিচার করা হয়েছে। বর্তমান আমাকে মাগুরার গঙ্গারামপুর শাখায় বদলী করা হয়েছে। কিন্তু পা ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে আমি গ্রামের বাড়িতে আছি।
এ বিষয়ে ঝিনাইদহ জনতা ব্যাংকের এরিয়া অফিসের ডিজিএম মোঃ হামিদুল্লাহ জানান, হরিণাকুন্ডুর ভবানীপুর শাখায় এমন অনিয়ম ধরা পড়েছে। কর্তৃপক্ষ তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তারা ঘটনাস্থল তদন্ত করে গেছেন। ওই ব্যাংকের দুই কর্মকর্তাকে আপাতত বদলী করা হয়েছে। তদন্তের পর দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে ডিজিএম মোঃ হামিদুল্লাহ জানান।
এএজেড