ঝিনাইদহ পৌরসভার আত্মসাৎ করা টাকা ফেরত
ঝিনাইদহ পৌরসভার একটি একাউন্টে বিপুল পরিমাণ ভৌতিক টাকা জমা হয়েছে। এই টাকা নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। কে বা কারা এই টাকা ঝিনাইদহ সোনালী ব্যাংকের ২৪০৭০০৪০০০৩১৬ নম্বর একাউন্টে জমা দিয়েছে তার কোনো তথ্য নেই ঝিনাইদহ পৌরসভায়। অত্যন্ত গোপনে ওই একাউন্টে ৭৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮২ টাকা জমা দেওয়া হয়েছে।
অনেকের ধারণা গত বছর চেক ও ভাউচার জালিয়াতির মাধ্যমে যে ৮৪ লাখ ৩৩ হাজার ৬৯৮ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছিল, হয়তো সেই টাকাই পৌরসভার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা গোপনে জমা দিয়েছেন। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, ২০১১ সালের ১ জুন থেকে ২০১৭ সালের ৪ আক্টোবর পর্যন্ত সর্বমোট ৩৮টি চেক ও ভাউচারের অনুকুলে ৮৪ লাখ ৩৩ হাজার ৬৯৮ টাকা উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে পৌরসভার প্রশাসনিক কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান চাঁন একাই পৌরসভার বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৩১ লাখ ৪৪ হাজার ৮১৯ টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে উত্তোলন করেন। অথচ পৌরসভার ক্যাশ বইয়ে মাত্র ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৮১৯ টাকার কাজ দেখানো হয়েছে। সে সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে তদন্তের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
ঝিনাইদহ পৌরসভার সাবেক মেয়র সাইদুল করিম মিন্টু ২০২১ সালের ২৭ জুন ঝিনাইদহ পৌরসভার ২৯৬ নম্বর স্মারকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর একটি অভিযোগপত্র দেন। ওই পত্রে পৌরসভার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান চাঁনের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের গুরুতর অভিযোগ তোলেন মেয়র। পত্রে আরও উল্লেখ করা হয়, পৌরসভার বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব থেকে ৩১ লাখ ৪৪ হাজার ৮১৯ টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে ২৮ লাখ টাকা চেক জালিয়াতির মাধ্যমে তুলে আত্মসাৎ করা হয়। মেয়রের অভিযোগপত্র পাওয়ার পর ২০২১ সালের ১২ আগস্ট স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের (পৌরসভা শাখা-১) উপসচিব মুহাম্মদ ফারুক হোসেন স্বাক্ষরিত এক পত্রে ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসনের উপপরিচালক ইয়ারুল ইসলামকে তদন্ত করে প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশ দেন।
পরে মেয়রের মেয়াদ কাল শেষ হলে উপপরিচালক ইয়ারুল ইসলাম পৌরসভার প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু সেই তদন্ত আলোর মুখ দেখেনি। শাস্তি হয়নি চেক জালিয়াতির হোতাদের। এ ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনের যশোর সমন্বিত অফিস ঝিনাইদহ পৌরসভায় হানা দিয়ে ফাইল নিয়ে যান। কিন্তু দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এদিকে ঝিনাইদহ সোনালী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত ২২ সেপ্টেম্বর পৌরসভার ৩১৬ নম্বর একাউন্টে ৭৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮২ টাকা জমা হয়। পৌরসভার সাবেক হিসাব রক্ষক মকলেচুর রহমান মাসুদ এই টাকা জমা দেন। টাকা জমা দেওয়ার আগে এই একাউন্টে এক কোটি ২৮ লাখ ৯৬ হাজার ৯০৩ টাকা স্থিতি ছিল।
ঝিনাইদহ পৌরসভার একাউন্টস অফিসার আব্দুল মজিদ জানান, ঝিনাইদহ পৌরসভার এই একাউন্টে শুধুমাত্র জমি রেজিস্ট্রির ২ শতাংশ টাকা জমা হয়। অন্য কোনো টাকা এখানে আসার কথা নয়। তিনি বলেন, এই টাকা কীভাবে কারা জমা দিলেন তার কোনো তথ্য পৌরসভার হিসাব শাখায় নেই।
ঝিনাইদহ পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ জানান, অনেকের মতো তিনিও শুনেছেন বড় অংকের টাকা ব্যাংকে জমা হয়েছে, কিন্তু তার কাছে বা পৌরসভার হিসাব শাখায় কোনো তথ্য নেই।
বিষয়টি নিয়ে পৌরসভার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান চাঁন তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ খণ্ডন করে জানান, সাবেক হিসাব রক্ষক মকলেচুর রহমান দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে টাকা ফেরৎ দিয়েছেন। টাকা যিনি আত্মসাৎ করেছেন তিনিই আবার ব্যাংকে জমা দিয়েছেন। কারণ জমা বইতে তার স্বাক্ষর রয়েছে। তিনি কোনো চেক জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত নয় বলে দাবি করেন।
তবে সাবেক হিসাব রক্ষক মকলেচুর রহমান এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। অভিযোগ উঠেছে ঝিনাইদহ পৌরসভার সাবেক সচিব আজমল হোসেন এবং আসাদুজ্জামান চান চাকরি বাঁচাতে ও দুদকের মামলা থেকে বাঁচতে আত্মসাৎ করা বিপুল পরিমাণ টাকা সাবেক হিসাব রক্ষকের মাধ্যমে গোপনে ফেরৎ দিয়েছেন। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে এমন কথা পৌরসভার সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মুখে মুখে।
বিষয়টি নিয়ে পৌরসভার সাবেক প্রশাসক ও ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক দপ্তরের উপপরিচালক ইয়ারুল ইসলাম জানান, তিনি পৌরসভার চেক জালিয়াতির ঘটনাটি তদন্ত করে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিয়েছেন। এটা একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সময় লাগবে।
ঝিনাইদহ পৌরসভার মেয়র কাইয়ুম শাহরিয়ার জাহেদী হিজল বলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। তিনি গত ৩ অক্টোবর দায়িত্ব নিয়ে ৩ কোটি ৪২ লাখ টাকার হিসাব পেয়েছেন। এর বাইরে কী হয়েছে তা কিছুই বলতে পারবেন না।
তিনি বলেন, ১০ মাস ৩ দিন প্রশাসক পৌরসভার দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনিই এই টাকার বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন। আমি পৌরসভা চালাতে গিয়ে আর পেছনে ফিরতে চাই না। আমি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই।
পৌরসভায় দুর্নীতিবাজদের বহাল রেখে উন্নয়ন সম্ভব কি না এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি মেয়র।
এসএন