জয় বাংলার নবযাত্রা
বাংলাদেশের মন্ত্রীপরিষদ ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রীপরিষদের ২০ ফেব্রুয়ারির বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ থেকে জানানো হয়েছে, এ ব্যাপারে ২০২০ সালে হাইকোর্টের একটি রায় আছে, যেখানে বলা হয়েছে জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান হিসেবে বিবেচনা করতে হবে এবং সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণার পর সব সাংবিধানিক পদধারী ব্যক্তি, রাষ্ট্রের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী রাষ্ট্রীয় বা সরকারি অনুষ্ঠানের শেষে ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করবেন। এ ছাড়া স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে কোনো ধরনের সভা-সেমিনার শেষে ‘জয় বাংলা’ বলার বাধ্যবাধকতা থাকবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অ্যাসেম্বলিতেও ‘জয় বাংলা’ স্লোগান হবে। অর্থাৎ যে কোনো ধরনের অ্যাসেম্বলি, অনুষ্ঠানে সরকারি-বেসরকারি সবাই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি জাতীয় স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করবেন। জাতীয় দিবসগুলোতে ‘জয় বাংলা’ উচ্চারিত হবে।
তবে সিদ্ধান্তটি কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, অর্থাৎ জাতীয় স্লোগান হিসেবে ‘জয় বাংলা’ কখন, কীভাবে ব্যবহৃত হবে, কোথায় বাধ্যতামূলক থাকবে, সে বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন আসবে। স্মরণযোগ্য, জয় বাংলাকে ‘জাতীয় স্লোগান’ হিসেবে ঘোষণা চেয়ে ২০১৭ সালে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। ২০২০ সালে ‘জয় বাংলা’ বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হবে বলে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট।
বাঙালির জন্য, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য ‘জয় বাংলা’ এমন একটি স্লোগান–যা গণমানুষকে আত্মসচেতন করে, জাগ্রত করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই স্লোগান বাঙালি জনতাকে পাকিস্তানের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রবলভাবে প্রেরণা যুগিয়েছে। এই একটি মাত্র স্লোগানের মধ্য দিয়ে বাঙালি তার জাতীয় জীবনের সবচাইতে তীব্র, সংহত ও তাৎপর্যপূর্ণ আবেককে ধারণ করতে পেরেছে; দুটি মাত্র শব্দ পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোকে কাঁপিয়ে দিয়েছে, মাত্র দুটি শব্দ সুবিশাল আঙ্গিকে তুলে ধরেছে অসাম্প্রদায়িকতা, বাঙালির অবিভাজ্য সংস্কৃতি এবং ভাষার সৌন্দর্য ও জাতীয় আবেগ।
আমরা যারা ষাট দশকের মাঝামাঝি থেকে মুক্তিযুদ্ধের মাঠ পর্যায়ে যুক্ত থাকার সৌভাগ্য লাভ করেছি, তারা জানি, কীভাবে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি অধিকার প্রত্যাশি বাঙালিকে সামনে এগুবার শক্তি দিয়েছে। জমলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৭১-এর শুরুতে বিভিন্ন সভা সমবেশে ‘স্বাধীন বাংলা জিন্দাবাদ’, ‘আজাদ বাংলা জিন্দাবাদ’–ইত্যাদি স্লোগান ব্যবহার করেছেন। তবে জয় বাংলার প্রবল অগ্রাভিযান সবকিছু ছাপিয়ে গেছে। মূলত ১৯৬৯ সাল থেকে সেদিনের ছাত্র সমাজ বিভিন্ন মিছিল ও সভা সমাবেসে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ব্যবহার করা শুরু করে। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের প্রচারাভিযানে ‘জয় বাংলা’ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি ব্যবহৃত হয় ব্যাপকভাবে।
স্মরণ করা যেতে পারে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্বাক্ষর সংগীত ছিল–‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’। ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সর্বপ্রথম যে বেতার ভাষণটি দেন, তারও শেষ হয় ‘জয় বাংলা, জয় স্বাধীন বাংলাদেশ’ স্লোগান দিয়ে।
বিভিন্ন মত থাকলেও ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের উৎপত্তি প্রথম দেখা যায়, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময়। সে সময় ফরিদপুর-মাদারীপুরের স্কুল শিক্ষক স্বাধীনতা সংগ্রামী পূর্ণচন্দ্র দাস ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জেল-জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রবাদ পুরুষে পরিণত হন। একজন বাঙালি বীরের আত্মত্যাগ ও স্বজাত্যবোধে মুগ্ধ হয়ে পূর্ণচন্দ্র দাসের কারামুক্তি উপলক্ষে কাজী নজরুল ইসলাম ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ নামে একটি কবিতা রচনা করেন ১৯২২ সালে। কবিতাটি কবির ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থে স্থান পায়। ওই কবিতায় কাজী নজরুল সর্বপ্রথম ‘জয় বাংলা’ শব্দ ব্যবহার করেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সাহসী বাঙালি নায়ককে সম্মান জানিয়ে কবি লেখেন– ‘ওগো অতীতের আজো–ধূমায়িত আগ্নেয়গিরি ধূম্রশিখ!/না–আসা–দিনের অতিথি তরুণ তব পানে চেয়ে নিনিমিখ।/জয় বাংলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদী অন্তরীন!/জয় যুগে–যুগে –আসা সেনাপতি, জয় প্রাণ–আদি –অন্তহীন/ স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর/ বাংলা–মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা ভাগীরথীর!’
জয় বাংলার উৎপত্তি সম্পর্কে আরও একটি তথ্য পাওয়া যায়। কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় প্রকাশিত নবপর্যায় ‘নবযুগ’ পত্রিকার ৩ বৈশাখ ১৩৪৯ বঙ্গাব্দ (১৯৪২) সংখ্যায় ‘বাঙালির বাঙলা’ নামে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে নজরুল লেখেন, ‘বাঙালিকে, বাঙালির ছেলেমেয়েকে ছেলেবেলা থেকে শুধু এই এক মন্ত্র শেখাও; এই পবিত্র বাংলাদেশ, বাঙালির-আমাদের। দিয়া প্রহারেণ ধনঞ্জয় তাড়াব আমরা করি না ভয় যত পরদেশী দস্যু ডাকাত রামাদের গামা’দেও বাঙলা বাঙালির হোক। বাঙালির জয় হোক। বাঙালির জয় হোক।’
বলা সঙ্গত হবে যে, ১৯৪২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতায় ছিলেন এবং বিদ্রোহী কবির সেই উদ্দীপ্ত প্রবন্ধ তাকে নিশ্চিতভাবেই উজ্জীবিত করেছিল। আরও স্মরণযোগ্য, বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত উদ্যোগে কাজী নজরুল ইসলামকে ভারত থেকে বাংলাদেশে আনা হয় এবং তাকে ও তার পরিবারকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হয়।
তবে অধূনাকালে, খুব সম্ভবত ১৯৬৯ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একটি সভায় সর্বপ্রথম ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের ব্যবহার শুরু হয়। এরপর থেকে প্রায় ব্যাপকভাবেই আন্দোলনরত ছাত্র নেতা-কর্মীরা তাদের বক্তৃতায় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ব্যবহার করতে থাকেন। এটি ব্যবহার হতে থাকে প্রতিটি জাতীয়তাবাদী সভা-সমাবেশে। রমনা রেসকোর্সে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ইতিহাস খ্যাত জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ উচ্চারিত হওয়ার ফলে তা ব্যাপকভাবে বাঙালি জনতার প্রাণের স্লোগানে পরিণত হয়। বলা বাহুল্য, বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে উচ্চারিত হওয়ার পর থেকে ‘জয় বাংলা’ গোটা জনপদে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
অনস্বীকার্য, জয় বাংলা ১৯৬৯ সালের পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে জাতীয় প্ররণাশক্তি হয়ে উঠে, হয়ে উঠে জাগরণি স্লোগান। একই সঙ্গে ১৯৭১ সালের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধে হানাদার পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের দেশীয় অনুচর রাজাকার,আল বদরদের প্রতিরোধে সমর স্লোগান হয়ে ওঠে জয় বাংলা। কারণ এই একটি মাত্র স্লোগানের মধ্য দিয়ে বাঙালি তার জাতীয় জীবনের সবচেয়ে তীব্র, সংহত ও তাৎপর্যপূর্ণ আবেককে উচ্চারণ করতে সক্ষম হয়।
‘জয় বাংলা’ স্লোগানটির প্রধানতম তাৎপর্য হচ্ছে, এর উচ্চারণের মধ্যে বাঙালি একদিকে যেমন নিজের অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তাকে প্রকাশ করে, অন্যদিকে সেই জাতিসত্তার বিরুদ্ধ শক্তিকে প্রতিরোধ করার শক্তি খুঁজে পায়। এই স্লোগান ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগানের আবেদনকে কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করে, ধর্মভিত্তিক জাতীয়তা, যা ছিল পাকিস্তানি রাষ্ট্রব্যবস্থা বা রাষ্ট্রীয় শোষণের মূল হাতিয়ার, তাকেও প্রতিরোধ করে ‘জয় বাংলা’।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন করেছে। অর্থাৎ যে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবোধ উত্তরোত্তর শক্তিশালী হয়ে পাকিস্তানের ধর্মতান্ত্রিক শোষণের রাষ্ট্রকাঠামোকে পরাজিত করেছে, সেই জাতীয় শক্তির মহাবিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তি পালিত হয়েছে। একদিকে থেকে এতে প্রশান্তি লাভের সুযোগ আছে বৈকি। তবে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, সময়ের ঘূর্ণিপাকে, জয় বাংলার জাতীয়তাবাদ ক্রমান্বয়ে আক্রান্ত হয়েছে, রাজনৈতিক ধর্মবাদীরা নানা অঙ্গনে বিকশিত হয়েছে, ১৯৭১ জাতীয় চেতনাকে ১৯৪৭ এর আবরণে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করছে। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার যে, ধর্মের অন্তরাত্মা নয়, তার লেবাসি বহিরাঙ্গের সম্প্রসারণ ঘটানো হচ্ছে। এবং এই কাজটি চলছে পরিকল্পিত ভাবে এবং সুদূর প্রসারী চিন্তায়। বলা বাহুল্য, ১৯৭১ এর জাতীয় চেতনাকে পরাস্থ করে ১৯৪৭ এর সাম্প্রদায়িক চেতনার এই সম্প্রসারণ কখনো মঙ্গলের হতে পারেনা।
মনে রাখা প্রয়োজন যে, আমাদের জাতীয় জীবনের কয়েকটি জিয়নকাঠি আছে। এর একটি একুশে, একটি একাত্তর এবং একটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এসবকে একত্রিত ও গ্রন্থিত করে, এসবের প্রতিপক্ষদের রুখে দাঁড়াবার শক্তি দান করে যা–তা ‘জয় বাংলা’। এ স্লোগান বাঙালিকে ইতিহাসে যেভাবে বুকে বল দিয়েছে, আজও এবং আগামিতেও আত্মশক্তির সেই বল যুগাবে জয় বাংলা। নানা বিভাজনের পরও ‘জয় বাংলা’ বাঙালির শাশ্বত সম্ভ্রমের গৌরবান্বিত শক্তি, বিভ্রম দমিয়ে মানুষ হওয়ার শক্তি। ‘জয় বাংলা’র নবযাত্রাকে স্বাগত জানাই, তাকে আত্মায় ধারণ করতে বলি, কেবল বহিরাঙ্গে নয়।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও চিন্তাবিদ
এসএ/