শিক্ষার খোলসটা পাল্টানো দরকার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৬ বছর বয়সে একটি লেখা লিখেছিলেন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে। সেখানে তিনি একটি বেশ বড়সড় মন্তব্য করেছিলেন। তবে প্রাসঙ্গিক অংশটি ছিল এমন–‘আমাদের দেশে সৃষ্টি ছাড়া এক শিক্ষা প্রণালী প্রচলিত রহিয়াছে। যাহাতে শিক্ষার্থীর রুচিরও পরিবর্তন হয় না, তারা স্বাধীনভাবে চিন্তা করিতেও পারেনা।’ আর ‘শিক্ষার হেরফের’ নামে তার আরেকটি বিখ্যাত প্রবন্ধ আছে। সেখানে তিনি মত প্রকাশ করেন, আমাদের দেশের নিম্নশ্রেণির শিক্ষকরা বাংলা অথবা ইংরেজি কোনোটাই ভালো জানেন না। তারা কি শিখাবেন?
আমি রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করি সবসময়। কারণ শিক্ষার ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের যে ভাবনা, তা আমরা এখনো ধারণ করতে পারি না বলেই বাংলাদেশের শিক্ষার হ য ব র ল অবস্থা। আমি ৫২ বছরের শিক্ষকতা জীবনে অকপটে স্বীকার করব যে, আমার শিক্ষার্থীদের রুচির কোনো পরিবর্তন আমি করতে পারিনি এবং তাদের স্বাধীন চিন্তার কোনো সুযোগও দেইনি। কারণ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় তাদের দুটির একটিও উদ্ধৃত হবার নয়। যদি তা না হয়, তবে শিক্ষা কি হলো?
রবীন্দ্রনাথের আরেকটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি, ’বিদ্যা সহজ শিক্ষা কঠিন। বিদ্যা আবরণে, শিক্ষা আচরণে।’ আমরা বই থেকে, কাগজ থেকে, টেলিভিশন থেকে,শিক্ষকের মুখ থেকে যা পাই, তা হলো বিদ্যা। বিদ্যাভিত্তিক যে আলোকন, যেখানে মানুষ আলোকিত হয়, সেটি আচরণভিত্তিক। সেই জায়গায় আমাদের ব্যাপক ঘাটতি আছে। আমাদের দেশে অনেক ডিগ্রিধারী মানুষ আছে; কিন্তু আচরণগতভাবে সেই মানুষ নেই। ব্যক্তিগতভাবে একজন মানুষ শিক্ষিত বা আলোকিত কি-না, তার জন্য আমি চারটি বৈশিষ্ট্য খুঁজে বেড়াই। সেগুলো হলো–আচরণ, বচন, বসন, বিচরণ। চারটি মাত্রায় যদি কেউ উতরে যান, আমার কাছে তিনি স্নেহভাজন, শ্রদ্ধাভাজন হবেন। চারটি মাত্রায় না থাকলে আমার কাছে তার কণামাত্র মূল্য নেই। এ কথাগুলো বলছি এজন্য যে, শিক্ষা মানুষকে এই চারটি মাত্রায় আলোকিত করে, যা বাংলাদেশে এখনো নেই।
প্রারম্ভিক কথার পরে আরও একটি কথা আসে–বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের দ্রষ্টা। তবে এ কথাটি যখন বলি তখন আমাকে মেনে নিতে হবে যে, একজন মানুষ একা একা নেতা হয় না। তার অনুসারী লাগে, অনুগামী লাগে। বাংলাদেশের মানুষ তার অনুসারী এবং অনুগামী হয়েছিলেন বলেই তিনি ইতিহাসের একটি বাঁকবদল ঘটিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি শুধু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা নয়, বাংলাদেশ গড়ার একটি দিকনির্দেশনাও দিয়েছিলেন। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২, তিনি ১৭ মিনিটের এক ভাষণে স্পষ্ট করে বলেছিলেন যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। বাংলাদেশের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র; পরে জাতীয়তাবাদ যুক্ত হয়েছে। এই চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি এবং এই আদর্শ রাষ্ট্র কেমন হবে, তা স্পষ্ট করে বলা মুশকিল। পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্র আদর্শ কি-না, তা স্পষ্ট করে বলা যায় না।
তবে এটা ঠিক, বঙ্গবন্ধু মানুষের বসবাসযোগ্য একটি রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিলেন। সে কারণে শিক্ষার খোলসও পাল্টানো দরকার ছিল। কারণ ইংরেজ উপনিবেশ আমল এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ আমলে যে শিক্ষা ছিল, তা শিক্ষার প্রহসনমাত্র। তিনি ১৯৭২ সালের ২৮ মে শিক্ষা কমিশন করলেন, ড. কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন। ১৯৭৪ সালের ৩০ এপ্রিল তারা রিপোর্ট দিলেন। সেই রিপোর্ট দেওয়ার সময় কনিষ্ঠ সদস্য অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছিলেন যে, এখানে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে আপনি তা দেখে দিবেন। উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন যে, আমাদের স্যাররা যা করেছেন, তা পরিবর্তন করার অধিকার কি আমার আছে? এই কথা থেকেই বোঝা যায়–বঙ্গবন্ধু শিক্ষকদের কী পরিমাণ সম্মান করতেন।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ড. কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনে যে দিকনির্দেশনা দেওয়া ছিল, সেভাবে যদি বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা হতো, তাহলে বাংলাদেশের শিক্ষা আজ হ য ব র ল হতো না। যে কোনো সরকার আসলেই একটা লোক দেখানো অপচয় করে এমন শিক্ষা কমিশন করে। সর্বসম্মতিতে যে শিক্ষা কমিশন ২০১০ সালে হয়েছিল, তখন আমি সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছিলাম বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেলের সামনে। বলেছিলাম, যারা কমিশনে রয়েছেন তারা সম্মানিত এবং স্নেহভাজন ব্যক্তি; কিন্তু এই সদস্যবৃন্দ কোনোদিনও শিক্ষা নিয়ে ভাবেননি, বলেননি, লেখেননি। তার ফলে যা হওয়ার তা-ই হলো।
আমি নিজেও একটির সদস্য ছিলাম ১৯৯৭ সালে, ড. শামসুল হক শিক্ষা কমিশনে। কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের পর থেকে যতগুলো কমিশন হয়েছে, আমি আমি মনে করি বাংলাদেশে ওই একটিই কার্যকর শিক্ষা কমিশন হয়েছিল। এই একটি শিক্ষা কমিশনের দিক নির্দেশনা বাস্তবায়ন করলে আমরা অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারব শিক্ষায়। তবে কোনো সরকারই চায় না শিক্ষার যথার্থ উন্নতি হোক।
সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে একটি সংলাপ আছে, ছবিতে বলা হয়–যে যত বেশি জানে, সে তত কম মানে। কোনো সরকার শিক্ষিত মানবগোষ্ঠীকে নিয়ে স্বস্তিতে থাকতে পারেনা। সেজন্য লোক দেখানো অনেক কিছু করা হয়। যেমন–বর্তমানে আমরা দেখছি, মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকে গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়ার সংখ্যায় বিস্ফোরণ। আর তারাই যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়, যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘গ’ ইউনিটে ৮০ ভাগ ফেল করেছে। বুয়েটে ৩৩ ভাগ পাশ করেছে মাত্র। এবং যারা ফেল করেছে তাদের মধ্যে গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া পরীক্ষার্থী আছে। শিক্ষার নিম্নস্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত একটা হ য ব র ল অবস্থা চলছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে কার্যত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে বলা যায়, সেগুলো বিশ্বের বিদ্যালয় প্রাপ্ত হয়েছে। সেখানে উপাচার্য আছে বলে আমি মনে করি না, সবাই উপযাচক। আমার কাছে এমন মনে হয়েছে যে, বাংলাদেশে অর্বাচীনরাই ভিসি অথবা উপাচার্য হয়েছে। আমরা কথ্য ভাষায় ছাত্রজীবনে বলতাম ‘ক্ষ্যাত’। তারাই এখন উপাচার্য হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করছে। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়, মাধ্যমিক, প্রাথমিক স্তর শেষ করার শিক্ষক নাই। সবমিলিয়ে শিক্ষার খোলসও পালটানো দরকার।
পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের বৈষয়িক প্রবৃদ্ধি হয়েছে; কিন্তু শিক্ষা ধসে গেছে, রাজনীতি ধসে গেছে, সংস্কৃতি উধাও হয়ে গেছে। আজ সংস্কৃতি থাকলে, রাজনীতি থাকলে শিক্ষা এগুতো। বাংলাদেশে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উপাচার্য, প্রো-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের ক্ষেত্রে ভারতের মতো সার্চ কমিটি গঠন করা দরকার। সার্চ কমিটি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হতে হবে। সার্চ কমিটির সদস্য যারা, তারা যথার্থ শিক্ষিত মানুষ হতে হবে। পঞ্চাশ বছরে আমরা কিছুটা এগিয়েছি; কিন্তু অনেকটা পিছিয়েছি।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
শ্রুতিলিখন: শেহনাজ পূর্ণা
এসএ/