বিশেষ নিবন্ধ
বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতিদানের কৃতিত্ব ভারতের
আজকের দিনটি আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ দিনে প্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল একটি দেশ এবং সেটি ভারত। স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকেই তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন সরকার চেষ্টা করে আসছিল যেন বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
এটি শুধু ভারত না, ইউরোপের আরও বিভিন্ন দেশে আমরা চেষ্টা করে গেছি। তখন যে ডিপ্লোম্যাটিক একনলেজমেন্ট সৃষ্টি হয়েছিল, এতে সবাই চেষ্টা করছিল। তখন প্রথম স্বীকৃতিটি এল ভারতের কাছ থেকে। এর আগে যে স্বীকৃতি আসেনি, সেটিও অস্বাভাবিক ছিল না। কারণ–প্রথমদিকে যুদ্ধ এমন পর্যায়ে ছিল যে, পাকিস্তানি বাহিনী পুরো দেশ দখল করে নিয়েছিল।
তারপর জুলাইয়ের পর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে, অর্থাৎ প্রতিআক্রমণ জুলাইয়ের পর থেকেই শুরু হয়। আগস্ট সেপ্টেম্বরে তা আরও বেড়েছে। মোটামুটি অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে বিশেষ করে আগস্টে যখন ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন মৈত্রী চুক্তি হলো, এরপর বিষয়টি একটা ডেফিনিট দিকে এগুতে থাকল যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা একটা সময়ের ব্যাপার। ভারত তখন অনেকটাই নিরাপদ বোধ করছে। তার আগে পর্যন্ত ভারতের একধরনের একটা অনিরাপত্তাবোধ ছিল যে, চীন হয়তো সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে এবং আমেরিকার সঙ্গে ভারতের যে সম্পর্কটি ছিল, সেটিও অনেকটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে গেছে। কাজেই তখন তাদের কী অবস্থা দাঁড়াবে, তা নিয়ে তারা অনিশ্চয়তায় ভুগছিল। তবে ভারত মৈত্রী চুক্তির পর একটি নিশ্চয়তা এল ভারতের নিরাপত্তা নিয়ে এবং ভারত তখন একনিষ্ঠভাবে মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করে। তখন তাদের মধ্যে কোনো একসময় সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করা যাবে, এই বোধটা সৃষ্টি হয়েছিল।
যুদ্ধ তো শুরু হলো ৩ তারিখে। তার পরপরই যেহেতু জাতিসংঘে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভীত ছিল যুদ্ধবন্ধের বিরুদ্ধে, আমেরিকাও চেষ্টা করেছিল যুদ্ধ বন্ধ করে একটা সমাধানে যাওয়ার। আমরা জানি, পরপর তিনটি ভেটো দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, কাজেই তখন নিশ্চিতভাবেই ভারত এবং মুক্তিবাহিনীর সম্মিলিত যে শক্তি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পাকিস্তান বাহিনীকে পশ্চাদপসরণ করছে। স্বাধীনতা তখন মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেছে–পাকিস্তানের পরাজয় অবধারিত। সম্মিলিতবাহিনী, অর্থাৎ মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনী জয়ী হবেই।
এখানে একটি কথা আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এখানে মুক্তিবাহিনীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয়রা কিন্তু আশা করেনি যে, এত তাড়াতাড়ি তারা এগুতে পারবে। এটির কারণ মুক্তিবাহিনী;ভীষণভাবে দুর্বল করে ফেলেছিল পাকিস্তানি বাহিনীকে বিভিন্নভাবে তাদের গেরিলা আক্রমণের মাধ্যমে। সেটির কারণেই খুব তাড়াতাড়ি এই যুদ্ধ শেষ করা গেছে।
যুদ্ধটা শেষ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ পাকিস্তানের পক্ষে বেশ লোকজন ছিল, যারা চাচ্ছিল এটি কোনোভাবে ঠেকানো যায় কি-না! কিন্তু সম্মিলিতবাহিনী অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়েছে–মাত্র ১৩দিনের মধ্যে ঢাকায় পৌঁছে বিরুদ্ধ শক্তিকে পরাজিত করে ফেলা, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারত তখন নিশ্চিত যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে দিল। এতে করে অন্যান্য বিষয়ে স্বীকৃতি দানের বিষয়টি উন্মুক্ত হলো।
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করল এবং বাংলাদেশ সরকার সর্বময় সরকার গঠনের প্রস্তুতি গ্রহণ করল। তখন অন্যান্য দেশের জন্য অনেক সহজ ছিল স্বীকৃতি দেওয়া। কারণ আমাদের সঙ্গে অন্য দেশের সম্পর্ক না রাখার তো কোনো কারণ ছিল না। ধীরে ধীরে সব দেশই স্বীকৃতি দিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশকে। তবে প্রথম স্বীকৃতি নিশ্চয়ই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেদিক বিবেচনায় আজকের দিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক ইতিহাসে।
লেখক: সাবেক পররাষ্ট্র সচিব
অনুলিখন: শেহনাজ পূর্ণা
এসএ/