শক্তিপীঠ ট্যুরিজম সার্কিট
বিশ্বজনসংখ্যা রিপোর্ট ২০১৯ অনুযায়ী, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা ৭৭১.৫০ কোটি। এর মধ্যে সনাতন হিন্দু জনসংখ্যা প্রায় ১৩০ কোটি। শক্তিপীঠ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মহাপবিত্র ঐতিহ্যস্থান। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় ছড়িয়ে আছে এই ৫১টি শক্তিপীঠ। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস মতে, এই সকল শক্তিপীঠ দর্শন মহাপূণ্যের কাজ। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে রয়েছে ৬টি শক্তিপীঠ। পর্যটনস্থান হিসেবে এদের গুরুত্ব অপরিসীম, বিধায় এই দেশে সুপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা যায় একটি শক্তিপীঠ ট্যুরিজম সার্কিট। এই সার্কিট একটি বিপুল সংখ্যক মানুষকে ধর্মীয় পর্যটনে আকৃষ্ট করা যেতে পারে। এটি ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো থেকে অর্থনীতি পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে।
পর্যটনে ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যা শেষ পর্যন্ত মানব উন্নয়নে অবদান রাখে। ধর্মীয় আকর্ষণ সাংস্কৃতিক উপাদান এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ধর্মীয় পর্যটন এলাকা তীর্থস্থানের চেয়ে পর্যটনের মৌলিক ও অপরিহার্য উপাদান হিসেবে অধিক বলে বিবেচিত হয়। তীর্থযাত্রার একটি বস্তুগত এবং আধ্যাত্মিক মূল্য রয়েছে, যা ধর্মীয় তাৎপর্যের সঙ্গে জড়িত। ধর্মীয় পর্যটনে পর্যটকদের কেবল একটি নির্দিষ্ট ধর্মে বিশ্বাসকেই নির্দেশ করে না। সংস্কৃতির ধারণাটি ধর্মীয় পর্যটনকে মৌলিক প্রেরণার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করে। ধর্ম, সংস্কৃতির একটি অংশ হিসেবে, সাংস্কৃতিক সংরক্ষণে অবদান রাখতে পারে।
সত্যপুরাণ
সত্য যুগের কোনো এক সময়ে মহাদেবের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দক্ষ রাজা বৃহস্পতি এক যজ্ঞের আয়োজন করেন। কন্যা সতী দেবী তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যোগী মহাদেবকে বিবাহ করায় দক্ষ ক্ষুব্ধ ছিলেন। দক্ষ মহাদেব ও সতী দেবী ছাড়া প্রায় সকল দেব-দেবীকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। মহাদেবের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সতী দেবী মহাদেবের অনুসারীদের সঙ্গে নিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন।
কিন্তু সতী দেবী আমন্ত্রিত অতিথি না হওয়ায় তাকে যথাযোগ্য সম্মান দেওয়া হয়নি। অধিকন্তু দক্ষ মহাদেবকে অপমান করেন। সতী দেবী তার স্বামীর প্রতি পিতার এ অপমান সহ্য করতে না পেরে যোগবলে আত্মাহুতি দেন। শোকাহত মহাদেব রাগান্বিত হয়ে দক্ষর যজ্ঞ ভণ্ডুল করেন এবং সতী দেবীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রলয় নৃত্য শুরু করেন। অন্যান্য দেবতা অনুরোধ করে এই নৃত্য থামাতে। তবে বিষ্ণুদেব তার সুদর্শন চক্র দ্বারা সতী দেবীর মৃতদেহ ৫১ (একান্ন)টি খণ্ডে ছেদন করেন। এতে সতী মাতার দেহখণ্ডসমূহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পড়ে এবং পবিত্র পীঠস্থান বা শক্তিপীঠ হিসেবে পরিচিতি পায়।
ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় ছড়িয়ে আছে এই ৫১টি দেহখণ্ড। তন্মধ্যে বাংলাদেশে রয়েছে ৬টি। এরা হলো সুগন্ধা, চন্দ্রনাথ, জয়ন্তীয়া, শ্রীশৈল, ভবানী ও যশোরেশ্বরী শক্তিপীঠ। এই শক্তিপীগুলোর প্রত্যেকটিতে রয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উল্লেখযোগ্য হিন্দু মন্দির।
সুগন্ধা শক্তিপীঠ
বরিশাল জেলা শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে গৌরনদী উপজেলার শিকারপুরে সন্ধ্যা নদীর তীরে অবস্থিত। শ্রী বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র দ্বারা ছেদনের পর দেবী দাক্ষায়ণী সতীর নাসিকা এই স্থানে পতিত হয়। এখানে তিনি পূজিত হন দেবী সুগন্ধা রূপে এবং পাশে পূজিত হয় মহেশ্বর শিবের অবতার রূপ ত্র্যম্বক নামে।
চন্দ্রনাথ শক্তিপীঠ
চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড উপজেলায় চন্দ্রনাথ পর্বত শিখরে অবস্থিত। শ্রী বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র দ্বারা ছেদনের পর দেবী দাক্ষায়ণী সতীর ডান হাত এই স্থানে পতিত হয়। তিনি এখানে দেবী ভবানী রূপে পূজিত হন এবং পাশে পূজিত হয় মহেশ্বর শিবের অবতার রূপ চন্দ্রশেখর নামে।
জয়ন্তীয়া শক্তিপীঠ
সিলেট জেলার জয়ন্তীয়া উপজেলায় কালাজোড় গ্রামে অবস্থিত। শ্রী বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র দ্বারা ছেদনের পর দেবী দাক্ষায়ণী বাম জঙ্ঘা এই স্থানে পতিত হয়। এখানে তিনি পূজিত হন দেবী জয়ন্তী রূপে এবং পাশে পূজিত হয় মহেশ্বর শিবের অবতার রূপ ক্রমদীশ্বর নামে।
শ্রীশৈল শক্তিপীঠ
সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমা উপজেলায় শহর থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে জৈনপুর গ্রামে অবস্থিত। শ্রী বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র দ্বারা ছেদনের পর দেবী দাক্ষায়ণী গলা এই স্থানে পতিত হয়। তিনি পূজিত হন দেবী মহালক্ষ্মী রূপে এবং পাশে পূজিত হয় মহেশ্বর শিবের অবতার রূপ সম্বরানন্দ নামে।
ভবানী শক্তিপীঠ
বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলা থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে রতোয়া নদীর তীরে অবস্থিত। শ্রী বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র দ্বারা ছেদনের পর দেবী দাক্ষায়ণী বাম পায়ের নূপুর এই স্থানে পতিত হয়। এখানে তিনি পূজিত হন দেবী অপর্ণা রূপে এবং পাশে পূজিত হয় মহেশ্বর শিবের অবতার রূপ বামন নামে।
যশোরেশ্বরী শক্তিপীঠ
সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুরে অবস্থিত। শ্রী বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র দ্বারা ছেদনের পর দেবী দাক্ষায়ণী হাতের তালু ও পায়ের পাতা এই স্থানে পতিত হয়। এখানে তিনি পূজিত হন দেবী যশোরেশ্বরী রূপে এবং পাশে পূজিত হয় মহেশ্বর শিবের অবতার রূপ চণ্ড নামে।
ধর্মীয় পর্যটনের ক্ষেত্রে, একাধিক অনুপ্রেরণা সমানভাবে কাজ করে। ভোক্তা সংস্কৃতির প্রয়োজনীয়তা এবং নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার জন্যও এর গুরুত্ব অপরিসীম। সাংস্কৃতিক চাহিদাগুলি বিনোদনের প্রয়োজনের সঙ্গে জড়িত। তাই ধর্মীয় স্থান পরিদর্শন জ্ঞান বৃদ্ধি করে এবং ঐতিহ্য চেতনাকে শাণিত করে। ধর্ম হলো সমাজে শান্তির বড় প্রচারকারী উপাদান। মানুষের মধ্যে ধর্মীয় সহনশীলতা অন্যের বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা জানায়। শক্তিপীঠ ট্যুরিজম সার্কিট সমাজের মানুষের মধ্যে বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমে শান্তি আনবে যে, ধর্ম তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির ধারক। ধর্মীয় এলাকাকে পর্যটন গন্তব্যে পরিণত করা একটি চূড়ান্ত পদ্ধতি হতে পারে। ফলে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা হ্রাস পাবে, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করবে এবং কোনো বৈষম্য ছাড়াই সমস্ত বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের লোকেদের ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রসারিত হবে। ধর্ম, একটি বড় মিশ্রণ হিসাবে অর্থনীতি, সামাজিক সম্প্রীতি এবং পর্যটনের মাধ্যমে মানসম্পন্ন বিশ্বের জন্য সর্বজনীনভাবে কাজ করতে পারে। এটি আর্থ-সামাজিক বাস্তুস্থানের শক্তি ঘর হবে, যা শেষ পর্যন্ত ভবিষ্যতের মানবজাতিকে সংরক্ষণ করবে। এই যাত্রা বাংলাদেশ থেকে হলে ক্ষতি কী?
মোখলেছুর রহমান: রেক্টর, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্যুরিজম স্টাডিজ, ঢাকা
এসএন