বাজেট বিষয়ে একটি গাণিতিক সমাধান দরকার
বাজেটের মূল বিষয় হলো–বাজেট অবশ্যই বড় হবে। টাকার অঙ্ক আরও বড় হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি, বাজার বড় হচ্ছে। এখন আসল কথা হলো–বাজেট কোন খাতে কীভাবে বরাদ্দ হবে, কোন কোন খাতে খরচ করা হবে, আর কীভাবে রাজস্ব আদায় করা হবে, সেটা দেখতে হবে। অর্থ আদায়ের বিষয়ে যেটুকু সম্ভব কর আদায় বা ইনকাম ট্যাক্সের বোঝা না বাড়িয়ে, যতটুকু সম্ভব সহনীয়ভাবে রাজস্ব আদায় করা উচিত।
প্রত্যক্ষ কর আদায়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। দুঃখজনক হলো–বাংলাদেশ ভ্যাটের উপর নির্ভরশীল বেশি। ভ্যাট হলো পরোক্ষ কর। অনেকেই ঠিক মতো ট্যাক্স দেয় না। মানুষের উপর কর বোঝা মনে হওয়ার কারণে ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা আরও বাড়ছে। অনেকের টিন আছে, ট্যাক্স দেন না। সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে, লিকেজ যেন না হয়। ঘাটতি বাজেট তো হবেই। তবে তা যতটা সম্ভব দেশীয় উৎস থেকে নিতে হবে। বাইরের উৎস থেকে অর্থ নেওয়াটা এড়িয়ে যাওয়া উচিত। অধিক সুদে ঋণ না নিয়ে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সফট লোন বা স্বল্প সুদে ঋণ নেওয়াটা অধিক গ্রহণযোগ্য।
আমার মতে, সবচেয়ে জরুরি হলো স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা ও অবকাঠামো খাতে মনোযোগ দেওয়া। বাজেটে অবকাঠামো খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকে। অথচ আমাদের দেশে স্বাস্থ্যখাতে মাত্র পাঁচ শতাংশ ব্যয় করা হয়, যেটি মোটেও কাম্য নয়। এখন তো আরও বড় চ্যালেঞ্জ আসছে। সেখানে মাত্র পাঁচ শতাংশ তো একেবারেই কম। এটি বাড়াতে হবে। শুধু বাড়ানো নয়, সঠিক ব্যবহার করতে হবে–অপচয় যেন না হয়। দুর্নীতি যেন না হয়।
শিক্ষার ক্ষেত্রে ১২ শতাংশের মতো বরাদ্দ থাকে। আসল যে শিক্ষা খাতের উন্নয়ন, ক্লাসরুমের উন্নতি, শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়নসহ শিক্ষকদের ট্রেনিংয়ের ক্ষেত্রে অবহেলা দেখা যায়। আগে কিন্তু এ রকম ছিল না। আগে শিক্ষকদের ট্রেনিং ছিল আবশ্যক।
সবচেয়ে বড় একটা বিষয় হলো–সামাজিক সুরক্ষাবোধ। সামাজিক নিরাপত্তা। যেমন–বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধীদের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা, অবসরে পেনশন প্রদানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার বলে আমি মনে করি। সামাজিক নিরাপত্তার কথা বলা হলেও এটি আসলে এই খাতে ব্যবহার করা হয় না। যা বরাদ্দ থাকে, সেটিও সঠিক ব্যবহার হয় না।
কৃষি খাতেও কিন্তু প্রণোদনা অপেক্ষাকৃত কম। কৃষকদের মানোন্নয়নে আরও বেশি ভর্তুকি দিতে হবে। পেট্রল, ডিজেল, বিদ্যুৎ ইত্যাদির দাম বেড়েছে। অথচ তা কমানো দরকার ছিল।
রপ্তানি খাতেও দেখা যায় তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাতে প্রণোদনা বেশি থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্র যেমন–পাট, চামড়া, সিরামিক ক্ষেত্রে আরও প্রণোদনা দেওয়া দরকার। আমার মনে হয় এখানে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা রয়েছে।
বাজেটের ক্ষেত্রে আমি মনে করি, মানুষের সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে তাদের কীভাবে আরেকটু উন্নত জীবনযাত্রার অংশীদার করা যায়, সেটি খেয়াল রাখা খুব দরকার। আমাদের দেশে আয় এবং বণ্টনের বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। বেশিরভাগ কর্মকাণ্ডের সুফল ভোগ করে ধনী বা উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এগুলোতে কাউন্টার করতে হলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি এসব ক্ষেত্রগুলোতে ব্যালেন্স করতে হবে।
বাজেটকে উন্নয়নের জায়গা থেকে করতে হবে। এ উন্নয়ন হবে সাধারণ মানুষের উন্নয়ন। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান যেন উন্নত হয়। সাধারণ মানুষকে উপকৃত করতে হলে আয় বৈষম্য কমাতে হবে। সুষম উন্নয়নের দিকে বেশি নজর দিতে হবে। বাংলাদেশ গঠনের একটা মূল লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি। সে লক্ষ্য কতটুকু ফলপ্রসূ করতে পারছি? বাজেট তো এ লক্ষ্য অর্জনের একটি হাতিয়ার।
আমাদের বাজেট ইমপ্লিমেন্টেশন বা বাস্তবায়বন ঠিকভাবে হয়না বলেই বাজেট অনেক দুর্বল। বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প নেওয়া হয়; কিন্তু আমরা দেখি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কালক্ষেপণ। দুই বছরের প্রকল্প পাঁচ বছরে যায়, পাঁচ বছরেরটি আরও দীর্ঘমেয়াদি। ফলে এটার খরচ বেড়ে যায়। আমাদের বাস্তবায়নটা সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় আছে। আমার মনে হয় প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা এবং জবাবদিহিতা না হলে সেটি ফলপ্রসু হবে না।
সরকার যে আলোচনা করে তা শুধু শিল্প বা বনিক সমিতির প্রতিনিধিদের সাথে। সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নেই।
স্থানীয় পর্যায়ে যেসকল প্রতিনিধি আছে ,তাদের সাথে আলোচনা করতে হবে, তাদের মতামত নিতে হবে। এমপিরা বলে তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য এই লাগবে সেই লাগবে। তাতে কিন্তু মানুষের চাহিদার প্রতিফলন ঘটে না। সবচেয়ে দুর্বলতা হলো সংসদে যেটি আলোচনা হয়, সেটি মোটেও অর্থবহ না। কন্সট্রাক্টিভ আলোচনা সেখানে হয় না।
বাজেটের বিরুদ্ধে গঠনমূলক সমালোচনার জায়গাটি তো আর নেই বললেই চলে। সংসদ সদস্যদেরও দোষ আছে। বাইরে থেকে যেটুকু সমালোচনা হয়, সেটি আমলে নেওয়া হয় না। কাজেই বাজেট প্রণয়নের দিকটিও আমাদের আরও বেশি চিন্তাভাবনা করে করতে হবে। বাজেট বরাদ্দ এবং সমন্বয়ের বিষয়ে আরও বেশি নজর দিতে হবে। একটি গাণিতিক সমাধান দরকার। এত টাকা আয় করব, এত টাকা খরচ করব। তা না হলে বাজেট আসলে কোনোভাবেই অর্থবহ হবে না।
লেখক: সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
এসএ/