গুরুবাস পর্যটনের শিক্ষা দর্শন
গুরুগৃহ পৃথিবীর প্রাচীনতম শিক্ষাব্যবস্থা, যাতে শিক্ষার্থী ছিল কেবল শ্রোতা। অতপর কালক্রমে শিক্ষার্থীদের জীবনমুখী সক্রিয়তা দানের জন্য সার্বিক পাঠ, দর্শন ও ব্যবস্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাব্যবস্থার সর্বাধিক সজীব উপাদান হিসেবে মর্যাদা লাভ করে। শিক্ষার্থী শিক্ষাব্যবস্থার কেন্দ্রে অবস্থান করে ও এদের কেন্দ্র করে সমস্ত শিক্ষা কার্যক্রম আবর্তিত হয়।
শিক্ষা হলো সমস্ত প্রক্রিয়ার সমন্বয় যার দ্বারা ব্যক্তি তার সক্ষমতা, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধসহ সব রকম ব্যক্তিগত ও সামাজিক গুণের অধিকারী হয়ে ওঠেন। যার ফলশ্রুতিতে সর্বোত্তম আত্ম পরিস্ফূরণ সাধিত হয়। মানবাত্মার অন্তর্নিহিত শক্তির প্রগতিশীল বিকাশই শিক্ষা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় শিক্ষা দ্বারা অন্তরের আলোর সম্পদ অর্জিত হয়। শিক্ষা এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি নিরবচ্ছিন্ন ও জীবনব্যাপী জ্ঞান অর্জিত হতে থাকে। শিক্ষা এমন একটি কর্মযজ্ঞ যা একজন শিক্ষার্থী তার জ্ঞান, দক্ষতা, আদর্শ ও মূল্যবোধ প্রয়োগের মাধ্যমে অর্জন করে। হাল আমলে পর্যটন শিক্ষা ও পর্যটনের মাধ্যমে শিক্ষা সার্বিক শিক্ষার উৎকর্ষ সাধনে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অন্যদিকে দর্শন হলো সত্যের প্রতি ভালোবাসা। সত্যের অনন্ত অনুসন্ধানে সর্বজনীন জিজ্ঞাসাই দর্শনের লক্ষ্য। প্লেটোর মতে বহুবিধ বস্তু বা ঘটনার সঠিক প্রকৃতি সম্পর্কীয় জ্ঞানই দর্শন। অর্থাৎ বাস্তবতার যুক্তিসঙ্গত অনুসন্ধানই দর্শন। অনুসন্ধান, যুক্তি, নান্দনিকতা ও মূল্যবোধ দ্বারা দর্শন পরিচালিত হয়। সুতরাং উদ্দেশ্যগতভাবেই দর্শন ও শিক্ষা নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। দার্শনিকগণ তাদের নিজস্ব চিন্তা দ্বারা শিক্ষাব্যবস্থার রীতিনীতি ও তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে দৃষ্টিপাত করেন, যা পর্যটন শিক্ষার ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য।
দর্শনের মূল শাখাসমূহের মধ্যে নন্দনতত্ত্ব অর্থাৎ সৌন্দর্যের প্রকৃতি, শিল্প ও সত্যের ব্যক্তিগত ধরনের সৃষ্টি সংক্রান্ত গবেষণা; জ্ঞানতত্ত্ব অর্থাৎ জ্ঞান ও বিশ্বাসের প্রকৃতি এবং সুযোগ সংক্রান্ত দার্শনিক গবেষণা; নীতিশাস্ত্র অর্থাৎ নীতি, মঙ্গল ও মূল্যবান দার্শনিক গবেষণা; যুক্তি অর্থাৎ যুক্তির বৈধতা পরীক্ষা সংক্রান্ত দার্শনিক গবেষণা এবং অধিবিদ্যা অর্থাৎ প্রকৃতির অস্তিত্ব, সম্ভাবনা ইত্যাদির দার্শনিক গবেষণা। এর প্রত্যেকটি বিষয় মানুষকে শিখতে ও অনুশীলন করতে হয়। পর্যটনের মাধ্যমে স্থান, ব্যক্তি ও সময়ভেদে এইসব দর্শন শিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব। আবার পর্যটন কর্মকাণ্ডের ভেতরেও রয়েছে দর্শনের বহু শাখা, যার ভিত্তি পর্যটন নৈতিকতা পরিচালিত হয়।
এ কথা সবারই জানা যে, শিক্ষা ও দর্শন দুটি অবিচ্ছেদ্য বিষয়। হাল আমলে গবেষকগণ দাবি করছেন যে, শিক্ষা ও দর্শনের সঙ্গে পর্যটন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শিক্ষা ও দর্শনের লক্ষ্য হলো জ্ঞান ও অনুসন্ধান। পর্যটন ধারণার সকল বাস্তবসম্মত প্রয়োগ দ্বারা পর্যটন শিক্ষা পরিচালিত হয় এবং এর প্রয়োগকালে পর্যটনের অবয়ব অনেক বেশি সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়। এই লক্ষ্য নির্মাণের কাজটি করছে দর্শন, যাকে প্রাথমিকভাবে পর্যটন দর্শন বলে অভিহিত করা যায়।
শিক্ষা ও দর্শনকে মুদ্রার দুই পিঠ বলা হয়। দর্শন হলো চিন্তাশীল ও শিক্ষা হলো সক্রিয় পিঠ। নিজ বাসস্থানের বাইরে গিয়ে সম্পাদিত ইতিবাচক মানব কর্মকাণ্ডের যোগফলই পর্যটন। তাই এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে উৎপাদন, সুষম বণ্টন, দর্শন, সমাজকর্ম ও প্রকৃতি সংরক্ষণের প্রতিটি পদক্ষেপ।
শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম স্তম্ভ হলো শিক্ষক। শিক্ষক একাধারে প্রশিক্ষক, নির্দেশক, বন্ধু, দার্শনিক ও পথ প্রদর্শক। শিক্ষাব্যবস্থায় তিনিই নেতা, তার নেতৃত্ব দানের মাধ্যমে শিক্ষার্থী উপযুক্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। শিক্ষার লক্ষ্য, শিখন পরামর্শ এবং শিখন কর্মকাণ্ড ইত্যাদি শিক্ষক দ্বারাই পরিচালিত হয়।
আমরা সকলেই জানি যে, সমসাময়িক কালে মানুষের উপর সাম্যহীন কৃত্রিম ও করপোরেট ধারা চাপিয়ে দেওয়ার জন্য মানুষ ও সমাজ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। সমাজের মূল বুনটে ফাঁটল ধরেছে। তাই সময় এসেছে মানুষের জীবনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত জ্ঞান ও বৈচিত্র্যকে অনুসন্ধান করে তা দিয়ে সুখের নিবাস তৈরি করার। এই কাজের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসবে চিরন্তন গুণী মানুষেরা, যাদের গুরু বলে আখ্যায়িত করা যায়। গুরু দুইটি সংস্কৃত শব্দ থেকে জন্মলাভ করেছে। গু অর্থ অন্ধকার এবং রু অর্থ আলো। অন্ধকার থেকে আলোতে নিতে সক্ষম কোনো ব্যক্তি বা স্বত্ত্বাই গুরু। গুরুবাসের মাধ্যমে জীবন, সংস্কৃতি ও প্রকৃতির কাছ থেকে নতুন আঙ্গিকে শিক্ষা শুরু করা উচিত। এই শিক্ষা প্রক্রিয়ায় প্রগতিশীলতার মোড়কে উপস্থাপিত হবেন শস্যগুরু, মৎস্যগুরু, খাদ্যগুরু, ধর্মগুরু, শিল্পগুরু, গল্পগুগুরু, পর্যটনগুরু প্রমুখ।
গুরুবাস ধারণাটি স্থানীয় মানুষের জীবনধারা থেকে উৎসারিত। হাজার বছরের জীবনধারা, যাপনরীতি ও উদযাপনের আনন্দ নিশ্চিত করেছে যে, মানুষের এই সকল অনুশীলন টেকসই। গুরুবাস বঙ্গীয় জীবনধারার অভিজ্ঞতার নতুন দর্শনতত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুযায়ী সম্পদ, জ্ঞান ও মর্যাদা একীভূত হয়ে সমাজ জীবনে সমস্বত্ব প্রভাব তৈরি করতে পারে। সাধারণ মানুষের সকল অভিজ্ঞতাকে অন্যের চৈতন্য বিকাশে প্রয়োগের এক দর্শনতাত্ত্বিক চিন্তার আয়োজন এই গুরুবাস। এর মৌলিক চেতনা দায়িত্বশীল পর্যটনের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ও সমাজে বিশুদ্ধতা, স্থায়িত্ব ও সমৃদ্ধ ঐতিহ্য সংরক্ষণে প্রেরণা যোগাবে।
গুরু শিক্ষক থেকে আলাদা। গুরু নিজেকে সর্বজ্ঞ ভাবেন না। বরং তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শেখার লক্ষ্যে ব্রতী হন এবং পরিস্থিতি ও সময়েরর সঙ্গে শিক্ষাগুরু প্রয়োজনীয় অবদান রাখেন। শিক্ষার দর্শনের ভিত্তিতে পর্যটনগুরু নিচের বৈশিষ্টগুলির মাধ্যমে জীবনমুখী পর্যটন শিক্ষা প্রদান করবেন:
ক) পর্যটনগুরু কখনোই শিক্ষার্থীকে চাপ প্রদান করবেন না।
খ) গুরুর নিজের গুণেই জ্ঞান-বুদ্ধি বিকশিত হবে ।
গ) শিক্ষার্থীকে তিনি সুস্থির পরিকল্পনা মোতাবেক শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সহযোগিতা করেন।
পল্লি এলাকায় বসবাস করেন এমন অনেক গুণী মানুষ আছেন যারা জ্ঞান ও বোধ দিয়ে জীবন অতিবাহিত করছেন। নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রমের বাইরে থেকে জীবনের অর্জনগুলি নিশ্চিত করছেন। এরা উৎপাদন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, হস্তশিল্প, গান, নাচ, গল্পবলা ইত্যাদি নানাবিধ জীবনমুখী কর্মকাণ্ডের প্রয়োগ ও দক্ষতার উৎকর্ষ সাধনের সক্ষমতা দিয়ে নিজেদের অবস্থান নির্ণয় করতে পেরেছেন। গণ মানুষের ভেতর থেকে উঠে আসা এই সকল ব্যক্তিবর্গ হবেন গুরু এবং অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে জীবনের নির্যাস থেকে তরুণদের উদ্বুদ্ধ ও প্রস্তুত করবেন - এর নাম গুরুবাস পর্যটন। গুরুবাসের মাধ্যমে প্রকৃতির মাঝে থেকে প্রকৃতিভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম যা পর্যটনের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। এই শিক্ষার প্রতিটি পর্বে শিক্ষার্থীর মনে ও চিন্তায় সুস্থির শিক্ষা দর্শনের ছাপ সৃষ্টি করা হবে, যা শিক্ষার্থীকে সামাজিক ও চারিত্রিক অবক্ষয় থেকে বিরত রাখবে। একজন শিক্ষার্থী ভ্রমণকালে জীবনের প্রকৃত শিক্ষায় গুরুর সংস্পর্শে এসে ভবিষ্যৎ জীবনে তার পছন্দের কর্মের অনুসন্ধান করা এবং জীবন ও পৃথিবী সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা গ্রহণের মাধ্যমে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হবে। মূল্যবোধ, নীতিশিক্ষা, জীবনবোধ ও কর্মক্ষমতার বাস্তবতার নিরীখে শিক্ষার্থী নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে পারবে। উল্লেখ্য যে, শিক্ষার্থীরা ১৫-৩০ দিন পর্যন্ত গুরুদের বাসস্থানে বাস করবে।
গুরুবাসকালে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রাচুর্য বহির্ভূতভাবে সময় অতিবাহিত করবে এবং গুরুর নিকট থেকে তাত্ত্বিক নয়, বরং জীবনের বাস্তব বিষয়গুলি নিয়ে পাঠ গ্রহণ করবে। গুরুবাস যেহেতু এক ধরনের জীবনমুখী শিক্ষা পর্যটন। তাই তরুণ শিক্ষার্থীরা একে প্রচলিত শিক্ষার বাধাঁধরা চাপ থেকে মুক্ত হয়ে প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হবে। বিশেষত উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, সংযুক্তিমূলক উন্নয়ন প্রবৃত্তি, প্রাকৃতিক মূলধনের গুরুত্ব, সম্পদ ব্যবহার ও সংরক্ষণ রীতি, সামাজিক আচরণ, সাংস্কৃতিক চেতনাবোধ, ঐতিহ্য ইত্যাদি বিষয়ে গুরুমুখী জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে পারবে।
উপসংহারে এইটুকু বলা যায় যে, গুরুবাস পর্যটন কর্পোরেট শিক্ষা বাণিজ্যের এই দেশে পর্যটনের নতুন ধারা আমাদের, শিক্ষাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাকে অনেকটা কাটিয়ে উঠতে সহযোগিতা করবে। তবে সমাজের সকল মানুষকে এর মর্মার্থ ও দর্শনতত্ত্বে অনুধাবন করতে হবে। শিক্ষা ও পর্যটন বিষয়ক নীতি নির্ধারকগণ নিশ্চয়ই এসব নিয়ে ভাববেন।
সকল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, পাঠ্যক্রম প্রণয়নকারী ও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব যাদের ঘাড়ে, তাদেরও ভাবতে হবে বৈকি! আগামী দিনে যারা এই জাতিকে নেতৃত্ব দিবে, পথ দেখাবে তাদেরকে সৃজনশীল, উৎপাদনশীল ও গণমুখী না করতে পারলে হোয়াইট কলার জব দিয়ে রাষ্ট্রটাকে ধরে রাখা যাবে না। প্রকৃত শিক্ষার অভাবে ইতোমধ্যে জাতির যে অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে, বোধ করি একদিন তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
এই গুরুবাসকে কেন্দ্র করে গড়ে গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠবে পর্যটনের অভিনব দর্শনতাত্ত্বিক প্রকাশ গুরুবাস পর্যটন। সকল পর্যটকরা গুরুদর্শনকালে জেনে নিবেন জীবনকে অন্ধকার থেকে আলোতে নেওয়ার সেতু নির্মাণের কৌশল।
এসএন