বিশ্বব্যাপী ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেম হুমকির মুখে
ম্যানগ্রোভ বন হলো আশ্চর্যজনক ইকোসিস্টেম (বাস্তুতন্ত্র) যা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় উপকূলে বেড়ে ওঠে, যেখানে ম্যানগ্রোভগুলো লবণাক্ত জল এবং জোয়ারের পরিস্থিতিতে উন্নতি লাভ করে। ম্যানগ্রোভ বাস্তুতন্ত্র হল গ্রহের সবচেয়ে উৎপাদনশীল এবং জৈবিকভাবে বৈচিত্র্যময় বাস্তুতন্ত্র: তারা মাছ, হাঙ্গর, মানাটিস, কাঁকড়া এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল হিসেবে কাজ করে; সারা বিশ্বের সম্প্রদায়ের জন্য খাদ্য, চাকুরি এবং অন্যান্য সংস্থান প্রদান; এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিধ্বংসী প্রভাব থেকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কিছু উপকূলীয় সম্প্রদায়কে রক্ষা করা। যদিও ম্যানগ্রোভ বনগুলো আমাদের গ্রহের ভূমি পৃষ্ঠের মাত্র ০.১ শতাংশ জুড়ে। ম্যানগ্রোভ বন অন্য যেকোনো ধরনের বনের চেয়ে বেশি কার্বন সঞ্চয় করে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সমাধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
ম্যানগ্রোভ বনগুলো সাধারণত সুন্দরী, গেঁওয়া, কেওড়া, গরান ও গুল্ম উদ্ভিদ দিয়ে গঠিত যা উচ্চ লবণাক্ততা, উষ্ণ বায়ু এবং জলের তাপমাত্রা, চরম জোয়ার, কর্দমাক্ত, পলি-ভরা জল এবং অক্সিজেন শূন্য মাটির কঠোর অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে টিকে থাকে। পৃথিবীর ১০০টির বেশি দেশে ম্যানগ্রোভ বনের অস্তিত্ব থাকলেও বিশ্বের ম্যানগ্রোভ বনের প্রায় ৭৫ শতাংশ মাত্র ১৫টি দেশে পাওয়া যায়। এর মধ্যে এশিয়ায় ৪২ শতাংশ, আফ্রিকায় ২১ শতাংশ, উত্তর-মধ্য-আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে ১৫ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়া ও ওশেনিয়ায় ১২ শতাংশ ও দক্ষিণ আমেরিকায় ১০ শতাংশ রয়েছে। পৃথিবীর সমগ্র ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের ৪৩ শতাংশ ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া এবং নাইজারে অবস্থিত। ইন্দোনেশিয়া, ১৭০০০ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দ্বীপের একটি দেশ, এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনের আচ্ছাদন রয়েছে এই ইন্দোনেশিয়া। তারপরে ব্রাজিল, মালয়েশিয়া, পাপুয়া নিউ গিনি এবং অস্ট্রেলিয়া। ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। বাংলাদেশে অবস্থিত ম্যানগ্রোভ বন (সুন্দরবন) পৃথিবীর একক বৃহত্তর ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে পরিচিত। ম্যানগ্রোভ বন বিস্তৃত সুবিধা এবং গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও, ম্যানগ্রোভগুলো উদ্বেগজনক হারে ধ্বংস ও অবনমিত হচ্ছে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের চারপাশে, ম্যানগ্রোভ বনগুলোকে জলজ পালন: মাছ ও চিংড়ি পুকুর এবং অন্যান্য কৃষির পাশাপাশি উপকূলীয় নগর উন্নয়নের জন্য সাফ করা হচ্ছে। জলজ চাষ, কৃষি, শিল্প ও উপকূল নগর উন্নয়ন বৃদ্ধির সঙ্গে বিশ্বব্যাপী ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেম হুমকির মুখে।
বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় ১০,০০০ বর্গকিলোমিটার আয়তন জুড়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। এ বনের শতকরা ৬২ ভাগই বাংলাদেশে সীমান্তে। সুন্দরবন বিশ্বের অন্যান্য ম্যানগ্রোভ বনের থেকে বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ। জীববৈচিত্র্যের প্রাচুর্যতায় ভরা সুন্দরবন। এ বনে পৃথিবী বিখ্যাত ডোরাকাটা দাগ বিশিষ্ট রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, বানর, লোনাপানির কুমির, ভোদর, কাঁকড়া, চিংড়ি, অসংখ্য পাখিসহ কয়েকশত প্রজাতের মাছ ও অসংখ্য স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ এবং উভচর প্রাণীর আবাসস্থল। এ ছাড়াও ৩৫ প্রজাতি ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদসহ ৩০০’রও বেশি প্রজাতির উদ্ভিদের দেখা মেলে সুন্দরবনে। বাংলাদেশের মোট বনাঞ্চলের ৪০ শতাংশই সুন্দরবনে রয়েছে। ম্যানগ্রোভ (সুন্দরবন) বায়ুমন্ডল থেকে প্রচুর পরিমান কার্বন-ডাই-অক্সাইড টেনে নেয় এবং এ কার্বন ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের শরীরে জমিয়ে রাখে। জমিয়ে রাখা কার্বনকে 'ব্লু কার্বন' বলা হয়। উপকূল বনাঞ্চলের এই কার্বন গ্রহণের মাধ্যম প্রাকৃতিক উপায় আমাদের বায়ুমন্ডল থেকে দীর্ঘমেয়াদে কার্বন-ডাই-অক্সাইড সরিয়ে ফেলে বায়ুমন্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাব হ্রাস করে। এক হেক্টর কেওড়া বন বছরে ১৭০ টান পর্যন্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড আটকে রাখতে সক্ষম।
নাসার স্যাটেলাইট ডাটার তথ্যমতে, ম্যানগ্রোভ বনকে বলা হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কার্বন পরিশোধক। সুন্দরবনকে বাংলাদেশের ফুসফুস বলা হয়। সুন্দরবন বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্যের এক উল্লেখযোগ্য দিক হলো অনেক প্রজাতি-ই ম্যানগ্রোভ বনকে তাদের জীবনচক্রের কোন না কোন সময় ব্যবহার করে থাকে। সুন্দরবন হতে অতিরিক্ত কাঠ, মাছ আহরণের ও সাম্প্রতিক সময়ের ভয়াবহ সাইক্লোনের তান্ডবে এ বনাঞ্চল হুমকির সম্মুখীন। ২০০৭ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডরে সুন্দরবনের প্রায় ৪০ শতাংশ ক্ষতি সাধিত হয়। এছাড়াও, বাংলাদেশ উপকূলীয় অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ বন ভূমিক্ষয় ও ভাঙনের কারণে প্রতি বছর বনের আয়তন ৬ কি.মি হারাচ্ছে। এ ভাঙনের ফলে মানুষসহ উপকূলের বিভিন্ন প্রাণীও অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতি বছর বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। বঙ্গোপসাগর থেকে উপকূলের দিকে ধেঁয়ে আসা ঘূর্ণিঝড়ের সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় এই সুন্দরবন। ম্যানগ্রোভ বন এ সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগের গতিবেগ কমিয়ে মানুষের জীবন, মালামালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করে থাকে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের প্রতিরক্ষার দেয়াল সুন্দরবন।
আপনি এই বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করতে সাহায্য করতে পারেন। এর অনেক উপায় আছে। আপনার এলাকায় স্থানীয় সংরক্ষণ এবং সরকারি সংস্থাগুলো অনুসন্ধান করুন, যারা ম্যানগ্রোভ বন সংরক্ষণের জন্য কাজ করছে এবং তাদের সমর্থন করুন। ম্যানগ্রোভ বন উপকূলীয় সম্প্রদায়ের জন্য অপরিহার্য। ম্যানগ্রোভ বন ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষার বাস্তবতা বুঝে, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও আসন্ন পরিবেশ বিপর্যয় থেকে নিজেদের রক্ষায় সচল রাখতে ম্যানগ্রোভ বনায়নের বিকল্প নেই। প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এবং দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে ম্যানগ্রোভ বনের রক্ষণাবেক্ষণ করা আমাদের সকলেই দায়িত্ব। মনে রাখতে হবে, ম্যানগ্রোভ বস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ শুধু নতুন গাছ লাগানোর চেয়ে বেশি কিছু নয়।
লেখক: অ্যাম্বাসেডর, ইয়ুথলিড, ইউএসএইড ও প্রতিষ্ঠাতা, আর্থকেয়ার ফাউন্ডেশন