সময় ও পর্যটনের খেলা
পর্যটনকে তিনটি সময়ে ভাগ করা যায়। বর্তমান সময়ের পর্যটন, অতীতের পর্যটন ও ভবিষ্যতের পর্যটন। পর্যটনের উপাদানগুলো একমাত্রিক, দ্বিমাত্রিক কিংবা ত্রিমাত্রিক যা-ই হোক না কেন, সময় আরেকটি মাত্রা হিসেবে যোগ হয়েছে পর্যটনের সঙ্গে।
পদার্থবিজ্ঞানীরা বলেছেন, সময় সরলরৈখিক নয়, বরং সময় স্থান দখল করে থাকে। পর্যটনের সঙ্গে সময় ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বলেই সময়ের সঙ্গে পর্যটন উপাদানের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়।
পর্যটনের উপর সময়ের প্রভাব অত্যন্ত বেশি। তাই পর্যটনে পিক সিজন ও অফ পিক সিজন কথাগুলি প্রযোজ্য। সময়ের জন্য পর্যটন পণ্য সংরক্ষণ করা যায় না। পর্যটকদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে পর্যটন পণ্য ও সেবা উৎপাদন করে অবিলম্বে তা হস্তান্তর করতে হয়। পর্যটকরাও একে সংরক্ষণ করতে পারেন না। এদের চাহিদা সৃষ্টির অব্যবহৃত পরেই উপভোগও করতে চান। তা না হলে এইসব পণ্য ও সেবা নষ্ট হয়ে যায়। এ থেকে পরিষ্কার যে, পর্যটনের উপদান ও উৎপাদিত পণ্য ও সেবার সঙ্গে সময় নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত।
আবার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের পর্যটনের সঙ্গে সময় একইভাবে সম্পৃক্ত থাকে না। তবে সময়যন্ত্রে চেপে এই তিন সময়ের পর্যটনের অবস্থা প্রত্যক্ষ করা যায়। বর্তমানের পর্যটন দেখতে হলে প্রচলিত যানবাহনের ব্যবহারই যথেষ্ট। তবে অতীতে কিংবা ভবিষ্যতে যেতে হলে পর্যটনের সময়যন্ত্র লাগবে। অতীতে যাওয়ার সময়যন্ত্র এবং ভবিষ্যতে যাওয়ার সময়যন্ত্র এক নয়, ভিন্ন। কারণ, এই দুই সময়যন্ত্রের চালক ও আরোহী আলাদা। অতীতে গমনকারী পর্যটনের সময়যন্ত্রের চালক হলো সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান এবং আরোহী হলো পর্যটক। অন্যদিকে ভবিষ্যতে গমনকারী পর্যটনের সময়যন্ত্রের চালক পর্যটন গবেষক এবং আরোহী হলো নীতিনির্ধারক, রাজনীতিবিদ ও বিনিয়োগকারী। আবার তাদের গতি, অনুসন্ধানরীতি ও পর্যবেক্ষণের কৌশলও এক নয়। উভয় ধরনের সময়যন্ত্রের নির্মাণ, পরিচালনা ও ব্যবহারের উদ্দেশ্য আলাদা হয়ে থাকে।
পর্যটনের সময়যন্ত্রে চেপে অতীতকালের পর্যটনকে অবলোকন করতে না পারলে বর্তমান সময়ের পর্যটকরা পর্যটনের রসাস্বাদন করে তা থেকে বহুমাত্রিক উপকার লাভ করতে পারবেন না। একইভাবে ভবিষ্যৎ সময়ে যেতে না পারলে পর্যটনের ভবিষ্যতের গতি প্রকৃতি নির্ধারণ করাও কঠিন হয়ে পড়বে। ফলে পর্যটনের গতিময়তা কমে যাবে এবং স্থবিরতা চলে আসবে।
দুই
এবার পর্যটনের সঙ্গে বর্তমান সময়ের অন্তঃপ্রবেশ রীতি ও ফলাফল নিয়ে আলোচনা করা যাক। একথা সত্য যে, সময় পর্যটনের ভেতর দিয়ে চলে এবং একইভাবে পর্যটনও সময়ের ভেতর দিয়ে চলে। বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক।
সময় পর্যটনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হলে সে পর্যটনকে তীরবেগে ভেঙে দিয়ে যায়। সময়ের তোড়ে পর্যটনের আকৃতি, অবয়ব ও উপযোগিতার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ফলে তা পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে কিংবা চাহিদা মোতাবেক সেবাদানে ব্যর্থ হতে পারে। তবে রিয়েলিটি পর্যটনের বিষয় বিবেচনা করলে তা ভিন্ন কোনো ধনাত্মক ঘটনাও সৃষ্টি করতে পারে। পর্যটনের ভেতর দিয়ে সময়ের এই প্রবাহকাল, গতি ও বেগ বিবেচনা করতে হবে। সময়ের প্রবাহকাল দীর্ঘ এবং গতি ও বেগ উচ্চ হলে পর্যটনের আকৃতি, অবয়ব ও উপযোগিতার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে। সেই ক্ষেত্রে সময়ের ঘাত মোকাবিলা ও নিয়মিতভাবে পর্যটনের উপাদানগুলির ব্যবহারের প্রতি অত্যন্ত যত্নশীল হতে হবে। একইভাবে সময়ের ভেতর দিয়ে পর্যটন গমন করলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পর্যটন তার নিজস্ব অবয়ব পরিবর্তন করতে পারবে। সময়ের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে পর্যটনের অবয়ব ও উপযোগিতা সক্ষম হবে। পর্যটন পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে চলার সক্ষমতা অর্জন করবে। ক্ষেত্রমতে পর্যটনে নতুন নতুন উদ্ভাবন দেখতে পাওয়া যাবে। গবেষক ও পর্যটন স্টেকহোল্ডারগণ যৌথভাবে চাহিদা নিরূপণ ও বহুমুখী উপায়ে তা পূরণের নতুন পথ খুঁজে বের করবেন। এই ধরনের কার্যকলাপের জন্য বাস্তবে পর্যটনের মাত্রাগত ও গুণগত উন্নয়ন সাধিত হয়।
পর্যটন ও সময়ের অনুপ্রবেশ অনিবার্য। এ থেকে পর্যটনের মুক্তি নেই। ফলে একটি সমস্বত্ত্ব বিন্দু (Equilibrium Point) নির্ণয় করা দরকার। অর্থাৎ পর্যটনের ভেতর দিয়ে সময়ের প্রবাহ ও সময়ের ভেতর দিয়ে পর্যটনের প্রবাহ এমন একটি বিন্দুতে এসে মিলিত হবে, যা হবে এই ২ প্রবাহরেখার মিলিত বিন্দু। এই সমস্বত্ত্ব বিন্দুতে পর্যটনের সবচেয়ে কম পরিবর্তনকে চিহ্নিত করা যাবে একইভাবে সংঘটিত ঋণাত্মক বিষয়গুলিকে মোকাবিলা করা সহজ হবে। এই বিন্দু বিশ্লেষণ করে পর্যটন গবেষকরা পর্যটন পরিবর্তনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক বিষয়গুলি তুলে ধরতে পারেন। একইভাবে উদ্ভুত সংকট মোকাবিলায় তারা সঠিক পথকে আগাম ধরিয়ে দিতে পারবেন। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী নীতি-নির্ধারকমহল ও পর্যটন পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তাদের করণীয়গুলি জেনে যাবেন। পর্যটনের সম্পদ ব্যবস্থাপনা, মানবসম্পদ সৃজন পরিকল্পনা, বিনিয়োগ ক্ষেত্র ইত্যাদি সমস্বত্ত্ব বিন্দু থেকে নির্ণয় করা সম্ভব।
সময় ও পর্যটনের এই নিরন্তর খেলা আমাদের জীবনের সব উপাদান নিয়ে প্রস্তুতির জন্য বড় ইঙ্গিত দেয়। পর্যটনের মাধ্যমে দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সম্পদের সর্বোচ্চ ও টেকসই ব্যবহার কীভাবে নিশ্চিত করা যায় এবং সম্পদ ব্যবহারের ভারসাম্য রক্ষা করা যায়- তার সব বিষয় এখান থেকে অনুসন্ধান করা যায়।
লেখক: রেক্টর, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্যুরিজম স্টাডিজ, ঢাকা।
এসএন