ফেসবুকে ইংরেজি শেখানোর ধুম, আসলে কতটা কার্যকরী?
ইংরেজি আমরা সব সময় রহিম, করিম দিয়ে বাক্য শুরু করি, শিক্ষার্থীদের শেখাই। কিন্তু একটি বাক্যের বড় একটি অংশ, একটি ফেইজ, একটি ধারণা বাক্যের অংশ হয় এবং এ ধরনের ইংরেজিই বেশি। শিক্ষার্থীরা কিন্তু তাদের শিখে যাওয়া গ্রামার ট্রান্সফার করতে পারছে না। তারা ওই ধরনের বাক্য পড়ে বুঝতে পারছে না এবং নিজেরা লিখতে পারছে না। ইংরেজি পত্রিকার কোনো সংবাদ, কিংবা কোনো আর্টিকেল কিংবা বিদেশি বইয়ের কোনো গল্প পড়ে দেখলে এর সত্যতা পাওয়া যায়। মূল ইংরেজি কিন্তু সেগুলোই। আমাদের বারটি টেন্স আর ভয়েস, ন্যারেশন, সিম্পল, কমপ্লেক্স আর কম্পাউন্ড বাক্য পড়িয়েই আমরা ধরে নেই ইংরেজি যথার্থভাবে পড়ানো হয়েছে এবং হচ্ছে।
অনেক শিক্ষক বলে থাকেন যে, প্রতিদিন দশ বিশটা শব্দ মুখস্থ করতে হবে। এভাবে শিক্ষার্থীদের পুরো ডিকশনারি মুখস্থ করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এটিও বিজ্ঞানসম্মত নয়। কারণ ভোকাব্যুলারি বাড়াতে হবে ভাষা ব্যবহার করার জন্য। তারও কিছু গ্রামার আছে, নিয়ম-কানুন আছে, শুধু শব্দ মুখস্থ করে বসে থাকলে হবে না। কোন শব্দ কোথায় বসাতে হবে এটিই হচ্ছে প্রধান কাজ। শব্দ বাক্যে বসাতে না পারলে সেই ভোকাব্যুলারি ইনঅ্যাকটিভ। ভোকাব্যুলারি শিখতে হয় কনটেক্সট থেকে, বাক্যের অর্থ মুখস্থ করে নয়। সেটি একটি দুর্বল পদ্ধতি। মাইমিং, অ্যাক্টিং, ব্যাখ্যা, সিনোনিম, অ্যান্টোনিম, রিয়ালিয়া (বাস্তব জিনিস প্রদর্শন), ইনফারেন্স ইত্যাদি মাধ্যমে ভোকাব্যুলারি শিখতে হয়, শেখাতে হয়। সরাসরি ট্রান্সলেশন বা ইংরেজি থেকে বাংলা ব্যবহার করে ভোকাব্যুলারি শেখা বা শেখানো সর্বশেষ পদ্ধতি। ফেসবুকে দেখছি শিক্ষক নিজেই সব শব্দের অর্থ বাংলায় বলে দিচ্ছেন, শিক্ষার্থীদের দ্বারা বলাচ্ছেন না, তাদের বলতে সময়ও দিচ্ছেন না। এটি ভোকাব্যুলারি শেখানোর সঠিক পদ্ধতি নয়। ভোকাব্যুলারি গ্রামারের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারণ গ্রামার জেনে একটি বাক্য তৈরি করা, ভাষা ব্যবহার করা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু প্রয়োজন মেটানোর জন্য শব্দ জানা থাকলে প্রয়োজন অনেকটাই মেটানো যায়। যেমন আপনার যদি পানির পিপাসা পায় এবং পানির ইংরেজি যে, ওয়াটার এটি জানা থাকলে আপনি হাত ইশারা করে বলতে পারেন , ওয়াটার’। পুরো বাক্য আই অ্যাম থার্স্টি, আই নিড টু ড্রিংক ওয়াটার না বললেও বিদেশে গিয়ে আপনি এটি ব্যবহার করতে পারেন।
ভাষা শেখার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের পারসোনাল এনগেজড হতে হয় অর্থাৎ নিজেদেরকেই বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে হয় অথচ ফেসবুকে যেসব শিক্ষক ইংরেজি স্পোকেন শেখাচ্ছেন— দেখলাম অবিরাম তারাই কথা বলে যাচ্ছেন, কথা বলতে বলতে ঘাম ঝরাচ্ছেন। টিচার টকিং টাইম বা টিটিটি এবং স্টুডেন্ট টকিং টাইম সম্পর্কে শিক্ষকদের ধারণা থাকতে হয়। স্টুডেন্ট টকিং টাইম হতে হবে সত্তর কিংবা আশি শতাংশ, বাকিটা হবে টিচার টকিং টাইম। অর্থাৎ টিচারদের কথা কম বলতে হবে, শিক্ষার্থীরা কথা বলবে যদি তারা ভাষা শিখতে চায়। এই নিয়ম অনুসরণ করার ধারেকাছেও নেই ফেসবুকে যারা এ জাতীয় ভিডিও আপলোড করছেন প্রতিদিন।
ইংরেজি আমরা কেন শিখব? আমাদের শিক্ষার্থীরা আসলে বাস্তবে জানে না তারা ইংরেজি কেন পড়ছে? তারা জানে যে, ইংরেজিতে পাস করতে হবে, এক শ্রেণি থেকে পরবর্তী শ্রেণিতে উঠতে হবে, এটিই তাদের কাছে জানা, তাদের লক্ষ্য। বাস্তব জীবনে যে ইংরেজি তাদের বিভিন্ন জায়গায় কাজে লাগবে, ভাল ইংরেজি শিখলে সেটি যে সারা জীবন তার এক বিরাট সম্পদ হয়ে থাকবে সেটি কিন্তু তারা ছাত্রজীবনে বুঝতে পারে না, বুঝার কথাও নয়। শিক্ষকদের দায়িত্ব হচ্ছে বিষয়টি তাদের ধরিয়ে দেওয়া ও উৎসাহিত করা। আমরা যারা ছাত্রজীবন পার করে এসেছি এবং বাস্তব জীবনের পদে পদে ইংরেজি ব্যবহার করতে হচ্ছে কিন্তু ব্যবহার করতে পারছি না। কারণ ছাত্রজীবনে সেভাবে আমাদের ইংরেজি শেখা হয়নি। আমরা গ্রামারের কিছু নিয়ম তাও বাংলায় শুনেছি ক্লাসে।
আমরা একটি বিষয় লক্ষ্য করেছি যে, বর্তমানযুগে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক, পছন্দ করে হোক, না করে হোক ভারতীয় হিন্দি ছবি, নাটক, বিজ্ঞাপন ইত্যাদি প্রতিনিয়ত টিভির পর্দায় দেখছে আর কানে শুনছে। এই শুনে শুনে এবং দেখে দেখে তারা হিন্দি বলা শিখে ফেলেছে অর্থাৎ তারা ভাষার দুটো গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা ‘শোনা ও বলা’ অর্জন করে ফেলেছে। তারা ভারতে যায়নি, স্কুলে যায়নি, হোমওয়ার্ক করেনি, কোনো কোচিং সেন্টারে যায়নি, কোনো প্রাইভেট টিচারের কাছে যায়নি হিন্দি শিখতে। জীবনে কোনো পরীক্ষা দেয়নি, পাবলিক পরীক্ষা দেয়নি। কিন্তু হিন্দি বলতে পারে, হিন্দি শুনে বুঝতে পারে অর্থাৎ তারা দুটো গুরুত্বপূর্ণ স্কিল অর্জন করে ফেলেছে। অথচ ইংরেজি আমরা ক্লাসে পড়ি, বাসায় পড়ি ও পড়াচ্ছি, কোচিংএ পড়াচ্ছি, প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ছি, ক্লাসে পরীক্ষা দিচ্ছি, প্রাইভেট টিউটরের কাছে পরীক্ষা দিচ্ছি, কোচিং এ পরীক্ষা দিচ্ছি, প্রাইভেট টিউটরের কাছে পরীক্ষা দিচ্ছি, পাবলিক পরীক্ষা দিচ্ছি সার্টিফিকেট অর্জন করছি কিন্তু হিন্দির মতো ইংরেজি বুঝি না, বলতে পারি না। কারণগুলো কি কি হতে পারে?
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলছি— কারণগুলো তোমরা নিজেরাই বের করে দেখ। তোমরা কি চাও না হিন্দিতে যেভাবে কথা বলতে পার, হিন্দি শুনে যেভাবে বুঝতে পার ইংরেজিতেও তোমারা সেভাবেই পারবে? শিক্ষক এবং অভিভাবক হিসেবে আমরা যদি ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের সামনে রঙিন ছবি ও আকর্ষণীয় অ্যাক্টিভিটি করাতে পারি তাহলে তারা তাদের অজান্তেই ইংরেজি ভাষা শেখা শুরু করবে যেমনটি তারা হিন্দি সিনেমা দেখে হিন্দি শিখে ফেলেছে।
ভাষা শেখাতে হবে ভাষা দিয়ে, গ্রামারের নিয়ম মুখস্থ করিয়ে নয়। দু-চার-দশ কিংবা ডজন খানেক বা ডজন দুয়েক গ্রামারের নিয়ম হয়ত মুখস্থ করানো যায়, তা দিয়ে কি একটি ভাষা ব্যবহার করানো বা শেখানো যায়? ভাষা তো সাগর। আমরা প্রতিদিন কত শত কিংবা কত হাজার বাক্য বাংলায় ব্যবহার করি, তার কোনো হিসেব আছে? এটি হচ্ছে স্বাভাবিক নিয়মে শেখা বা শেখানো বা ব্যবহার করা। এখানে যদি কাঠের সাঁকো পাড়ানোর মতো হিসেব করে করে, সাবধানে পা ফেলি অর্থাৎ বাক্যে প্রথম কর্তা বসালাম, তারপর ক্রিয়া বসালাম, তারপর কর্ম বসালাম তাহলে কি আমরা এত সহজে বাংলা কথা বলতে পারতাম প্রতিদিন? স্বত:স্ফূর্তভাবে ভাষা ব্যবহার করতে হয়, বাংলা ভাষাকে যেভাবে ব্যবহার করি, ইংরেজিও সেভাবে ব্যবহার করতে হবে। সেটি যতক্ষণ করা না যাবে ততক্ষণ বুঝতে হবে বিষয়গুলো সঠিকভাবে শেখা হয়নি, শেখানো হয়নি।
শিক্ষার্থীরা ভাষা ব্যবহার করবে, ব্যবহার করে করে যখন ভাষাটি নিজেদের আয়ত্বে চলে আসবে, তখন আলোচনা করা যেতে পারে যে, বাক্যগুলো বিশ্লেষণ করলে আমরা কী পাই অর্থাৎ কীভাবে বাক্যটি তৈরি হলো। শিক্ষার্থীরা বিভিন্নভাবে বলবে অর্থাৎ মুখস্থ করে নয়, তারা দেখে , লজিক বের করবে কীভাবে বাক্যটি তৈরি হলো। তারা যেভাবেই বলুক দেখতে হবে তারা সঠিক বলছে কিনা অর্থাৎ বাক্যের প্রথমে সাবজেক্ট তারপর ভার্ব বসেছে ইত্যাদি। গ্রামার তারা আবিষ্কার করবে, তারা ব্যাখ্যা করবে, শিক্ষক নয়। শিক্ষক সবার শেষে একটি ফিনিশিং দিতে পারেন যে, তোমরা বাক্যগুলোর গঠনপ্রণালী যেভাবে বলেছ ঠিক আছে। শিক্ষক আগে স্ট্রাকচার শিখিয়ে সেই অনুযায়ী বাক্য গঠন করার প্রক্রিয়া শেখানো সেকেলে প্রক্রিয়া এবংতাতে শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে যাদের মাতৃভাষা ইংরেজি নয় তাদের পক্ষে ভাষা শেখার ও ব্যবহার করার প্রক্রিয়া অত্যন্ত সীমিত করে দেওয়া হয়।
লেখক: প্রেসিডেন্ট, ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)
আগের পর্বটি পড়ুন>>>
প্রথম পর্ব/ফেসবুকে ইংরেজি শেখানোর ধুম, আসলে কতটা কার্যকরী?
আরএ/