সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকে বড় ধরনের টানাপোড়েন লক্ষণীয়
করোনা সময়কালে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে অর্থাৎ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের একটি চ্যালেঞ্জ ছিল এবং সেটি বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচকভাবেই প্রতিভাত মনে হচ্ছিল। যদিও সেই সময়কালে ধীরে ধীরে কাঁচামাল ও জ্বালানি তেলেরও মূল্যবৃদ্ধি হয়।
যেহেতু বিশ্বব্যাপী সবাই পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল এবং বিশ্বব্যাপী প্রবৃদ্ধির যে ফোকাস সেটিও উচ্চমাত্রায় ধরা হয়েছিল, সেই প্রেক্ষাপট সহজেই পরিবর্তিত হয়ে যায় ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে। শুরুতে যুদ্ধটিকে যতটা সাময়িক হিসেবেই মনে হয়, ক্রমান্বয়ে সেটি দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। জটিল হচ্ছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যুদ্ধ শুরুর দিকে অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া যতটা ভাবা হচ্ছিল, স্থানীয় পর্যায়ে অর্থাৎ মনে করা হয়েছিল ইউক্রেন রাশিয়া পর্যায়েই সেটি হয়ত সীমিত থাকবে। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই সমস্যার গতি-প্রকৃতির প্রভাব উন্নত দেশগুলোকে প্রভাবিত করছে। সবচেয়ে বেশি যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তারা হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলো এবং বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
বাংলাদেশ যেহেতু আমদানি নির্ভর দেশ, বিশেষ করে জ্বালানিক্ষেত্রে ও খাদ্য শস্যের ক্ষেত্রেও আমরা আমদানি নির্ভর। দুটি ক্ষেত্রেই রাশিয়া যেহেতু অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বেশ টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, সবকিছু মিলে এ যুদ্ধের ভুক্তভোগী হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশ— তার ভেতরে বাংলাদেশ অন্যতম।
বাংলাদেশ সম্পর্কে যেসব ইতিবাচক প্রক্ষেপণ অথবা পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছিল, সে সমস্ত প্রক্ষেপণ ও পূর্বভাসগুলো ধীরে ধীরে দুর্বল হতে শুরু করছে। আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতি কোভিডের পরে এত টানাপোড়েনের মধ্যেও মোটামুটি একটি স্থিতিশীল জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছিল। কিন্তু কোভিড পরবর্তী যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আমরা সামষ্টিক অর্থনীতির যে বড় বড় সূচকগুলো সেই সূচকগুলোতে বড় ধরনের টানাপোড়েন হচ্ছে। এর ভেতরে মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং রিজার্ভ কমে আসা, ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান অব্যাহতভাবে হারানো, একইসঙ্গে শিল্পখাতে সরবরাহ সংকট, জ্বালানি সরবরাহ সংকট, আবাসিক ক্ষেত্রে গ্যাসের ও বিদ্যুতের সরবরাহ সংকট সবকিছু মিলিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকের দিক থেকে উৎপাদন প্রবৃদ্ধি এবং মানুষের প্রকৃত আয় সবগুলোর ক্ষেত্রে একধরনের অবদমন দেখা যাচ্ছে। এরকম প্রেক্ষাপট শুধুমাত্র বাংলাদেশ কেন্দ্রিক তা কিন্তু নয়। এ ধরনের প্রেক্ষাপট অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও কম বেশি একই রকমের প্রক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
রিজার্ভের সংকটটি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রায় বড় আকারে আসছে। রিজার্ভের সংকটও অনেক দেশেই রয়েছে। একইসঙ্গে প্রতিটি দেশের মুদ্রামান অতিমাত্রায় শক্তিশালী হয়ে যাওয়ার কারণে দুর্বলতর হয়েছে। যেহেতু এই সংকটের বড় অংশই বহিঃস্থ উৎস থেকে উৎসারিত। এ ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষে এই সংকট নিরসন সহজ নয়। বরং সরকারের অভ্যন্তরীণ ইন্সট্রুমেন্টগুলোকে কাজে লাগিয়ে সংকট সীমিত রাখার চেষ্টা করা যেতে পারে। সেদিক থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি সরকারের বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সরকার নিয়েছে, এর ভেতরে জ্বালানি সংকটের বিপরীতে না গিয়ে জ্বালানির ব্যবহার কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে, গ্যাসের সেশনগুলোর সময়কাল কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
একইসঙ্গে ডলারের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ডলারের যেহেতু স্থিতিশীল পরিস্থিতি নেই বরং সংকট তৈরি হয়েছে। সেদিক থেকে সরকার ডলারের ব্যবহার কমানোর জন্য আমদানিকৃত যে সমস্ত বিলাসী পণ্য প্রায় একশর উপরে যেগুলোর উপরে বাড়তি রেগুলেটরি ডিউটি আরোপ করেছেন। একইসঙ্গে সরকারি কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণকে নিরুৎসাহিত করার বিষয়ে প্রথমে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল সেটি এখন সীমিত আকারে উন্মুক্ত করা হয়েছে।
লেখক: সিপিডির গবেষণা পরিচালক
আরএ/