বাড়ছে বায়ু দূষণজনিত রোগ-ব্যাধি, করণীয় কী?
বিভিন্ন প্রক্রিয়া বায়ু দূষণ ঘটায়। বিভিন্ন ধরনের পরিবহনে ব্যবহৃত জ্বালানি বায়ু দূষণের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। এ ছাড়া শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত জ্বালানি থেকে উৎপন্ন বিভিন্ন বিষাক্ত গ্যাস এবং শহরের আবর্জনা থেকে উৎপন্ন গ্যাস বায়ু দূষণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন ধরনের মোটরযান, অ্যারোপ্লেন এবং মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা রকেট বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ।
ক্রমবর্ধমান নগরায়নের ফলে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখন নগরবাসী। নগরে বসবাসরত জনসংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। নগরের জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন পরিবহনের সংখ্যাও বাড়ছে। উন্নত বিশ্বসহ আমাদের দেশেও বিভিন্ন পরিবহনের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। বিশেষ করে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মোটর গাড়ি থেকে বাতাসে মিশ্রিত দূষকগুলো হলো— কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার অক্সাইড, হাইড্রোকার্বন এবং অন্যান্য পদার্থ কণা। এ ছাড়া গ্যাসোলিনের গুণমান উন্নত করার জন্য সীসা যোগ করা হয় বলে বাতাসে সীসা দূষণও বাড়ছে। আবার হাইড্রোকার্বন, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড এবং কার্বন মনোক্সাইড বিমান ও রকেট থেকে নির্গত ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে গিয়ে বায়ু দূষণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপরের দূষকগুলো মানুষ, গাছপালা এবং প্রাণীর জন্য খুবই ক্ষতিকারক। নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করে এবং গাছপালা ধ্বংস করে। হাইড্রোকার্বন সূর্যালোকের সঙ্গে মিলিত হয়ে নাইট্রোজেন-ডাই-অক্সাইড হয়ে কুয়াশা তৈরি করে যা মানুষের চোখের জন্য ক্ষতিকর। চোখ জ্বালা করার পাশাপাশি, এটি ফুসফুসের ক্ষতি, মাথাব্যথা, অম্বল, শ্বাসকষ্ট, বমি বমি ভাব, গলা ব্যথা ইত্যাদির কারণ হয়। কার্বন মনোক্সাইড মানবদেহে লোহিত রক্ত কণিকায় অক্সিজেন শোষণে বাধাগ্রস্ত করে এবং স্নায়বিক ও কার্ডিয়াক সমস্যা সৃষ্টি করে। নাইট্রোজেন এবং সালফার অক্সাইড ফুসফুসের ক্ষমতা হ্রাস করে এবং বিভিন্ন জটিল রোগের সৃষ্টি করে।
বায়ুতে সীসা দূষণ রক্তসঞ্চালন, প্রজনন ও মূত্রতন্ত্রের কার্যকারিতা এবং শিশুদের শেখার ক্ষমতাকে ব্যাহত করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবহন জ্বালানি থেকে নির্গত কিছু বিষাক্ত গ্যাস অনিরাময়যোগ্য রোগ ক্যান্সার সৃষ্টি করে। জ্বালানি পোড়ানো গাছের সালোকসংশ্লেষণ ক্ষমতা হ্রাস করে এবং হাইড্রোকার্বন গাছের বৃদ্ধিকে বাধা দেয়।
সালফার ডাই-অক্সাইড এবং নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড শিল্প, বাড়ি ইত্যাদিতে ব্যবহৃত জ্বালানির দহন থেকে বাতাসে মিশে থাকে। সালফার ডাই-অক্সাইড মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর শ্বাসযন্ত্রের ক্ষতি করে। এ ছাড়াও, বিভিন্ন উপসর্গ যেমন মাথাব্যথা, কাশি, চোখের জ্বালা ইত্যাদিও সৃষ্টি করে।
গৃহস্থালীর কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, যেমন রেফ্রিজারেটর এবং পোকামাকড় মারার জন্য ব্যবহৃত অ্যারোসল, নাইট্রাস অক্সাইড এবং সালফার ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গত করে, যা বিভিন্ন উপায়ে স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে।
শহর জুড়ে আবর্জনার স্তূপ নগর সভ্যতার জন্য এক ক্ষতিকর উপাদান। বিশ্বের প্রধান শহরগুলিতে, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের শহরগুলির একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে নগর বর্জ্য এবং আবর্জনা। এই সমস্ত বর্জ্য, আবর্জনা বেশিরভাগই পোড়ানো হয়। এর ধুলো ও পারদ মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করে।
বায়ু দূষণ নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দূষিত বায়ুর কারণে একজন বাংলাদেশির গড় আয়ু প্রায় তিন বছর কমে গেছে। প্রতিবেদনে আরও প্রকাশ করা হয়েছে যে ‘বায়ু দূষণ প্রায় তামাক ব্যবহারের মতো আয়ু কমিয়ে দেয়।’ বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে একটি হওয়ায় বাংলাদেশকে অবশ্যই এই ফলাফলগুলোকে গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে এবং বায়ু দূষণের পেছনের কারণগুলো হ্রাস করার চেষ্টা করতে হবে।
বাংলাদেশ ও এর রাজধানী ঢাকা গত কয়েক বছরের সবচেয়ে খারাপ আবহাওয়ার জন্য বারবার খবরে এসেছে। এই বছরের (২০২২) ফেব্রুয়ারিতে, ঢাকার বায়ু বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক দূষিত হিসাবে পাওয়া গেছে, এর এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (AQI) স্কোর ১৯৪ রেকর্ড করা হয়েছে, যা ‘খারাপ’ বা ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ হিসাবে বিবেচিত হয়। ওয়ার্ল্ড এয়ার কোয়ালিটি রিপোর্ট ২০২০ অনুযায়ী, দেশে গড় বার্ষিক পিএম ২.৫ ঘনত্ব ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৭৭.১ মাইক্রোগ্রাম, যা WHO সুপারিশকৃত মাত্রার দ্বিগুণেরও বেশি।
স্বাভাবিকভাবেই, এই দূষিত বায়ু মানব স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করবে কারণ বিপজ্জনক বাতাসের সংস্পর্শে অনেক স্বল্পমেয়াদি থেকে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে। বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, বায়ু দূষণ সরাসরি হৃদরোগ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ, ফুসফুসের সংক্রমণ এবং ক্যান্সারের সঙ্গে যুক্ত। এটি বিশ্বব্যাপী মৃত্যু এবং অক্ষমতার জন্য শীর্ষ-ঝুঁকির কারণগুলোর মধ্যে একটি।
বাংলাদেশে বায়ু দূষণের প্রধান কারণগুলো অনেক আগেই চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে পরিবেশ অধিদপ্তর এবং বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া এবং নির্মাণস্থলের ধুলা ঢাকার বায়ু দূষণের তিনটি প্রধান উৎস। দুঃখের বিষয়, হাইকোর্টের নির্দেশনা সত্ত্বেও সারাদেশে অবৈধ ইটভাটা চালু রয়েছে, সড়কে অযোগ্য যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে এবং কর্তৃপক্ষ নির্মাণ সাইট থেকে ধুলো দূষণ বন্ধ করার জন্য উল্লেখযোগ্য কিছু করেনি।
অনিয়ন্ত্রিত বায়ু দূষণ আমাদের কষ্টার্জিত অগ্রগতি কেড়ে নেবে তা গ্রহণযোগ্য নয়। বিশেষজ্ঞরা বায়ু দূষণরোধে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পথ ও পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে বায়ু দূষণ রোধে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ, জ্বালানি পরিশোধন, মোটরগাড়ি চালনায় জনসচেতনতা প্রভৃতি।
যানবাহন থেকে নির্গত বায়ু দূষকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কার্বন মনোঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, অদাহ্য হাইড্রোকার্বন। এগুলো নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এক্ষেত্রে ডিজেল বা পেট্রোল চালিত যানের তুলনায় সিএনজি চালিত যানের দূষণক্ষমতা অনেক কম।
বায়ু দূষণ প্রতিরোধের একটি আধুনিক পদ্ধতি দূষণ পদার্থের শোষণ। এই পদ্ধতিতে দূষক পদার্থগুলো মুক্ত বায়ুতে ছড়িয়ে পড়ার পূর্বেই বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দূষক পদার্থ আলাদা করে নেওয়া যায়।
কল-কারখানার ধোঁয়া নির্গমন নল ও চিমনি থেকে নির্গত বস্তুকণা পৃথক করার জন্য ছাকনি বা অন্য কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। এর ফলে দূষকগুলো বায়ুতে মিশে যাওয়ার পূর্বেই আলাদা হয়ে যাবে।
বিকল্প জ্বালানি অর্থাৎ প্রচলিত জীবাশ্ম জ্বালানির পরিমাণ ক্রমাণ্বয়ে হ্রাস করে অপ্রচলিত শক্তি যেমন- সৌরশক্তি, বায়োগ্যাস ইত্যাদির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। এর ফলে বায়ু দূষণ অনেক কমে যাবে।
বিভিন্ন পরিত্যক্ত বর্জ্য যেগুলো কোনো কাজে লাগেনা সেগুলো না পুড়িয়ে মাটির নিচে পুঁতে ফেলা যেতে পারে। যথেচ্ছ মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পরিমিত পরিমাণে কীটনাশকের পাশাপাশি বিকল্প উপায়ে রোগ-বালাই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
হাটবাজার, দোকানপাট, বসতবাড়ি প্রভৃতি থেকে পচা বা পচনশীল দ্রব্য দ্রুত অপসারণ করতে হবে। এ ছাড়া শহরের ডাস্টবিনের ময়লা দীর্ঘ সময় ধরে না রেখে যতদূর সম্ভব তা দ্রুত শোধনাগারে পাঠাতে হবে অথবা মাটিতে পুতে ফেলে বায়ু দূষণ রোধ করতে হবে।
বড় বড় শহরের আবাসিক, শিল্প, বাণিজ্যিক, অফিস-আদালত প্রভৃতি পরিকল্পিতভাবে স্থাপন করতে হবে। এতে শিল্প-কারখানার দূষিত বাতাস মানব জীবন ও অন্যান্য প্রাণীর ক্ষতি করতে পারবে না।
উদ্ভিদ প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে। উদ্ভিদ জীবজগতের জন্য অক্সিজেন ত্যাগ করে এবং জীবজগতের ত্যাগকৃত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে ভারসাম্য বজায় রাখে। তাই প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষরোপণ করতে হবে এবং অন্যদেরও উৎসাহিত করতে হবে।
বায়ু দূষণের কুফল সম্পর্কে জনগণকে সচেতন হতে হবে। এক্ষেত্রে জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
যেহেতু বায়ু দূষণের মূল কারণগুলো ইতোমধ্যেই চিহ্নিত করা হয়েছে, তাই এই বিপদ মোকাবিলায় কর্তৃপক্ষের একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা তৈরি করার সময় এসেছে। দূষিত বায়ুর সংস্পর্শ থেকে মানুষকে বাঁচাতে জরুরি প্রশমন ব্যবস্থা প্রস্তুত করতে হবে। এভাবে সরকারি-বেসরকারি প্রচেষ্টা ও আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বায়ু দূষণ ও দূষণজনিত রোগ-ব্যাধি কমিয়ে আনা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
আরএ/