বিশ্বকবির চিন্তায় বাংলার বাউল গগন হরকরা
আমি কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যে রে...
‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ গানে ফকির লালন মনের অভ্যন্তরের সত্তাকে তুলনা করেছেন এমন এক পাখির সঙ্গে, যা সহজেই খাঁচারূপী দেহের মাঝে আসা যাওয়া করে কিন্তু তবুও একে বন্দি করে রাখা যায় না। গগনও ঠিক এমনই ভাবতেন। সারাদিন চিঠি বিলি করা আর মনের সাধন করা ছিল গগনের একমাত্র কাজ। ফকির লালন আর গগনের সময়কালে যাবতীয় নিপীড়ন, মানুষের প্রতিবাদহীনতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, লোভ, আত্মকেন্দ্রিকতা সেদিনের সমাজ ও সমাজ বিকাশের সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সমাজের নানান কুসংস্কারকে লালন যেমন তার গানের মাধ্যমে করেছেন প্রশ্নবিদ্ধ, তেমনি গগন হরকরার গানেও ছিল প্রশ্নবান। এ কারণে এদের সংগ্রামে আকৃষ্ট হয়েছিলেন বহু শিষ্ট ভূস্বামী, ঐতিহাসিক, সম্পাদক, বুদ্ধিজীবী, লেখক এমনকি গ্রামের নিরক্ষর সাধারণ মানুষও।
গগন হরকরা (কৌলিক নাম গগনচন্দ্র দাম) বাংলা লোকসংগীত শিল্পী এবং সংগীত রচয়িতা। গগন হরকরা আনুমানিক ১৮৪৫ সালে তৎকালীন পাবনা জেলার গবরাখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও এখন গবরাখালী কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহের আড়পাড়া গ্রাম নামে পরিচিত। গবেষক ড. আবুল আহসান চৌধুরী ‘রবীন্দ্র উত্তরসূরি’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘দুই যুগ আগেও গগনের ভিটার ও ফলের বাগানের অস্তিত্ব ছিল।’ লোকমুখে জানতে পারা যায় যে, শিলাইদহে গগন হরকরার একটি বড় ফলের বাগান ছিল এবং গগনের বাস্তুভিটায় আসামদ্দি নামক একজন কৃষক বাড়ি করে থাকতেন। সেই বাড়িটি আজও ‘দাসের ভিটা’ নামে পরিচিত, উল্লেখ্য সে সময়ের দাসেরা মন্ডল নামেও পরিচিত ছিল। তার পিতা-মাতা সম্বন্ধে তেমন কোনো তথ্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে তার একটি ছেলের নাম কিরণ চন্দ্র ছিল বলে জানা যায়। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’-এর সুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংগ্রহ করেছিলেন গগন হরকরার রচিত একটি গানের সুর হতে। গগন হরকরা ছিলেন বিশিষ্ট লালনগীতি গায়ক ও বাউল গীতিকার। গগন প্রথমে কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন পাশাপাশি তৎকালীন শিলাইদহের ডাকঘরের ডাক হরকরা’র চাকুরি করতেন। পেশা ছিল শিলাইদহ ডাকঘরে পৌঁছনো চিঠিগুলো বিলি করা। এ পেশার সুবাদেই তিনি লোকের কাছে ‘গগন হরকরা’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। শিলাইদহের শচীন্দ্রনাথ অধিকারী লিখেছেন, ‘গগন সামান্য শিক্ষা দীক্ষায় পারদর্শী ছিলেন এবং তার ফলশ্রুতিতেই শিলাইদহ কাছারিবাড়ির পূর্ব পার্শ্বে ডাকঘরের ডাক হরকরা’র চাকুরি পেয়েছিলেন।’
১৯৯০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘কবিতা সংগ্রহ’ প্রকাশিত রফিকুল ইসলাম ও অন্যান্য সম্পাদিত গ্রন্থে লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার বিশেষ অন্তরঙ্গতা ছিল এবং প্রায়ই দু’জনে রসালাপ ও সংগীত চর্চা করতেন’। রবীন্দ্রনাথ তার এমনই গুণমুগ্ধ ছিলেন যে, স্বদেশি আন্দোলনের যুগে রবীন্দ্রনাথ ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক’ ও ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ (বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে) গান দুটি গগন হরকরার যথাক্রমে ‘ও মন অসাড় মায়ায় ভুলে রবে’ ও ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’ গানদুটির সুর ভেঙে রচিত করেন (ওয়াকিল আহমদ, বাংলাপিডিয়া, গগন হরকরা, ২৯ মার্চ ২০১৫)। গগন কার কাছ থেকে গানের দীক্ষা নিয়েছিলেন তা জানা সম্ভব হয়নি, তবে গগন লালনের গানের খুব ভক্ত ছিলেন। লালনও গগনের গান ও সান্নিধ্য খুব পছন্দ করতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ডাকঘর’ নাটকটি গগন হরকরার জীবন থেকে প্রভাবিত হয়ে লিখেছিলেন এবং নাটকের গগেন্দ্রনাথ ঠাকুর চরিত্রটি তা প্রমাণ করে।
রবীন্দ্রনাথ তার কণ্ঠে লালনসহ অন্য বাউলের গানও শ্রবণ করতেন এবং বাউল সাধনা ও গানের বিষয় নিয়ে গগনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিশদ আলোচনা হতো। স্বাভাবিক কারণ ছিল, চিঠি বিলি করার জন্য গগন প্রায়ই রবীন্দ্রনাথের কাছে যেতেন। রবীন্দ্রনাথ আগ্রহের সঙ্গে গগনের কাছে বাউল গান সম্পর্কে জানতে চাইতেন। অনেকদিন সন্ধ্যার পর নির্জনে বোটের ছাদে বসে রবীন্দ্রনাথ গগনের গান গাইতেন। তিনি নানা রচনায় এবং দেশে-বিদেশে প্রদত্ত ভাষণে বাউলের উদার ধর্মমতের এবং লালন-গগনের গানের উল্লেখ করেছেন। বিশেষ করে, ‘মানবধর্ম’ (১৯৩০) প্রবন্ধে তিনি বাউলের মানবতাবাদী দর্শনের ওপর আলোকপাত করেন।
রবীন্দ্রনাথ ফ্রান্সে প্রদত্ত An Indian Folk Religion শীর্ষক বক্তৃতায় গগনের উক্ত গানের উদ্ধৃতি দিয়ে মন্তব্য করেন, The first Baul song, which I chanced to hear with any attention, profoundly stirred my mind. Its words are so simple that it makes me hesitate to render them in a foreign tongue, and set them forward for critical observation. Besides, the best part of a song is missed when the tune is absent; for thereby its movement and its colour are lost, and it becomes like a butterfly whose wing have been plucked. The first line may be translated thus: Where shall I meet him, the Man of my Heart? This phrase, ‘The Man of my Heart’, is not peculiar to this song, but is usual with the Baul sect. It means that, for me, the supreme truth of all existence is in the revelation of the infinite in my own humanity.
পরে মনসুর উদ্দীন সম্পাদিত হারামণি (১৩৩৬) গ্রন্থের ভূমিকায় গানটি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ভূয়সী প্রশংসা করেন। রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর ও অন্যান্য নাটকে অন্তরচারী ও মুক্তিকামী বাউলের যে পরিচয় পাওয়া যায়, তাতে গগন চরিত্রের ছাপ আছে বলে পণ্ডিতগণ মনে করেন।
ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালের ভারত বিচিত্রায় রেফুল করিম ‘শিলাইদহের গগন হরকরা’ প্রবন্ধে গগন সম্পর্কে পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রীর উদ্ধৃত্তি দিয়েছেন এভাবে–‘লালন এর শিষ্য ধারার একজন, যিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সাথে প্রথম পরিচিত, তিনিই ছিলেন রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহের ডাক হরকরা, যাঁর নাম গগন; তারপর গোসাঁই গোপাল, কাঙ্গাল হরিনাথ, সর্বক্ষেপী বোষ্টমী, গোসাঁই রামলাল সহ লালনের অজস্র ভক্ত শিষ্যের পরিচয় ঘটে। ১৮৮৯ থেকে ১৯০১, কবিগুরুর শিলাইদহে অবস্থানকালে গগনই রবীন্দ্রনাথকে গান গেয়ে শোনাতেন; কবিগুরু বাউল ফকিরদের গান শুনে আপ্লুত হয়ে নিজে শিলাইদহ ও ছেঁউড়িয়া অঞ্চল হতে অনেক বাউল গান সংগ্রহ ও পত্র-পত্রিকায় প্রচার করেছেন। উদ্দেশ্য একটাই যাতে সুধী সমাজের মধ্যে বাংলাদেশের বাউল গান সম্পর্কে ধারণা জন্মে।’
গগনের পরিচয় দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর An Indian Folk Religion প্রবন্ধে বলেছেন, The name of the poet who wrote this song (Where shall I meet him, the Man of my Heart) was Gagan. He was almost illiterate; and the Ideas he received from the self-consciousness of the modern age. He was a village postman, earning about ten shillings a month and he died before he had completed his teens. The sentiment, to which he gave such intensity of expression, is common to most of the songs of his sect. And it is a sect, almost exclusively confined to that lower floor of society, where the light of modern education hardly finds an entrance, while wealth and respectability shun its utter indigence.
গগন হরকরা ছিলেন আত্মভোলা বাউলকবি, সংগীত ছিল তার দ্বিতীয় সত্তা। তিনি নেচে নেচে গান গেয়ে বাড়ি বাড়ি চিঠি বিলি করতেন। তার সাংগীতিক প্রতিভা সম্পর্কে রবীন্দ্রজীবনীকার শচীন্দ্রনাথ অধিকারী বলেছেন, “গগন হরকরা ছিলেন শিলাইদহ পোস্ট অফিসের পিওন, অতি সামান্য বাংলা লেখাপড়া জানতেন, গাঁয়ে গাঁয়ে চিঠি বিলি করতেন, কিন্তু তাঁর বুকের মধ্যে পোরা ছিল রসের নির্ঝর, কণ্ঠে ছিল কোকিলের ঝংকার আর তাঁর গানে ছিল অরূপ-রতনের জন্যে চির-মধুর বিরহ-ব্যথা। তিনি শিলাইদহে ‘সখীসংবাদের’ গানে এমন করুণ আখর লাগিয়ে গাইতেন যে, শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে সে গান শুনতেন। রবীন্দ্রনাথও তাঁর গান শুনতেন–বিরলে আদর করে কাছে বসিয়ে।”
মনসুর উদ্দীনের হারামণি গ্রন্থের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউল দলের সঙ্গে আমার সর্বদাই দেখা সাক্ষাৎ ও আলাপ আলোচনা হত। আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি এবং অনেক গানে অন্য রাগরাগিণীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিলন ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যায় বাউলের সুর ও বাণী কোনো এক সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে।’ রবীন্দ্রনাথ লালনের শিষ্যদের মধ্যে গগনকেই বেশি পছন্দ করতেন। গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’ গানটি বিষয়ে লিখেছেন ‘কথা নিতান্ত সহজ, কিন্তু সুরের যোগে এর অর্থ অপূর্ব জ্যোতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে’। শিলাইদহে এসে রবীন্দ্রনাথ যেমন লালন ফকির কর্তৃক প্রভাবিত হয়েছিলেন, তেমনি লালনের পরেই প্রভাবিত হয়েছিলেন গগন হরকরা কর্তৃক। তাঁর মনে ধর্ম সম্পর্কে যে নতুন ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল, তারই সমর্থন তিনি খুঁজে পেয়েছেন বাউলদের গানে। এমনকি আজীবন লালিত দর্শনের সঙ্গেও তিনি এ সময় থেকে বাউলদের একটা সমন্বয় ঘটাতে চেষ্টা করেছিলেন। যে সত্যের বাণী শুনতে পেয়েছিলেন, তারই প্রতিধ্বনি শুনতে পেলেন বাউল গানে; যেহেতু গগনের ‘আমি কোথায় পাব তারে’ এই গানের সুরে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’
এখানে গগনের দুটি গান সংকলিত হলো। এ পর্যন্ত তার এই দুটি গানেরই মাত্র সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রথম গানটি বাউলের ‘মনের মানুষ’ সম্পর্কিত একটি মূল্যবান গান। গানটিতে বাউল দর্শনের মূল তত্ত্বটি অতি সুন্দরভাবে বিবৃত হয়েছে। আবহমান সময়ধারা বেয়ে বাউল যে তার মনের মানুষকে অন্বেষণ করে ফেরে, তারই আকুল আর্তি ফুটে উঠেছে এই গানে। গানটিতে একতারা হাতে চলমান বাউলজীবনের এক উদাসী সাধকের মরমি চিত্র ফুটে উঠেছে। কী তত্ত্বদর্শন কী শিল্পসৌন্দর্য উভয়তেই গগনের পদাবলি বাংলার মরমি সংগীত-সংস্কৃতির মূল্যবান নিদর্শন। তাঁর সেই গানের পূর্ণপাঠ–
আমি কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যে রে।
হারায়ে সেই মানুষে
তার উদ্দিশে
দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে॥
লাগি সেই হৃদয়-শশী
সদা প্রাণ হয় উদাসী
পেলে মন হত খুশী
দিবানিশি দেখতাম নয়ন ভরে॥
আমি প্রেমানলে মরছি জ্বলে
নিভাই কেমন করে
(মরি হায় হায় রে)
ও তার বিচ্ছেদে প্রাণ কেমন করে
ওরে দেখ্ না তোরা হৃদয় চিরে॥
দিব তার তুলনা কি
হেরিলে জুড়ায় আঁখি
সামান্যে কি দেখতে পায় তারে॥
তারে যে দেখেছে
সেই মজেছে
ছাই দিয়ে সংসারে
(মরি হায় হায় রে)
ও সে না জানি কি কুহক জানে
অলক্ষ্যে মন চুরি করে॥
কুলমান সব গেল রে
তবু না পেলাম তারে
প্রেমের লেশ নাই অন্তরে
তাইতে মোরে দেয় না দেখা সে রে॥
ও তার বসত কোথায়
না জেনে তায়
গগন ভেবে মরে
(মরি হায় হায় রে)
ও সে মান্ষের উদ্দিশ
যদি জানিস
কৃপা করে
আমার সুহৃদ হয়ে
ব্যথায় ব্যথিত হয়ে
আমায় বলে দে রে॥
গগনের দ্বিতীয় পদটিতে মরমি-অন্বেষণের ভেতর দিয়ে দুর্লভ এই ‘মানবজনম’কে সার্থক করার আহবান আছে–
(ও মন) অসাড় মায়ায় ভুলে রবে
কতকাল এমনি ভাবে।
এসব ভোজবাজির প্রায়
(মন রে) কেউ কারো নয়
দেখতে দেখতে কোথায় যাবে॥
সুখের আশে দেশ বিদেশে
ভ্রমিতেছ নিশি দিবে
তবু হল না সুখ
(মন রে) সদাই অসুখ
সুখের যে পথ চিনবি কবে?
যাদের এখন দিয়ে প্রাণধন
করছ যতন আপন ভেবে
যেদিন পাবে অক্কা
সব বিফাক্কা
সঙ্গে তার কেউ না যাবে॥
আপন যে জন
লও তার শরণ
ভব-বন্ধন এড়াইবে
ভেবে বলছে গগন
এবার বুঝি আমার
মানব জনম এমনি যাবে॥
রবীন্দ্র উত্তরসূরিতে ড. আবুল আহসান চৌধুরী লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নি সরলা দেবী (১৮৭২-১৯৪৫) ‘ভারতী’ প্রত্রিকায় (ভাদ্র ১৩০২) গগনের কয়েকটি গান সংগ্রহ ও প্রকাশ করেছিলেন। সরলা দেবী উক্ত প্রবন্ধের শেষ অংশে আবেদন করেছিলেন যে, “প্রেমিক গগনের ভক্ত জীবনীর বিবরণ সংগ্রহ করিয়া কেহ ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশার্থে পাঠাইয়া দিলে আমাদের কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞতা ভাজন হইবেন।” সরলা দেবী ইতোপূর্বে শতগান (বৈশাখ ১৩০৭, এপ্রিল ১৯০০) এ মূল গানটির স্বরলিপি প্রকাশ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘একবার যদি আমাদের বাউলের সুরগুলি আলোচনা করিয়া দেখি তবে দেখিতে পাইব যে, তাহাতে আমাদের সংগীতের মূল আদর্শটাও বজায় আছে, অথচ সেই সুরগুলো স্বাধীন।’ ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ‘ফালগুনী’ নাটক রচনা করে সেখানে অন্ধ বাউল চরিত্রে অভিনয় করেন। ১৯১৬ সালে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের একটি ছবি আঁকেন। ছবিটিতে দেখা যায় বাউল রবীন্দ্রনাথ একতারা হাতে বিভোর হয়ে নাচছেন। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের সময় রচিত হয়।
প্রশান্ত পাল ‘রবি জীবনী’ গ্রন্থে লিখেছেন, “ইতিমধ্যে রবীন্দ্রনাথ রচিত নূতন স্বদেশি গান ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ নিয়ে কলকাতা উত্তাল হয়ে পড়েছে। গানটির পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি। রচনার তারিখও জানা নেই।” সত্যেন রায় লিখেছেন, “বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ৭ আগস্ট ১৯০৫ সালে কলিকাতার টাউন হলে যে সভা হয়েছিল, সেই উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথের নূতন সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ বাউল সুরে গীত হয়েছিল।” বাংলাদেশের বাউল কবিদের মধ্যে গগন হরকরা একজন জনপ্রিয় কবি যার মাত্র দু’খানা গানই তাঁকে করেছে অমর। সে যে ধারায় গান রচনা করেছিল তা ব্যবহৃত, সংগৃহীত ও সুরক্ষিত থাকলে বাংলার লোক-সাহিত্য সর্ববোধের সহায়ক হতো। তারই কণ্ঠে মরমি সংগীতের সুরতরঙ্গ জেগে উঠতো শান্তস্নিগ্ধ বাংলার পল্লী মাটিতে বাংলার সহজ আকাশের নিচে তন্দ্রাচ্ছন্ন নিশিতে। তাঁর প্রতিভা ছিল অনন্য।
আধ্যাত্মিক ভাবধারায় গগন প্রচুর গান রচনা করেছিলেন। তার সহজ-সরল শব্দময় এই গানে মানবজীবনের রহস্য, মানবতা ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। গগনের রচনা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে তিনি ধর্ম-গোত্র-বর্ণ-সম্প্রদায় সম্পর্কে অতীব সংবেদনশীল ছিলেন। ব্রিটিশ আমলে যখন হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে জাতিগত বিভেদ সংঘাত বাড়ছিল তখন লালন ছিলেন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তিনি মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদে বিশ্বাস করতেন না। মানবতাবাদী লালন দর্শনের মূল কথা হচ্ছে মানুষ। আর এই দর্শন প্রচারের জন্য তিনি শিল্পকে বেছে নিয়েছিলেন। এই আদর্শের ভাবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন বাউল গগন হরকরা। গগন হরকরা মানুষের মধ্যে ছিলেন একেবারেই অন্যরকম। চিঠি বিলি শেষ করে চলে যেতেন লালন ফকিরের আখড়ায় আর মনের আনন্দে গান গাইতেন। ভাবতেন গানেই তাঁর মুক্তি। গগনের স্বভাব ছিল ভরদুপুরে চিঠির বস্তা কাঁধে করে হাঁটতে হাঁটতে গান গাওয়া, দূর থেকে যে কেউই তার গান শুনে বুঝত–এ আর কেউ না গগন। গগনের গানে মুগ্ধ হয়েছেন সুসাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন, গ্রামীণ সাংবাদিকতার প্রবাদপুরুষ কাঙ্গাল হরিনাথের মতো আরও অনেকেই।
গগন হরকরা আনুমানিক ১৯১০ সালে শিলাইদহের আড়পাড়া গ্রামে নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। সঙ্গীতজ্ঞ ও কুষ্টিয়ার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রদূত লালিম হক বলেন, ‘গগনের মৃত্যুর পর তার ভবিষ্যৎ বংশধর কেউ শিলাইদহে ছিল না। অভাব-অভিযোগই দেশত্যাগের কারণ।’ গগন হরকরার ডাকঘরটি কালের পরিক্রমায় একসময় সরকার নিলাম করে দেয়। বর্তমানে সেখানে একটি পুকুর ছাড়া কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই! বাঙলার লোকায়ত মরমি গানের ধারক গগন হরকরার নাম স্মরণীয় হয়ে আছে ও থাকবে। বাউলগান বা মরমি গানের প্রতি বিদ্বৎসমাজের মনোযোগের পেছনে গগনের ভূমিকা কম নয়। রবীন্দ্রনাথের মতো বিশ্ব-ব্যক্তিত্বকে প্রাণিত করা, তার আরেক বিস্ময়কর সাফল্য ও অসামান্য সিদ্ধি।
লেখক: ইতিহাস গবেষক ও প্রাবন্ধিক
এসএ/