বাংলাদেশকে ছয় বছরে দারিদ্র্যমুক্ত করা যেতে পারে
দরিদ্রতা একটি দেশের উন্নয়নের জন্য বড় অন্তরায়। একটি সুস্থ্য ও সবল জাতি গঠন করা কখনোই সম্ভব হয়না যতক্ষণ না ঐ দেশ থেকে দারিদ্র্য সম্পূর্ণ হটানো বা সহনীয় পর্যায়ে কমিয়ে আনা যায়। বিশ্বে দারিদ্র্যের অস্তিত্ব ছিল, এখনো আছে; এটি বিভিন্ন প্রেক্ষিতের একটি জটিল চলমান প্রক্রিয়া। দরিদ্র মানুষগুলো নানা কৌশলে দারিদ্র্য থেকে মুক্তির পথ খোঁজে। কোনো পথ না পেলে দরিদ্রতাকেই জীবনের সাথে একাত্ম করে নেয়। চরম দারিদ্র্য থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হলে, ক) দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে হবে এবং খ) আয় বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে সকল মানুষের মধ্যে আয়ের বণ্টন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ কি না অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে তা সুস্পষ্ট করতে হবে। একটি দক্ষ সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাই পারে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে অব্যাহতভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান–এর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বাংলাদেশকে একটি ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বঞ্চনা মুক্ত সোনার বাংলা গড়তে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল দেশদ্রোহী ঘাতকদের হাতে নির্মমভাবে শাহাদত বরণ করতে হলো জাতির পিতা এবং তাঁর পরিবারের অনেক সদস্যকে। তারপর অনেকগুলো বছর চলে গেলো নানা ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যে। সমগ্র জাতি অগণতান্ত্রিক শাসকদের হাতে বন্দি হল। বাংলাদেশের মানুষ যখন চারিদিকে অন্ধকার দেখছিল সেই দুঃসময়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাল ধরলেন এবং এদেশের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ালেন। তিনি হয়ে উঠলেন শান্তিতে ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী প্রতিটি মানুষের নির্ভীক কণ্ঠস্বর, বেঁচে থাকার প্রেরণা এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের অকুতোভয় নেতা।
আমাদের যে প্রাকৃতিক সম্পদ আর উর্বর কৃষি জমি রয়েছে তাতে ১৬ কোটি লোকের জীবনধারণের সুযোগ খুবই সীমিত। এছাড়া শিল্প ক্ষেত্রের পরিধি এতোটা ব্যাপক নয় যে চাহিদা মোতাবেক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়। দেশের এ অবস্থার উন্নয়নের জন্য যেমন বিনিয়োগের পরিমান আশানুরূপ বাড়ছে না, তেমনি একটি দক্ষ মানবসম্পদের সৃষ্টিসহ অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি ও ধ্যান-ধারণার প্রয়োগের অভাব রয়েছে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করা প্রায় ৯০ লক্ষ পরিবারের অবস্থা আরও শোচনীয়। বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত থেকে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে বেকার লোকের হার ৪%-৫%, যদিও ২০% লোক তাদের যোগ্যতার নিচের স্তরে কাজ করে থাকে। তবে, আত্ম-কর্মসংস্থানের হার প্রায় ৪০% এবং তাদের বেশিরভাগই অশিক্ষিত বা প্রাথমিক অবধি লেখাপড়া করা। উল্লেখ্য, প্রতিবছর প্রায় ২০ লক্ষ লোক বাংলাদেশের শ্রম বাজারে প্রবেশ করে থাকে।
দারিদ্র্য বিমোচনে বর্তমান সরকারের নেয়া পদক্ষেপ ইতোমধ্যেই বিশ্ববাসীর প্রশংসা কুড়িয়েছে। প্রতি বছরই দারিদ্র্য হার কমে আসছে। তবে বিদ্যমান হারে কমতে থাকলে ২০৩০ সালের পূর্বে পুরোপুরি দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব নাও হতে পারে। বিশ্ব ব্যাংক সে রকমই আভাস দিয়েছে। তাই দারিদ্র্য হার আরও অধিক পরিমানে কমাতে হবে।
যারা দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাস করে অন্যান্যদের মতো এদেরকেও মানব সম্পদ উন্নয়ন কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করা অপরিহার্য। তাই সর্বপ্রথম উপজেলাওয়ারী দরিদ্র পরিবারগুলো সনাক্তপূর্বক একটি সঠিক ও সম্পূর্ণ তালিকা তৈরি করতে হবে। প্রত্যেক পরিবার থেকে কাজ করতে সক্ষম এবং শিক্ষার মান অনুযায়ী একজনকে মনোনীত করে কাঠমিস্ত্রি, প্লাম্বার, ড্রাইভার, দর্জি, মোটর গাড়ির মেকানিক, ইলেকট্রিসিয়ান, ইত্যাদি পদে কাজ করতে পারে তেমন আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এক্ষেত্রে পরিবারের মনোনীত সদস্য মহিলা হলে তার প্রশিক্ষণ বাস্তবতার নিরিখে দিতে হবে। যে যেই উপজেলার মানুষ সেই উপজেলাতেই তার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। বছরে ১৫ লক্ষ লোককে প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে যাতে ৬ বছরে প্রতিটি দরিদ্র পরিবারের একজন সদস্য প্রশিক্ষণ পায়। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা তেমন কঠিন হবে বলে মনে হয়না। বিদ্যমান অবকাঠামোকে ব্যবহার করেই সেটা সম্ভব। এ ব্যাপারে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা বিশ্বব্যাংক –এর পরামর্শ ও আর্থিক সহায়তা নেয়া যেতে পারে।
এই ১৫ লক্ষ দক্ষ লোককে তিনটি উপায়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। উপায়গুলো হচ্ছে-(ক) আত্মকর্মসংস্থান, (খ) সরকারি ও বেসরকারি খাতে অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান, এবং (গ) অভিবাসী কর্মী হিসেবে কর্মসংস্থান। অর্থাৎ প্রথম দু’টি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা আর তৃতীয়টি হচ্ছে বিদেশে অভিবাসন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা।
ক) প্রথম উপায় হচ্ছে দেশেই আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনীয় সুবিধাদি নিশ্চিত করা গেলে এ ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি লোকের কর্মসংস্থান করা সম্ভব। বাংলাদেশের বর্তমান আত্মকর্মসংস্থান হার অনুযায়ী প্রতি বছর কমপক্ষে ৬ লক্ষ লোক নিজের কর্ম নিজেই খুঁজে নিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই মূলধন যোগার করা প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই প্রশিক্ষিত ব্যক্তিকে ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় মূলধন সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা গেলে বিদ্যমান হার বেড়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। বর্তমানে বাংলাদেশে অনেক ব্যাংক রয়েছে এবং ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি ব্যাংক আত্মকর্মসংস্থান প্রকল্পে অবশ্যই এগিয়ে আসবে। প্রয়োজনে সরকার ব্যাংকগুলোর সাথে আলোচনা করে যথাযথ পদ্ধতি নির্ধারণ করতে পারে।
খ) দ্বিতীয় উপায়টি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মের সংস্থান করা। তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর বিভিন্ন পদে প্রায় ২০ লক্ষ লোক নতুন চাকুরিতে প্রবেশ করে। এদের মধ্যে যেমন রয়েছে উচ্চ শিক্ষিত লোক, তেমনি স্বল্প শিক্ষিত লোকজনও রয়েছে। দারিদ্র্য সীমার নিচে বাসরত পরিবারের ছেলেমেয়েদের মধ্যে উচ্চ শিক্ষিতের সংখ্যা খুবই কম। তাই অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা এই জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্য সীমার উপরে তুলে আনার জন্য সরকার মনে করলে চাকুরি ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে। তবে কর্মক্ষেত্রের পরিধি বিস্তারের জন্য দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির সহায়ক পরিবেশের উন্নয়ন এবং সরকারি সহযোগিতা নিশ্চিত করার সাথে নতুন চিন্তা, আধুনিক প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনার সমন্নয় অত্যন্ত জরুরি। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি যাতে কোনভাবেই আমাদের লক্ষ্য অর্জনে অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায় সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে।
গ) আমরা দেখেছি যেসব পরিবার বিদেশে কর্মরত তার কোন সদস্যের কাছ থেকে রেমিট্যান্স পায় তারা অন্যদের চেয়ে আর্থিকভাবে অনেক ভালো অবস্থানে থাকে। দারিদ্র্য সীমার নিচে যেসব পরিবার রয়েছে তাদেরকে যদি রেমিট্যান্স প্রাপক পরিবারে রূপান্তর করা যায় তাহলে সেসব পরিবার আর দরিদ্র থাকবে না। অতএব, কর্মসংস্থানের তৃতীয় উপায়টি হলো তাদেরকে অভিবাসী কর্মী হিসেবে বিদেশে প্রেরণের ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ৬ লক্ষ লোক বিদেশে কাজ নিয়ে যায়। আমরা যদি দরিদ্র পরিবারের এই প্রশিক্ষিত লোকদেরকে অগ্রাধিকার দেই তাহলে দারিদ্র্য বিমোচন অনেকটাই কমিয়ে আনা যায়। এক্ষেত্রে এ বিশেষ পরিকল্পনাটি হবে ৬ বছরের জন্য। প্রতি বছর এদের থেকে কমপক্ষে ৫ লক্ষ লোক প্রেরণ করা গেলে ৬ বছরে ত্রিশ লক্ষ লোক যেতে পারবে। ফলে ৩০ লক্ষ পরিবারই দারিদ্র্য মুক্ত হবে। প্রয়োজনে বিদেশ যাওয়ার খরচ সংকুলানের জন্য ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দরিদ্র পরিবার থেকে কর্মী অভিবাসন করার সমগ্র প্রক্রিয়াটিকে পরিচালনার জন্য বিশেষ নীতিমালা এবং পদ্ধতি প্রণয়নের জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে, সরকারের বিদ্যমান কেন্দ্রীয় ডাটা ব্যাংক সুবিধা ব্যবহার করা যাবে। এছাড়া, অভিবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থ (রেমিট্যান্স) অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ এবং বিদেশে কর্ম শেষে ফেরত আসা লোকদের অর্থনৈতিক কাজে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে যাতে ঐ পরিবারগুলো পুনরায় দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে না যায়।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্রের হার ৩ শতাংশের নিচে নামাতে হবে। বিশ্বব্যাংক বলেছে যে বাংলাদেশে দারিদ্র্য হার যে গতিতে কমছে সে ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার দাঁড়াবে ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ। উপরে বর্ণিত এ তিনটি পদ্ধতিকে একত্রে একটি প্যাকেজে বাস্তবায়ন করা গেলে ৬ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ থেকে পুরোপুরি দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব। নিঃসন্দেহে দারিদ্র্য বিমোচন একটি জটিল ও কঠিন কাজ এবং চ্যালেঞ্জিংও বটে। তবে দৃঢ় প্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাসকে সম্বল করে সে চ্যালেঞ্জকে বাস্তবে পরিণত করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীই পারেন বাংলাদেশকে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কাছে অনুকরণীয় হিসেবে উপস্থাপন করতে। আমাদের বিশ্বাস তিনি অবশ্যই বাংলাদেশের মানুষদেরকে দারিদ্র্যের গ্লানি থেকে চিরদিনের জন্য মুক্তি দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।