হেমনগর জমিদারবাড়ি
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
টাঙ্গাইল জেলাতে যতগুলি সুদৃশ্য জমিদারবাড়ি আমি দেখেছি, আর কোনো জেলায় এতগুলি আছে বলে আমার জানা নেই। এই সবগুলির মধ্যে অত্যন্ত মনোরম একটি হলো হেমনগর জমিদারবাড়ি। টাঙ্গাইল জেলার গোপাল্পুর উপজেলায় এটি অবস্থিত। সাম্প্রতিককালে নির্মিত ২০১ গম্বুজ মসজিদের কারণে উপজেলাটি আলোচনায় এসেছে। তবে এই উপজেলার ঐতিহ্য বেশ পুরনো। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার পশ্চিমে হেমনগর গ্রামে জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরী ১৮৮০ সালে প্রায় ৩০ একর জায়গার উপর এই দ্বিতল প্রাসাদটি নির্মান করেছিলেন।
বাড়ির সামনে রয়েছে বিরাট মাঠ। মাঠ পেরুবার আগেই চোখে পড়বে প্রাসাদের সম্মুখ দেয়ালের বিশেষত্ব। কাছে গেলে বিস্মিত হতে হবে দেয়ালের নিখুঁত কারুকাজ দেখে। বাড়ির পুরো সামনের অংশটি চিনি-টিকরিতে মোড়া। বালি ও চুনের প্লাস্টারের উপর নানা রঙের সিরামিক্সের তৈজসপত্র, নানা রঙের কাঁচ এবং আয়নার একেবারে ছোট ভাঙ্গা টুকরো গেঁথে নিখুঁত ডিজাইনে দেয়াল বা পিলারের উপর করা কাজগুলিই হলো চিনি-টিকরি। এগুলি দিয়ে তৈরি করা হতো জ্যামিতিক ডিজাইন বা নানা ধরনের নানা আকারের লতাপাতা ও ফুলের ডিজাইন। দেয়ালের এতটা জায়গা জুড়ে এতো নিখুঁত চিনি-টিকরি করা ডিজাইন খুব কম জমিদারবাড়ীতে দেখেছি। কেউ কেউ বলেন চীন থেকে কারিগর এনে এই চিনি-টিকরির কাজ করানো হয়েছিল। এই তথ্যটি সত্য নয়, কারণ এই কারিগর আসলে আনা হয়েছিল দিল্লী ও কোলকাতা থেকে।
বাড়িটিতে প্রবেশের মুখে ছাদের দিকে তাকালে চোখে পড়বে মাঝখানে একটি ভাষ্কর্য। খুব লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তার দুই পাশে দুটি পরি শোভা পাচ্ছে। একারনেই স্থানীয়রা এর নাম দিয়েছে পরির দালান।
প্রবেশ করলেই পড়বে দুই সারির বারান্দা, এরপর দরবার হল। এরপর দু পাশে সারি সারি ঘর নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল ১০০টি কক্ষের এই চতুর্ভূজাকার প্রাসাদ। সামনের অংশ দোতলা, পেছনে একতলা। ভেতরে রয়েছে উঠান। তিন ফুট চওড়া দেয়ালে ঘেরা জমিদার বাড়ীর মাঠের সামনে এবং বাড়ীর পেছনে রয়েছে বেশ বড় বড় দু’টি পুকুর।
প্রাসাদের সামনে ছিল বাগান, পাশে ছিল চিড়িয়াখানা, হাতীশাল এবং জলসা ঘর। সুদূর কোলকাতা থেকে প্রখ্যাত শিল্পীরা এখানে আসতেন সঙ্গীত বা নৃত্য পরিবেশন করার জন্য। জনশ্রুতি আছে, একবার কোলকাতা থেকে আনা এক বাইজীকে হেমচন্দ্রের খুব ভালো লেগে যায়। তাকে আটকে রেখেছিলেন এই প্রাসাদে। বাইজীর পরিবার কোলকাতা আদালতে এই নিয়ে মামলা করলে হেমচন্দ্রের লোকজন মিথ্যে সাক্ষী দিয়েছিল, যে বাইজীকে জগন্নাথগঞ্জ স্টেশন থেকে কোলকাতাগামী ট্রেনে উঠতে দেখেছে একজন, অন্যজন দেখেছে তাকে শিয়ালদহ স্টেশনে ট্রেন থেকে নামার সময়।
এই প্রাসাদটি হেমচন্দ্রের একমাত্র প্রাসাদ ছিল না। প্রথমত তিনি ময়মনসিংহের মধুপুরে তাঁর বাড়ী গড়ে তুলেন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে বুঝে গেলেন এত দূর থেকে তাঁর জমিদারী পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তাই গোপালপুরের সুবর্নখালী গ্রামে যমুনা নদীর পাড়ে গড়েন এক সুরম্য প্রাসাদ। এই সুবর্নখালী ছিল যমুনার পাড়ে প্রসিদ্ধ নদী বন্দর। এখান থেকে কোলকাতাগামি স্টীমার ধরা যেতো। তবে তাঁর প্রাসাদসহ পুরো গ্রামটি নদী গ্রাস করে ফেললে নদীর থেকে বেশ কিছু দূরে ১৮৮০ সালে এই প্রাসাদটি নির্মান করেন, এবং গ্রামটির নাম দেন হেমনগর। বাড়িটি এতো মজবুত করে নির্মান করা হয়েছিল যে ১৮৯৭ সালের ভুমিকম্পে তার খুব বেশী ক্ষতি হয়নি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই প্রাসাদোপম বাড়িটি মুক্তিযোদ্ধাদের একটি স্থায়ী ঘাঁটি এবং আশ্রয়স্থল হিসেবে বড় ভুমিকা রেখেছিল।
কে ছিলেন হেমচন্দ্র চৌধুরী?
হেমচন্দ্র ছিলেন তাঁর পরিবারে তৃতীয় প্রজন্মের জমিদার। এই জমিদারি তাঁর পরিবারে কিভাবে এলো, সেটির প্রেক্ষাপট কিছুটা না বললেই নয়।
মোঘল সাম্রাজ্যের সময় যে জমিদারি প্রথা ছিল, তাতে জমির মালিক থাকতো সরকার, সাধারণ মানুষ সেটি ভোগ করতে পারতো। জমিতে বাড়িঘর তুলে থাকা, চাষ করে ফসল ভোগ করা, ব্যবসা বানিজ্য করা ইত্যাদির মুক্ত অধিকার ছিল সাধারণ মানুষের। বছর শেষে খাজনা দিতে হতো। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলের ক্ষতি হলে খাজনা কম দিলেও সমস্যা ছিল না। অনেক সময় জমিদার তা মওকুফও করে দিতেন। জমিদার থাকতেন মূলত তাঁর বিশাল কর্তৃত্বের এলাকার ট্যাক্স বা খাজনা সংগ্রহ করে সরকারকে পৌঁছে দেয়ার জন্য। সাধারণ মানুষ যা খাজনা জমিদারদের দিতেন বাৎসরিক ভিত্তিতে, এখান থেকে একটি নির্ধারিত অংশ দিতে হতো সরকারের কাছে, বাকীটা জমিদার ভোগ করতে পারতেন। এতে সরকার যেমন খুশি ছিল, জমিদারও খুশি, মানুষও খুশি ছিল।
ব্রিটিশ আমলে এসে রাজস্ব বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ১৭৯৩ সালে নতুন একটি আইন করা হয়, যার মাধ্যমে চিরস্থায়ীভাবে জমির মালিক বানিয়ে দেয়া হলো জমিদারদের, জনসাধারণ হয়ে গেল জমিদারের প্রজা। সংক্ষেপে এটিই ছিল “চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত” প্রথা। এই আইনে খাজনা দিতে হলো মাসিক ভিত্তিতে। ঝড়, বন্যা, খরা যাই হোক না কেন, সমান কিস্তিতেই খাজনা দিতে হতো। জমিদার সরকারের কাছে মাসের নির্ধারিত তারিখে সুর্যাস্তের আগে খাজনা দিতে না পারলে জমি নিলামে উঠে যেত। অন্য জমিদাররা সেটি কিনে নিতে পারতেন। এটিই লোকমুখে নাম হয়ে গেল “সুর্যাস্ত আইন”।
জমি হারানোর ভয়ে আরম্ভ হলো জোর করে প্রজাদের কাছ থেকে জমিদারদের খাজনা আদায়, তাতে অত্যাচার অবিচার বাড়তে লাগলো। জমিদাররা লাঠিয়াল বাহিনী পাঠিয়ে জোর জবরদস্তি করতেন প্রজাদের উপর। তবে সবাই তো আর অত্যাচারী জমিদার ছিলেন না। কিন্তু খাজনা আদায় হতো না বলে বহু জমিদারের এলাকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ নিলামের মাধ্যমে চলে গেল অন্য জমিদারদের হাতে।
এই সময়ে আবার কিছু সুবিধাভোগি জমি ব্যবসায়ী দাঁড়িয়ে গেল। সুর্যাস্ত আইনে নিলামে তোলা জমি কিনে আবার বেশি দামে সেই জমিদারদের কাছেই বিক্রি করতে লাগলো কিছু লোক। কেউ কেউ এভাবে নতুন জমিদারও বনে গেল।
ঠিক এইভাবেই এক নতুন জমিদারের আবির্ভাব হলো, যার নাম ছিল পদ্মলোচন রায়। তিনি ১৮৪৮ সালে পুথুরিয়া (মধুপুর) পরগনার জমিদার ভৈরবচন্দ্রের জমিদারির দুই আনা (আট ভাগের এক ভাগ) জমি কিনে নিয়ে হয়ে গেলেন জমিদার। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র কালীচন্দ্র রায় ১৮৫৫ সালে ঐ একই জমিদারের আরও এক চতুর্থাংশ জমি কিনে নেন। এই অংশটি ছিল আজকের গোপাল্পুর এলাকায়। কালী চন্দ্রের ছিল দুই স্ত্রী হরগঙ্গা দেবী ও শশীদেবী। হরগঙ্গা দেবীর ঘরেই ১৮৩৩ সালে মধুপুরে জন্ম হয়েছিল হেমচন্দ্র রায়ের।
কোলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে আইনে পড়ালেখা করা হেমচন্দ্র তাঁর বাবার মৃত্যুর পর জমিদারির দায়িত্ব পেলেন। আইনজীবি হওয়ায় সুবিধাও ছিল। সুযোগ পেলেই জমি কেনার চল চলতেই থাকে। একবার মুক্তাগাছার জমিদার সুর্যকান্ত রায়কে টেক্কা দিয়ে এক নিলামেই কিনে নিয়েছিলেন ৮৫,০০০ একর জমি। এভাবে টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ মিলিয়ে তাঁর জমিদারীর এলাকা ৪ লক্ষ একরে পরিণত হয়েছিল। তখন হেমচন্দ্র রায় থেকে নাম পরিবর্তন করে তিনি হয়ে গেলেন হেমচন্দ্র চৌধুরী।
শেষ বয়সে তাঁর করা একটি মামলার কারণে হেমচন্দ্রের নাম ব্রিটিশ পার্লামেন্টেও আলোচিত হয়েছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা বাতিল হবার পরও সেই অত্যাচারী নিয়মগুলি বহাল রাখার জন্য কোলকাতা আদালতের প্রথম রিয়্যাল এস্টেট মামলা করেছিলেন হেমচন্দ্র। অত্যাচারী জমিদাররা এতে খুশী হলেও দুই বাংলার সাধারণ প্রজারা ক্ষিপ্ত হয়। তাঁর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয় বিভিন্ন জেলায়। হেমনগর প্রাসাদের সামনে এক রাতে একটি গরু জবাই করে তার রক্তাক্ত দেহ রেখে যাওয়া হয় প্রাসাদের সিঁড়িতে। প্রাসাদ রক্ষীরাও এতে জড়িত সন্দেহ করে সেদিনই প্রাণভয়ে তিনি পালিয়ে যান কোলকাতায়। হেমনগরে আর কখনই ফেরেননি। ১৯১৫ সালে ভারতের ব্যানারসে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
হেমচন্দ্র চৌধুরীর অবদান
খাজনা আদায়ে একজন রুক্ষ এবং অত্যাচারী জমিদার হলেও শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্যসেবা, বা যোগাযোগব্যবস্থা সম্প্রসারণে হেমচন্দ্র চৌধুরীর অবদানের ফিরিস্তি যথেষ্ট দীর্ঘ।
১৯০০ সালে তাঁর সৎ মাতার নামে ২০ একর জমির উপর হেমনগর শশীমুখী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করেন হেমচন্দ্র। এছাড়াও গোপালপুরের সুতী ভিএম পাইলট হাই স্কুল ও পিংনা হাই স্কুল প্রতিষ্ঠায় জমি ও অর্থ দান করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল স্কুল (বর্তমানে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ), ময়মনসিংহ ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল, পিংনা দাতব্য চিকিৎসালয়, গোপালপুর বালিকা বিদ্যালয় এবং সুদূর বরিশালে একটি মুক ও বধির বিদ্যালয় স্থাপনে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ দান করেছিলেন। ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ প্রতিষ্ঠার শিলা লিপিতে যে দশজন দাতার নাম রয়েছে, তার মধ্যে চতুর্থ স্থানে রয়েছে তাঁর নাম।
১৯০৫ সালে ময়মনসিংহ থেকে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট পর্যন্ত রেলওয়ে লাইন সম্প্রসারণে তাঁর ছিল বিশাল ভুমিকা। এর ফলে ঢাকার সাথে কোলকাতার রেল ও স্টীমার যোগাযোগ সহজ হয়ে যায়। সুবর্নখালী থেকে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার সড়কে হেরিংবন্ড করে টমটম বা পালকিতে যাতায়াতের ব্যবস্থাও করেন হেমচন্দ্র। এটিই ছিল গোপালপুর উপজেলার প্রথম পাঁকা সড়ক।
প্রজাদের পানীয় জলের সুবিধার্থে রাস্তার মোড়ে মোড়ে কুয়া ও বহুসংখ্যক পুকুর খনন করেন। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ মন্দির ও চন্দ্রনাথ পাহাড়ে তীর্থযাত্রীদের জন্য লোহার সেতু নির্মাণে এবং টাঙ্গাইল ফৌজদারী উকিলবার প্রতিষ্ঠায় সার্বিক সহায়তা করেন হেমচন্দ্র। ম্যালেরিয়ার স্বর্গরাজ্য বলে কথিত হেমনগরে তিনি মায়ের নামে স্থাপন করেছিলেন হরদুর্গা দাতব্য চিকিৎসালয় এবং ডাকঘর মারফত প্রতি মাসে আনা ১৫ পাউন্ড কুইনিন ঔষধ বিতরণ করতেন। ছেলে ফুটবল খেলতো বলে বহু জেলায় স্পোর্টস ক্লাব প্রতিষ্ঠাতেও বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়েছিলেন হেমচন্দ্র চৌধুরী। সারা বছর তাঁর মুসলমান প্রজাদের বিরুদ্ধে একটু বেশী কঠোর অবস্থানে থাকলেও রমজান মাস জুড়ে প্রতিদিন ইফতারের ব্যবস্থা করা হতো। এজন্য একটি ডাকবাংলো নির্মান করে দিয়েছিলেন তিনি।
জমিদারীতে পরবর্তী প্রজন্ম
হেমচন্দ্র চৌধুরীর মৃত্যুর পর জমিদারীর দায়িত্ব আসে তাঁর পরের প্রজন্মগুলির কাছে। তাঁর ছিল চার ছেলে ও চার মেয়ে। ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের পর দাঙ্গার ভয়ে প্রায় সবাই চলে যায় ভারতের বিভিন্ন শহরে। থেকে যায় শুধু তাঁর দুই ভাইপো। ১৯৫০ সালে জমিদার প্রথা বাতিল হয়ে গেলে জমিদার বাড়ী এবং আশপাশের কিছু জমি পরিবার ধরে রাখতে সক্ষম হয়। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তাঁরাও চলে যান ভারতে। ৭১এর পর তাঁর একজন বংশধর ফিরে আসেন। কথিত আছে, তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে খান সাহেব নামে পরিচিত ছিলেন। একে একে জমি বিক্রী করে কিছুদিন চলেছেন, এক সময় তিনিও হারিয়ে গেছেন।
রাজবাড়িটির বর্তমান অবস্থা
আমার দেখা এরকম পরিত্যক্ত যত জমিদার বড়ি আছে, আমি বলতেই পারি সব চাইতে ভালো অবস্থায় পাওয়াগুলির একটি হলো হেমনগর জমিদার বাড়ি। বাড়িটিতে ১৯৭৯ সালে একটি ডিগ্রী কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এখনও কাগজে কলমে কলেজের অধীনে থাকলেও বহু বছর ব্যবহৃত হচ্ছে না। তবে বাড়ীটি বেদখল হয়ে যায়নি। দরজা জানালার কাঠ খুলে নিয়ে যাওয়া হলেও দেয়াল ভেঙ্গে ইট খুলে নেয়া হয়নি।
বাড়িটির সামনের অংশের চিনিটিকরির কাজ প্রায় অক্ষত অবস্থাতেই আছে। অল্প কিছু জায়গা হয়তো মানুষ খুঁটিয়ে নষ্ট করেছে। তবে যেটুকু আছে, ধুলার আস্তরণের মাঝেও দেখে বিমোহিত হতেই হবে। শুধু সামনেই নয়, ভেতরেও দেয়ালগুলির প্লাস্টারেও যে কারুকাজ অবশিষ্ট রয়েছে, সেগুলিও দেখার মত। করিন্থিয়ান স্টাইলে বানানো পিলারের চুড়াগুলিতে কারুকাজ এখনও প্রায় অক্ষত অবস্থাতেই আছে। অধিকাংশ ঘরের মেঝে এখনও প্রায় অক্ষত অবস্থায় আছে। একটি ঘরে দাবা, পাশা বা ১৬গুটি খেলার ব্যবস্থা যে ছিল, তার নমুনা ঘরের মেঝেতে এখনও বিদ্যমান।
কাঠামোগত দিক থেকে ভবনটিকে দেখে এখনও বেশ মজবুত বলেই মনে হয়। ভবনটির উপর কিছু গাছ গজিয়ে গেছে। এগুলি ছোট থাকা অবস্থাতেই উপড়িয়ে ফেলতে পারলে বড় কোনো ক্ষতি থেকে সহজেই ভবনটিকে রক্ষা করা সম্ভব।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, অল্প খরচেই এই অনন্য প্রাসাদটিকে তার আগের জৌলুসে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু কাজটি কে করবে, সেটিই প্রশ্ন!
কীভাবে যাবেন?
টাঙ্গাইল থেকে সিএনজি অটোরিক্সায় যাওয়া যায়। ভাড়া নিবে অন্তত ২০০ টাকা। মহাখালী থেকে গোপালপুর বাসে যাওয়া যায়। গোপালপুর থেকে অটোরিক্সা পবেন। জমিদার বাড়ীর জিপিএস অবস্থান হল (২৪°৩৩’৫৬.৪১”উ, ৮৯°৫১’১২.৫০”পু)।
বি. দ্র.
ঐতিহ্য, স্থাপত্য বা পুরাতত্ব – এগুলি কখনই আমার পাঠ্যবিষয় ছিল না। ইতিহাস শেষ পড়েছি আজ থেকে ৪৫ বছর আগে। আমার পেশার সাথেও এগুলির সম্পর্ক নেই। আমার শখ হলো ঘোরা এবং ছবি তোলা, বিশেষ শখ হলো হেরিটেজ সাইটগুলি দেখা, অর্থাৎ যে স্থাপনাগুলির বয়স অন্তত ১০০ বছর। স্থাপনাটি পছন্দ হলে নেট থেকে একটু জানা। বিভিন্ন সুত্র খুঁজে তথ্যটুকু ক্রসচেক করে যথাসম্ভব ত্রুটিমুক্ত রাখতে চেষ্টা করি। সাইটগুলিতে আসতে যেতে মানুষের সাথে কথা বলি, অনেক মজার গল্প শোনা যায়। সেগুলিও টুকে রাখি। এই তথ্য, গল্প ও ছবি নিয়ে নিছক আনন্দের জন্যেই এই সিরিজ। এটিকে গবেষনা ভাববার, বা রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ নেই।
১৯০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ভুখন্ডে যত দ্বিতল বা ত্রিতল ভবন ছিল, তার প্রায় সবই ছিল কোনো না কোনো রাজা, নওয়াব, জমিদার, বা বড় ব্যবসায়ীর প্রাসাদ, বা তাঁদের গড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অথবা ধর্মীয় উপাসনালয়। পশ্চিমের দেশগুলিতে ততদিনে গৃহনির্মানে আধুনিক সিমেন্ট ব্যবহার হলেও, এই অঞ্চলে তা আসেনি। ভবনগুলি নির্মান হয়েছিল পোড়া মাটির ইট এবং চুন-সুড়কির গাঁথুনিতে।
১৮৯৭ সালে আসামে একটি বড় ভুমিকম্প হয়, যা বাংলাদেশব্যাপী তীব্রভাবে অনুভূত হয়। এর প্রভাবে আমাদের ভুখন্ডের প্রায় সকল অঞ্চলের ভবনগুলি কিছু না কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যে ভবনগুলি সেবার হয়তো উৎরে গেছে, মাঝারী আকারেরও আরেকটি ভুমিকম্পে এগুলি টিকবে, এ কথা বলা কষ্টকর। আর এর সাথে তো রয়েছেই দীর্ঘদিনের অবহেলা এবং অযত্ন। চলুন না, আমাদের দেশের বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রত্নের মত এই হেরিটেজ সাইটগুলি সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যাবার আগেই দেখে আসি!
ভ্রমণ যখন বা যেখানেই করি না কেন, পরিবেশের পরিচ্ছন্নতার দিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। সবাই যে করে, তা নয়। এই স্থাপনাগুলি দেখলে তা আরও বেশী চোখে পড়ে। আপনার পরবর্তি প্রজন্মের ভ্রমণ পীপাসুদের জন্য হলেও আপনার ব্যবহৃত জিনিষ নির্ধারিত জায়গায় ফেলুন, বা সাথে করে নিয়ে আসুন।
আমার এই সিরিজের আরেকটি উদ্দেশ্য আছে। আমাদের প্রজন্মের বহু মানুষ জীবনের প্রয়োজনে পাড়ি জমিয়েছে নানা দেশে। ওই দেশগুলিতে জন্ম নেয়া এবং বেড়ে ওঠা পরের প্রজন্মগুলি এই দেশ, এর কৃষ্টি-সভ্যতা বা সোনালী অতীত জানবার সুযোগ পায়নি। গর্ব করবে কী নিয়ে? তারাও জানুক, আমরা কেন গাই...আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি!