কক্সবাজার-চট্টগ্রামকে ‘মাদকপ্রবণ এলাকা’ ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার

মাদক প্রবেশের সবচেয়ে বড় রুট কক্সবাজার জেলা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকাকে মাদকপ্রবণ এলাকা ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। সংসদীয় কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার মাদকপ্রবণ অঞ্চল ঘোষণার রূপরেখা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। এই দুই এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযান জোরদার করা হবে।
রবিবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক এ তথ্য জানানো হয়েছে।
কমিটির সভাপতি বেনজীর আহমেদের সভাপতিত্বে ওই বৈঠকে কমিটির সদস্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সামছুল আলম দুদু, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, পীর ফজলুর রহমান, নূর মোহাম্মদ ও রুমানা আলী এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গত ১৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত কমিটির আগের বৈঠকে মাদক পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বিষয়টি নিয়ে আলোচনাকালে মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত রোহিঙ্গাদের বিচারে পৃথক আইন প্রণয়নের প্রস্তাব আসে।
কমিটি সূত্র জানায়, আগের বৈঠকের সুপারিশ বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনাকালে মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সব বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সমন্বয় সভায় গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্যসূচি হিসেবে বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়। সভায় সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে মতবিনিময় করে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকা এবং কক্সবাজার জেলাকে মাদকপ্রবণ এলাকা ঘোষণা করার বিষয়ে একটি রূপরেখা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। এ বিষয়ে পরবর্তী কার্যক্রমও চলমান রয়েছে।
কমিটির বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে জানা গেছে, আগের বৈঠকে সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল্লাহ্ আল মাসুদ চৌধুরী জানান, মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হলেও উৎপাদনকারী দেশগুলোর কাছাকাছি অবস্থান ও ভৌগলিক কারণে বাংলাদেশ মাদকে আক্রান্ত। মিয়ানমার থেকে ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ, ভারত থেকে হেরোইন, গাঁজা, ফেন্সিডিল ও ইনজেক্টিক ড্রাগের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঘটে। তিনি সীমান্তবর্তী এলাকায় মাদক চোরাচালান রোধে সীমান্ত পাহারা জোরদার, স্যাটেলাইট মনিটরিং প্রযুক্তি স্থাপন এবং চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন, চট্টগ্রাম জেলা ও কক্সবাজার এলাকাকে মাদকপ্রবণ অঞ্চল ঘোষণা করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি তুলে ধরেন।
বৈঠকে ১০ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল ফখরুল আহসান বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যা করছে, তা দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে করছে। এরা রাতে ওপারে গিয়ে সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মাদক পাচার করছে। যে মাদক উদ্ধারের কথা জানা যায়, তা মূলত ২ বা ৩ শতাংশ মাত্র। এতে সহজেই অনুমান করা যায়, কী বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সেখানে সম্পৃক্ত। এ এলাকাটি এখন মাদকের অভয়ারণ্য। সেখানে মসজিদের ইমামও মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত। এই এলাকায় দিনের বেলায় এক চিত্র, রাতে তা সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। এ অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে স্থানীয় লোকও সম্পৃক্ত হয়ে যাচ্ছে। তাই বিষয়টি কঠোরভাবে দমন করা জরুরি।
কোনাপাড়া ক্যাম্প ও নো-ম্যান্স ল্যান্ডে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের চলাচল এবং যোগাযোগ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি উল্লেখ করে মেজর জেনারেল ফখরুল আহসান বলেন, রোহিঙ্গারা আলাদা জনগোষ্ঠী এবং তাদের সংস্কৃতি আলাদা। এরা এদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী। তাদের অপরাধের বিচার এদেশের প্রচলিত আইনে না করে, তাদের জন্য আলাদা আইনি ব্যবস্থা রাখা দরকার, যাতে অপরাধ সংগঠিত করে বের হয়ে যেতে না পারে। মাদকের বিচারকাজে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করে, একটা উদাহরণ সৃষ্টি করা দরকার, যাতে অন্যরা ভয় পায়, বুঝতে পারে যে, বেআইনি কাজ করলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা বিদ্যমান আছে।
বৈঠকে বর্তমানে রোহিঙ্গা সমস্যা জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি বড় হুমকি বলে উল্লেখ করেন ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান।
তিনি বলেন, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা ডাটাবেজ তৈরি করা হয়। রোহিঙ্গা ডাটাবেজটি এনটিএমসিকে প্রদান করা হলেও ২০১৮ সালের পরবর্তী সময়ে তা হালনাগাদ করা হয়নি। ফলে বর্তমানের ডাটাবেজ না থাকায় আইন প্রয়োগকারী, গোয়েন্দা ও তদন্তকারী সংস্থাগুলো বিভিন্ন তদন্তের স্বার্থে রোহিঙ্গাদের হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ করতে পারছে না। এতে তদন্ত কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণার পুনোরুল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, মাদক পাচারের সঙ্গে, মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি যিনিই হোক না কেন, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। মাদক ব্যবসায়ী যত শক্তিশালীই হউক না কেন, প্রধানমন্ত্রীর থেকে তারা শক্তিশালী নয়। ১৬ কোটি মানুষের স্বার্থের সঙ্গে কোন আপস হতে পারে না।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে এখানে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। এখানে বাস করতে হলে আমাদের দেশের আইন মানতে হবে। আমাদের রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়, এমন কর্মকাণ্ড থেকে তাদের দূরে থাকতে হবে। এসব বন্ধ না করলে হয় তারা তাদের দেশে ফেরত যাবে, না হয় অবৈধ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে, যোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘কক্সবাজার অঞ্চল মাদকপ্রবণ এলাকা বলেই সেখানে সংসদীয় কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।’
বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সদস্য পীর ফজলুর রহমার বৈঠকে বলেন, ‘মাদক পাচারের বিভিন্ন রুটের মধ্যে কক্সবাজার রুটেই বেশিরভাগ মাদক প্রবেশের কথা জানা যায়। বর্তমানে মাদক পাচার কমে যাওয়ার পরিবর্তে এখন প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালে একশ’র বেশি তালিকাভুক্ত মাদক পাচারকারী আত্মসমর্পণ করেছিল। যারা আত্মসমর্পণ করেছে, তারা আবারও পাচার কর্মকাণ্ডে জড়িত হচ্ছে। কক্সবাজার এলাকায় মাদকপাচার রোধে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীদের বিশেষ ভাতার আওতায় আনার প্রস্তাব করেন তিনি।
বৈঠকে কমিটির সভাপতি বেনজীর আহমদ বলেন, ‘জিরো পয়েন্টে আশ্রয়গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। কারণ, মাদকপাচারের বড় রুট হিসেবে এ পয়েন্টটি চিহ্নিত হয়ে আছে।’
সর্বশেষ বৈঠকে কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের তাগিদ দেওয়ার পাশাপাশি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে ও মানবিক সেবায় নিয়োজিত সকল স্তরের পুলিশ, আনসার, র্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড, ফায়ারসার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ঝুঁকি ভাতা প্রদানের সুপারিশ করা হয়।
এনএইচবি/এমএমএ/
