ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ১৯
দ্য ফার্স্ট ম্যান
বিকট কাঁপুনির শব্দে বোঝা যেত প্রক্ষেপণ যন্ত্র চালু হচ্ছে। ঠিক তখনই জ্যাকের কঠিন পরীক্ষা শুরু হয়ে যেত।
দর্শকরা তখন চুপ করে গেলে কাহিনীর রূপরেখা পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য প্রথমত খানিকটা লিখিত টেক্সট দেখানো হতো। নানি নিরক্ষর হওয়ার কারণে জ্যাককে ওই টেক্সট পড়ে শোনাতে হতো। বয়স অনেক হলেও নানি কানে ঠিকই শুনতে পেতেন। প্রথমত জ্যাক পিয়ানোর উচ্চ শব্দ এবং দর্শকদের হৈচৈ ভেদ করে নিজে আগে শুনে নিত। টেক্সটের ভাষা সহজ সরল হলেও সেখানকার কিছু শব্দ খুব একটা পরিচিত ছিল না নানির, আর অন্য শব্দগুলো পুরোপুরিই অজানা থাকত। জ্যাক অন্য দর্শকদের বিরক্তি উৎপাদন করতে চাইত না এবং অন্যরা যাতে মনে না করতে পারে, তার নানি পড়াশোনা জানে না সেজন্য সে খুব আস্তে পড়ে শোনাত নানিকে। কখনও কখনও টেক্সটের কিছু কিছু অংশ বাদ দিয়ে যেত। নিজের পড়াশোনা না জানার কথা যাতে অন্য কেউ বুঝতে না পরে সেজন্য নানিও শুরুতে জোরে জোরে বলে নিতেন, তুই আমাকে পড়ে শোনাস? আমার চশমা আনতে ভুলে গেছি। সুতরাং জ্যাক নিচু স্বরে পড়ত। ফলে নানি অর্ধেকটা বুঝতে পারতেন এবং জ্যাককে পুনরায় জোরে পড়তে বলতেন। জ্যাক আরেকটু জোরে বলতে চেষ্টা করত এবং পাশের লোকদের নীরবতা তাকে লজ্জায় ফেলে দিত। জ্যাক তখন তোতলাতে থাকত এবং নানি কড়া গলায় বকুনি দিতেন। ততক্ষণে আরেক টেক্সট এসে গেছে এবং পুরো ব্যাপরটা নানির কাছে আরো ধাঁধালো হয়ে উঠেছে। কারণ তিনি আগের টেক্সটটা ভালো করে বুঝতেই পারেননি। গোলমেলে অবস্থা বাড়তেই থাকত এবং শেষে জ্যাক আরো গভীর মনোযোগের সঙ্গে কিছুটা টেক্সটের গুরুত্বপূর্ণ অংশ সংক্ষেপে একবারে বলে দিত: যেমন দ্য মার্ক অব জেরো’র ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্কস সিনিয়রের অংশ থেকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জ্যাক বলত, খলনায়ক ওর কাছ থেকে মেয়েটাকে ছিনিয়ে নিতে চাইছে। জ্যাক এই কাজটা করত পিয়ানোর এবং দর্শকদের সাময়িক বিরতির সুযোগ নিয়ে। এভাবেই লেখাগুলো পড়া শেষ হলে যখন ছবি চলা শুরু হতো তখন কেবল জ্যাক হাঁফ ছেড়ে বাঁচত। তবে লেস ডিউক্স অরফেলিনেস-এর মতো জটিল কিছু চলচ্চিত্রও ছিল। তখন নানির কৌতুহল মেটানোর চাহিদা আর আশপাশের দর্শকদের বকুনির মাঝে জ্যাক পুরোপুরি চুপ হয়ে বসে থাকত। জ্যাকের এখনও মনে আছে, একবার নানি রণে ভঙ্গ দিয়ে সিনেমা হল থেকে বের হয়ে একা একাই হাঁটা দিলেন। পেছনে জ্যাকও হাঁটা শুরু করল। তার মনে তখন বেজায় আফসোস- নানির বিরল আনন্দের একটাকে সে নষ্ট করে ফেলেছে। আফসোসের অরেকটা কারণও ছিল: তখন তার মনে হতো, ওই আনন্দের পেছনে তাদের পরিবারের অল্প আয় থেকে কিছুটা হলেও ইতোমধ্যে ব্যয় করা হয়ে গেছে।
জ্যাকের মা অবশ্য কখনওই ওই রকম কোনো প্রদর্শনী দেখতে যেতেন না। তিনি পড়তে পারতেন না এবং কানেও খুব কম শুনতে পেতেন। তাছাড়া তার শব্দভাণ্ডরের মজুদ তার মায়ের চেয়েও কম ছিল। এখনও তার জীবনে কোনো ব্যতিক্রমী কিছু নেই। চল্লিশ বছরে তিনি দুই থেকে তিনবার সিনেমা হলে গিয়েছেন। কিছুই বুঝতে পারেননি এবং নিজের ইচ্ছেয় কখনওই যাননি। যারা তাকে সিনেমায় নিয়ে যেতে চেয়েছে শুধু তাদের মন রক্ষার্থে গিয়েছেন: যাতে তিনি বলেন অমুক তমুক পোশাক খুব সুন্দর হয়েছে। কিংবা গোঁফঅলা দেখতে কী বিচ্ছিরি ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনি রেডিও শোনেননি কোনো দিন। খবরের কাগজ পড়ার বিষয়টা ছিল এরকম: পাতা উল্টিয়ে তিনি শুধু ব্যাখ্যামূলক সচিত্রীকরণ দেখেন; সেখানকার ছবিগুলোর অর্থ বোঝার জন্য ছেলেদের কাউকে কিংবা নাতনিদের ডাকেন। ছবি দেখে হয়তো বুঝতে পারেন ইংল্যান্ডের রাণীর মন খারাপ। এরপর কাগজ গুটিয়ে রেখে ওই জানালা দিয়ে বাইরে রাস্তায় চলমান কর্মকাণ্ড দেখেন যেমন করে চল্লিশ বছর ধরে দেখে আসছেন।
এক অর্থে জীবনের সঙ্গে জ্যাকের মামা অর্নেস্টের যতখানি সংশ্লিষ্টতা ছিল তার চেয়েও কম ছিল তার মায়ের। এই মামা তাদের সঙ্গেই থাকত। কানে কিছুই শুনতে পেত না এবং নিজের মনের ভাব প্রকাশ করার ক্ষেত্রে যতটা তার নিয়ন্ত্রণাধীন শ খানেক শব্দ দিয়ে বুঝাতেন ঠিক ততটাই বুঝাতেন ধনাত্বক শব্দ আর ইঙ্গিতে। তবে আর্নেস্টকে ছোটবেলায় কাজে পাঠানো যায়নি বলে মাঝে মধ্যে তার স্কুলে যাওয়া হয়েছে এবং এই কারণে সে বর্ণমালার অক্ষরগুলো চিনেছিল। মাঝে মধ্যে আর্নেস্ট মামাও সিনেমায় যেত এবং ফিরে এসে যে বর্ণনা দিত তাতে অন্য সবাই স্তম্ভিত না হয়ে পারত না। কারণ আগেই তারা সিনেমাটা দেখে এসেছে এবং মামা যে অংশগুলো ধরতে পারেনি সেগুলো ভরিয়ে দিয়েছে তার কল্পনার জোরে। তাছাড়া সে তীক্ষ্ম বুদ্ধি সম্পন্ন এবং কুশলীও ছিল। সহজোৎপন্ন বুদ্ধি তাকে এই জগৎ এবং মানুষদের মাঝে নিজের পথ করে নিতে সহায়তা করেছে। নইলে জগৎ সংসারের সবাই তার সামনে অনমনীয়ভাবে নীরব থাকত হয়তো। ভাগ্যিস, ওই বুদ্ধিটা ছিল বলে সে প্রতিদিন খবরের কাগজে ডুবে থাকতে পারত এবং খবরের শিরোনামগুলো বুঝতে পারত। পৃথিবীর চলমান বিষয় বুঝে ফেলার প্রমাণস্বরূপ মাথা দোলাত। যেমন জ্যাকের বোঝার বয়স হওয়ার পরে মামা খবরের কাগজ পড়ার সময় তাকে শুনিয়ে বলত, হিটলার, ভালো না, তাই না?
না, ভালো না।
হুনরা সব সময় একই রকম, মামা বলত।
না, সেরকম নয়।
হ্যাঁ, অবশ্য কেউ কেউ ভালো। আবার মাথা ঝাঁকিয়ে বলত, হিটলার, ভালো না। তারপর একটু তামাশা করে কথায় ওপরে থাকার জন্য রাস্তার ওপারে কাপড়ের ব্যসায়ীর কথা উল্লেখ করে বলত, লেভি, ভয় পায়। বলেই একটা অট্টহাসি দিত। জ্যাক ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করত। মামা হাসি থামিয়ে আবার গম্ভীর হয়ে যেত এবং বলত, হ্যাঁ, এই জন্য সে ইহুদিদের মারতে চায়? ওরাও তো অন্যদের মতোই।
জ্যাককে মামা খুব ভালোবাসত, তবে নিজের মতো করে। স্কুলে ভালো ফলাফল করলে প্রশংসা করত। মামা জ্যাকের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করত। জ্যাক টের পেত অস্ত্রপাতির ব্যবহার আর কায়িক শ্রমের ফলে মামার হাতের তালুতে কড়া পড়া। খুব ভালো মাথা, এই মাথা, বলে মামা নিজের মাথায় মুষ্টি দিয়ে হালকা আঘাত করত। কখনও কখনও জ্যাকের বাবার বুদ্ধির দৃষ্টান্তও টানত, ভালো মাথা, বাবার মতো।
একদিন জ্যাক সেই সুযোগে মামাকে জিজ্ঞেস করে বসল তার বাবা খুব বুদ্ধিমান ছিলেন কি না।
মামা বলল, তোর বাবা, ভালো মাথা, যা চাইতেন করতে পারতেন। আর তোর মা, হ্যাঁ, সব সময়, খুব খুব।
মামার কাছ থেকে এর চেয়ে আর বেশি কিছু বের করতে পারেনি জ্যাক।
যে কোনো কাজেই পারলে আর্নেস্ট জ্যাককে সঙ্গে নিতে চেষ্টা করত। তার শক্তি এবং উদ্যম কথায় এবং সামাজিক জটিল সম্পর্কের ভেতর দিয়ে প্রকাশ পেত না ঠিকই; তবে শারীরিক মাধ্যমে
এবং সংবেদনশীলতার মাধ্যমে বিস্ফোরণের মতো প্রকাশ পেত। এমনকি ঘুম থেকে জেগে ওঠার সময়েও যদি কেউ তাকে জাগিয়ে দিত তাহলে বুনো দৃষ্টিতে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে জোরে শব্দ করে উঠত, হুমম, হুমম, যেন প্রাগৈতিহাসিক কোনো পশুকে বৈরী এবং অচেনা কোনো পরিবেশে জাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে একবার ভালো করে জেগে উঠলে তার শরীর এবং শরীরের কার্যকলাপ তাকে নিজের পায়ের ওপর ঠিক মতো দাঁড়িয়ে যেতে সহায়ক হতো। টব, পিপে ইত্যাদি নির্মাণের কঠিন পরিশ্রমের পরও সে সাঁতারে এবং শিকারে যেতে পছন্দ করত। বালক জ্যাককে নিয়ে সে সাবলেত্তেস সৈকতে যেত: জ্যাককে পিঠে চড়িয়ে অপটু তবে শক্তিশালী বাহু সঞ্চালনে পানির ভেতর নেমে পড়ত আর দুর্বোধ্য শব্দ করত। পানির ঠাণ্ডা স্পর্শে বিস্ময়বোধ, সৈকতে নেমে পড়ার আনন্দ এবং পথভোলা কোনো ঢেউয়ের প্রতি তার রাগ প্রকাশ করত। জ্যাককে উদ্দেশ করে বার বার বলত, ভয় পাসনে। জ্যাক অবশ্যই ভয় পেত, তবে বলত না। বিশাল আকাশ আর বিশাল সমুদ্রের মাঝখানের ওই জনমানবহীন পরিবেশ জ্যাককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখত। পেছনের দিকে দেখতে পেত, সৈকতটা আবছা আবছা একটা রেখার মতো দেখাচ্ছে; একটা চিনচিনে ভয় তার পাকস্থলী পর্যন্ত ছেয়ে ফেলত। আতঙ্কের শুরুতেই মনে হতো, মামা যদি ছেড়ে দেয় তাহলে অন্ধকার গভীরতার তলে এক টুকরো নুড়ির মতো সে পড়ে থাকবে। তখন বালক জ্যাক মামার গলা আরেকটু বেশি শক্ত করে ধরত। মামা বলত, তুই ভয় পাচ্ছিস।
জ্যাক বলত, ভয় পাচ্ছি না। তবে ফিরে চলো।
চলবে..