ভেটেরিনারিয়ানদের গল্প বলি
গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসনানুল কবীর পড়েন ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস অনুষদে। তিনি লিখেছেন বাংলাদেশে পশুপালন ও পশুচিকিৎসা শিক্ষা, পেশাটির ইতিবৃত্ত
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান। আমরা সবাই জানি, এই দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য, দ্রব্যাদির ওপর নিভরশীল। খাতটি প্রাণীসম্পদের ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। ফলে গরু, ছাগল ইত্যাদি কৃষি ও কৃষিনিভর গেরস্থালি পশুদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ উন্নতি ছাড়া কৃষিখাতকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না। প্রাণীদের উন্নতির জন্য প্রয়োজন শিক্ষিত, আধুনিক ‘ভেটেরিনারিয়ান’ বা ‘পশু চিকিৎসক’। সংক্ষেপে আমরা এই পেশাজীবিদের বলি ‘ভেট’। তবে দু:খের বিষয়, এখনো শত, শত বছরের কৃষিনির্ভর এই দেশের মানুষ ভেটেরিনারি বা ‘পশুচিকিৎসা’ সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন না। আধুনিক নগরের মানুষ জানেন না ভেটেরিনারি কী? ভেটেরিনারিয়ানদের কাজ ও প্রয়োজনীয়তা? গ্রামের কৃষিজীবিরা এই পেশাসংশ্লিষ্ট নিবিড়ভাবে হলেও এখনো অজ্ঞতার সাগরে ডুবে আছেন। তবে বাংলাদেশের পশুসম্পদের সুস্বাস্থ্য ও দেশের মানুষের খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও খাদ্য নিরাপত্তা তৈরিতে ভেটেরিনারিয়ানরা অন্যতম প্রধান অংশীদার। আমাদের কারোরই জানা নেই যে, বাংলাদেশের প্রাণীজ আমিষের শতকরা ৭৬ ভাগ পূরণ করা হচ্ছে আধুনিক ভেটেরিনারি শিক্ষায় শিক্ষিত পশু চিকিৎসকদের মাধ্যমে। তারা পশুদের প্রয়োজনীয় ওষুধ প্রদান, রোগ নিয়ন্ত্রণ, ভালোভাবে বেঁচে থাকা, নিরাপদ রাখা, বিভিন্ন রোগবালাইয়ের প্রতিশোধক আবিস্কার, টিকা তৈরিসহ প্রতিকারের সব ব্যবস্থা করেন।
ভেটোনিরারি আক্ষরিক বা বইয়ের ভাষায়, পশুপালনবিদ্যা ও পশুচিকিৎসা। আধুনিক পদ্ধতিগুলো মেনে পশুপালন, তাদের প্রজননের ব্যবস্থা গ্রহণ, চিকিৎসা প্রদানই পশুচিকিৎসকে বইখাতার জ্ঞানে লাভ করতে হয়। তাদের থাকে ফিল্ড ট্রিপ ও ইন্টার্নের ব্যবস্থা। পোলট্রি শিল্পে এই দেশের অনন্য অবস্থানের পেছনেও তাদের প্রধান ভূমিকা রয়েছে। সেখানে তারা কাজগুলো করেন। যেকোনো দেশের প্রাণীসম্পদের উন্নয়ন ও খাতটির উজ্জ্বল ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে তাদের গুরুত্ব কেউ বাদ দিতে পারবেন না। অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হবে ভালোভাবে।
প্রতিটি ভেটেরিনারি বিভাগের ছাত্র, ছাত্রীকে লেখাপড়া শেষে পেশাজীবন শুরু করতে হলে সনদপত্র অর্জন করতে হয়। বাংলাদেশে এখন ছয় হাজারের বেশি ভেটেরিনারিয়ান বা পশুচিকিৎসক নিবন্ধনের মাধ্যমে পেশাজীবনে আছেন। সবার শিক্ষাজীবনের শুরুটি হয়েছিল ১৯৬১ সালে। তখন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভেটেরিনারি বা পশুচিকিৎসা বিভাগটি চালু হয়েছে। এরপর ধীরে, ধীরে বিভাগ বড় হয়েছে এবং অনুষদে রূপ লাভ করেছে। প্রয়োজন ও চাহিদার প্রেক্ষিতে আস্তে, আস্তে মোট ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পশুপালন বিভাগ চালু হয়েছে। সেগুলোর যেগুলো কৃষি শিক্ষা প্রদান করে, সেখানে আলাদা অনুষদ তৈরি করা হয়েছে। চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়। নাম, ‘চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস ইউনিভার্সিটি’। এই খাতের পূর্ণাঙ্গ ও একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এখন উপাচার্য অধ্যাপক ড. গৌতম বুদ্ধ দাশ ‘ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিমেল সায়েন্স এডুকেশন’-এ অনন্য অবদানের জন্য ‘একুশে পদক ২০২২’ লাভ করেছেন। পুরো দেশের ভেটেরিনারি ছাত্র, ছাত্রী ও শিক্ষকদের জন্য এ অনন্য অর্জন।
কলেজ হিসেবে ভেটেরিনারি আলাদাভাবে পড়ানো হয় ঝিনাইদহ সরকারী ভেটেরিনারি কলেজে। সিরাজগঞ্জে সরকারীভাবে একটি ভেটেরিনারি কলেজের নির্মাণ কদিন আগে শেষ হয়েছে। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে তারা ছাত্র, ছাত্রী ভর্তি শুরু করবেন। অনুষদ হিসেবে আছে খুব ভালোভাবে কৃষি শিক্ষার উচ্চতম প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকার শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে, এটি আছে গাজীপুরের সালনাতে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে আছে-দিনাজপুরের হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আলাদাভাবে কৃষি ও সংশ্লিষ্ট খাতগুলোর ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।
সরকারী সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একমাত্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে পশুপালন ও চিকিৎসা বিভাগটি। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়নকমী, চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যতম দিকপাল, গণ বিশ্ববিদ্যালয় ও গণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি এবং প্রাণপুরুষ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তার বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগটি চালু করেছেন। এখন সেটি অনুষদে উন্নয়ন করেছেন তারা।
দিনে, দিনে বাংলাদেশে পশুপালন, পশুচিকিৎসা, খাত সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পশুপাখির চিকিৎসা প্রদান এবং উন্নয়ন শিক্ষার গুরুত্ব বেড়ে চলেছে। ফলে আগের দিনের পশুচিকিৎসকদের আশাপ্রদ ও সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার গড়ে উঠছে। যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগটিতে পড়ে যেতে হয় মোট পাঁচটি বছর। অন্য সব বিভাগগুলোর মতোই। এই বিষয়টিকে আমরা সাধারণভাবে বলি ‘ডিভিএম’ বা ‘ডিপাটমেন্ট অব ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স’। ছয় মাস থেকে এক বছরের ইন্টার্নশিপ করতে হয় সব ছাত্র, ছাত্রীকে। পড়ার বিষয়ের মধ্যে থাকে অ্যানাটমি (পশুর অঙ্গ ব্যবচ্ছেদ বিদ্যা), হিস্ট্রোলজি (জীবদেহের তন্তু বিন্যাস বিদ্যা), বায়ো-কেমিস্ট্রি (প্রাণ রসায়ন), অ্যানিমেল সায়েন্সের অন্য বিষয়গুলো সেমিস্টার ধরে পড়তে হয়। তাতে থাকে ডেইরি সায়েন্স, পোলেট্রি সায়েন্সের অনেক কোর্স। আছে প্যাথলজি, ফিজিওলজি, ফামাকোলজি, প্যারাসাইটোলজি, মেডিসিন ও সার্জারি’র কোর্স। পশুপালন ও চিকিৎসার এই কোর্সগুলোর গুরুত্ব অসীম।
ভালোভাবে পাশ করে জাতিসংঘ, তাদের এফএও (খাদ্য ও কৃষি সংস্থা), হু (বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা), ইউনেসকো, ইউনিসেফ ও ডিএফআইডিতে খুব ভালো পদে চাকরির সুযোগ আছে। অনেকে করছেন। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে বেতন যেমন অনেক, ভ্রমণের সুবিধাও প্রচুর। নানা ধরণের প্রাণী নিয়ে গবেষণা করে নাম করছেন। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চতর গবেষণা ও শিক্ষা অর্জন করছেন। পিএইচডি লাভ করছেন। বাংলাদেশের ভালো প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআরবি, বারি, প্রাণীসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানে অনেক ভালো চাকরি আছে। আছে গাড়ি, ভালো বেতন ও আবাসনের সুযোগ। প্রতিষ্ঠানগুলোতে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, অফিসার পদে অনেকে চাকরি করেন। বাংলাদেশী ও বিদেশী পশু ওষুধ তৈরি কম্পানিগুলোতে ভালো চাকরি আছে। বিশেষ কোটা আছে বিসিএসের মতো দেশের সবচেয়ে ভালো পেশায়। অন্য ক্যাডারগুলোতেও ভেটেরিনারিয়ানদের প্রতিযোগিতামূলক নিয়োগ লাভের সুযোগ রয়েছে।
আছে বিখ্যাত ও অখ্যাত পোলট্রি, হ্যাচারি এবং ডেইরি ফার্মগুলোতে চাকরি। ব্যাংক, বীমা, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরি লাভ করা সম্ভব। প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে অনেকে ভালো রোজগার করছেন। তারা চাকরির পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসেবায় অনন্য অবদান রাখছেন।
ওএস।