‘দি লতা মঙ্গেশকর অ্যাওয়ার্ড’
কীভাবে তার জীবনের ছবিটি এগিয়েছে? লতা মঙ্গেশকরের বছরওয়ারি উল্লেখযোগ্য
১৯২৯ থেকে ২০২২ : সারাজীবন ধরে সংগ্রামটি করে গিয়েছেন লতা মঙ্গেশকর। একটি মহৎ জীবনের খোঁজে, একটি ভালো ক্যারিয়ার গড়ে তোলার আশায়, কাজ করে গিয়েছেন। সেটি করেছেন তিনি হাসপাতালে জীবনপ্রদীপ বাঁচানোর যুদ্ধেও। নিজেকে একজন যোদ্ধা হিসেবে প্রমাণ করেছেন ভারতের এই সুরসম্রাজ্ঞী। গতকাল রবিবার বিরাট দেশ ভারতের গণমাধ্যমগুলোর প্রতিটির সংবাদ শিরোনাম হলেন-‘লতাজী’। কী তার জীবনের বছরওয়ারি উল্লেখযোগ্য?
২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯২৯ : ভারত ‘কুইন অব মেলোডি’ বা সুমিষ্ট কণ্ঠ স্বরগুলোর রাণীকে পাওয়ার আর্শীবাদে ধন্য হলো। তিনি মাটির পৃথিবীতে এলেন।
১৯৩৫ : বাবা মাঙ্গেশি নামের ভারতের পশ্চিমের প্রদেশ গোয়ার জন্মশহরের নামটি নিজের নামের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন; ফলে হয়েছেন দীননাথ মঙ্গেশকর। তিনিই তাকে মোটে ছয় বছর বয়সে গানের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করলেন। তারও একটি বছর আগে লতা মারাঠি গীতনাট্যগুলোতে অভিনেত্রী হিসেবে কাজ শুরু করেন।
১৯৪১ : মোটে ১২ বছর বয়সে পেশাদার সঙ্গীত জীবনের শুরু করলেন। সে বছরের ১৬ ডিসেম্বর রেডিওর জন্য স্টুডিওতে দুটি গান গেয়েছেন তিনি। ব্রিটিশ রাজের হাত থেকে ভারত স্বাধীনতা লাভের অনেক আগে তিনি তার যাত্রাটি শুরু করেছেন।
১৯৪২ : হৃদযন্ত্রের দুর্বলতায় তার বাবা দীননাথ মঙ্গেশকর মারা যাবার পর মঙ্গেশকরদের কাছের বন্ধু সিনেমা কম্পানি নাভিয়ুগ চিত্রপটের মালিক বিনায়ক দামোদর কার্নাটকি ১৩ বছরের মেয়েটিকে সঠিক পথে গাওয়া ও অভিনয়ের ক্যারিয়ার শুরু করতে সাহায্য করলেন। তার প্রথম ব্রেক বা সুযোগটি এলো কম্পানিটির মারাঠি সিনেমা ‘পাহিলি মানগালা-গাউর’ ছবিতে; তাতে গাইলেন তার প্রথম গান ‘নাটালি চিত্রাটি নভোলাইয়ি’।
১৯৪৩ : প্রথম হিন্দি গান হলো সিনেমাতে-মারাঠি ছবি ‘গজাভাই’; গানটি ছিল হিন্দি ভাষার-‘মাতা এক শপথ কি দুনিয়া বদল দে তু’।
১৯৪৫ : কার্নাটাকি তার নাভিয়ুগ চিত্রপটের সদরদপ্তর মুম্বাইতে নিয়ে আসার পর লতা মঙ্গেশকর এখানে চলে এলেন। বিন্দিবাজার ঘরাণার উস্তাদ আরমান আলী খানের কাছে হিন্দুস্তানী ক্লাসিক্যাল মিউজিক শেখা শুরু করলেন।
১৯৪৬ : ‘পা লাগোন কার জোরি’ তার হিন্দি ভাষার ছবিতে অভিষেক ঘটিয়েছে। বসন্ত জোগলেকারের, ‘আপ কী সেবা ম্যায়’ গানের শিরোনাম।
১৯৪৮ : কার্নাটাকি মারা যাবার পর অভিভাবক হারা হয়ে গেলে এতিম মেয়ে, নব প্রতিভা লতা মঙ্গেশকর। এরপর তাকে শিক্ষক ও পথ প্রদশক হিসেবে আগলে রেখেছেন সঙ্গীত পরিচালক গুলাম হায়দার। শশধর মুখার্জির প্রযোজনা ‘শহীদ’ থেকে তাকে বাতিল করে দেবার পর বলিউডের মূলধারাতে এলেন ‘মজবুর’ ছবিতে ‘দিল মেরা তোদা, মুঝে কাহিন কা না চাহোরা’ গানটি গাইতে পেরে।
১৯৪৯ : ‘আয়েগা আনেওয়ালা’ গানটি সুপারস্টার গায়িকা কিংবদন্তী মধুবালার দেহে প্রচারিত হলো ‘মহল’ ছবিতে। এটিই তার প্রথম সুপারহিট।
১৯৫০ : সিনেমাতে বিরাট সুযোগ দেখতে পেয়ে লতা মঙ্গেশকর চারটি ছবি প্রযোজনা করলেন এই দশকে। মাতৃভাষা মারাঠিতে ‘ভাদল’-১৯৫৩ সালে বেরিয়েছে; আর দুটি ছবি হলো হিন্দিতে, ‘জাঞ্জিগর’-একই বছরে মুক্তি পাওয়া, অন্য আরেকটি, ‘কাঞ্চনগঙ্গা’-১৯৫৫ সালের ছবি।
১৯৬৩ : বছরটি হলো সেই সময় যখন লতা মঙ্গেশকর সঙ্গীত পরিচালক লক্ষ্মীকান্ত-পিয়ারেলালের সঙ্গে জোট বেঁধে কাজ শুরু করলেন। তাদের তৈরি অনেকগুলো গানের চিত্রায়ণে কন্ঠ দিলেন গায়িকা এবং ত্রয়ী দিনে, দিনে শক্ত হয়ে এগুতে লাগলো। তাদের বিখ্যাত ছবিগুলোর মধ্যে আছে, সেগুলো জনপ্রিয় হয়েছে এমন কটি-‘মি, এক্স ইন বম্বে’, ‘মেরে হামদাম মেরে দোস্ত’ ‘ইন্টাকম’, ‘দো রাস্তে’।
১৯৬০-১৯৭০ : এই দশকে সঙ্গীত পরিচালনার চেষ্টা করলেন লতা মঙ্গেশকর। আনন্দ ঘান ছদ্মনামে মারাঠি ‘রাম, রাম পাভানা (১৯৬০)’, ‘মারাঠা টিটুকা মেলভাভা (১৯৬৩)’, ‘মহিথানচি মানজুলা (১৯৬৩)’, ‘শাদী মানসে (১৯৬৫)’ ও ‘টাম্বি মাটি (১৯৬৯)’ ছবিগুলোতে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন তিনি।
১৯৬৫ : মহারাষ্ট্র সরকার তাকে শাদী মানসে’র জন্য সেরা সঙ্গীত পরিচালক অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে। ‘এরানিচা দেবা টুলা’ গানটি সেরা গানের স্বীকৃতি জিতে নেয়।
১৯৬৯ : লতা ভারতের তৃতীয় সবচেয়ে বড় বেসামরিক সম্মান ‘পদ্মভূষণ’ লাভ করলেন, দেশের মানুষকে বছরের পর বছর আনন্দদানের অবদানে।
১৯৭৪ : এই আন্তজাতিক সম্মান লাভ করলেন তিনি-প্রথম ভারতীয় হিসেবে লন্ডনের রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে পারফরমেন্স করেছেন।
১৯৭৪ : মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি গান রেকর্ড করা শিল্পী হিসেবে নামটি উঠলো গিনেজ বুক অব ওয়াল্ড রেকর্ডসে। সেখানে লেখা ছিল তার নাম ও ছবির পাশে, ‘২৫ হাজারের কম নয় একক, দ্বৈত ও কোরাস গান রেকড করেছেন, ২০টি ভারতীয় ভাষায় লতা মঙ্গেশকর।’ আরেকজন বিশ্বখ্যাত ভারতীয় শিল্পী মোহাম্মেদ রাফি আপত্তি করলেন জানিয়ে, তিনি প্রায় ২৮ হাজার গান রেকর্ড করেছেন। তবে গানের এই রত্মদের কেউ রয়ালিটি বা গান বিক্রির টাকার স্বত্ব নিয়ে অসুবিধা ও যন্ত্রণা ভোগার পর উপযুক্ত অঙ্গীকারপত্র দেখাতে পারলেন না। গিনেজ তাদের দুজনের নামই দিয়েছে। এই তথ্যটি কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই ১৯৯১ সালে বাতিল করেছে গিনেজ বুক অব ওয়াল্ড রেকডর্স।
১৯৬০-১৯৭০ : লতা মঙ্গেশকর লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলালের সাধারণ কন্ঠস্বরে পরিণত হলেন। তেমনটিই থাকলেন তিনি এই দশকে রাহুল দেব বর্মণের সঙ্গীত পরিচালনাগুলোতে। একত্রে কাজ করেছেন চিরতরুণ গায়ক কিশোর কুমার, মহান শিল্পী মান্না দে, আরো ছিলেন মুকেশ, মোহাম্মেদ রাফি, আশা ও উষা নামের তার ভুবনজয়ী দুই বোনের সঙ্গে; হেমন্ত কুমার-বাঙলি আরেক সঙ্গীত কিংবদন্তীসহ অন্যদের কন্ঠসঙ্গীতে।
১৯৮৯ : এ বছর তাকে ভারতের সিনেমা ভুবনের সবচেয়ে বড় ও সম্মানিত পদক ‘দাদা সাহেব ফালকে’ দেওয়া হলো। ন্যাশনাল ফিল্মস অ্যাওয়াডস অ্যাকাডেমি তাকে এই ভুবনের সবচেয়ে বড় বেসামরিক পদকটি প্রদান করেছে।
১৯৯৭ : লতা মঙ্গেশকরের জন্মভূমি মহারাষ্ট্র প্রদেশের প্রাদেশিক সরকার তাদের সবচেয়ে বড় বেসামরিক পদক ‘মহারাষ্ট্র ভূষণ অ্যাওয়ার্ড’ দিলো কোকিলকন্ঠীকে।
১৯৯৯ : তিনি নিজের ‘পদ্ম বিভূষণ’ জয় করে নিলেন। এটি ভারতের সবচেয়ে বড় দ্বিতীয় বেসামরিক পদক। প্রদানের সময় ভারত সরকার লিখলো-“ব্যতিক্রমী ও বিশিষ্ট সেবা’-জাতিকে দেওয়ার জন্য”।
১৯৮৪ ও ১৯৯২ : মধ্য প্রদেশ সরকার ও মহারাষ্ট্র লতা মঙ্গেশকরের সম্মানে তার উত্তরাধিকারীদের ‘দি লতা মঙ্গেশকর অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান প্রবর্তন করলো।
২০০১ : ভারতের সবচেয়ে বড় পদক ‘ভারতরত্ন’ গ্রহণ করেছেন তিনি। সিনেমা ও গানে অবদানের অনন্য স্বীকৃতির চূড়ান্তটি পেলেন।
২০০৯ : ফ্রান্সের সবচেয়ে বড় বেসামরিক পদক ‘দি টাইটেল অব অফিসার অব দি ফ্রেঞ্চ লিজিওন অব অনোর’-এ সম্মানিত হলেন।
২০১২ : মিউজিক লেবেল কম্পানি বা সঙ্গীত অ্যালবামের প্রতিষ্ঠান এল এম মিউজিক ধ্বংস হয়ে আবার জীবনে ফিরে এলো বোন উষার সঙ্গে যৌথ অ্যালবাম ‘ভাইজানস’র মাধ্যমে।
২০১৫ : জীবনের শেষ হিন্দি ছবিটিতে গাইলেন লতা মঙ্গেশকর। ছবির নাম-‘ধুনো ওয়াই২...লাইফ ইজ অ্যা মোমেন্ট’। গানটি হলো ‘জেনা হায় কেয়া’। গানটি নিজের স্টুডিওতে রেকর্ড করলেন তিনি।
২০২২ : ৬ ফেব্রুয়ারি, রোববার ভারত সরকার দুইদিনের দেশজুড়ে শোকপালনের কর্মসূচি ও শ্রদ্ধা নিবেদন ঘোষণা করলো ‘ত্রেরঙ্গা’ জাতীয় পতাকাটিকে অধনমিত রেখে। কেননা ভারত তার ‘নাইটিংগেল লতা মঙ্গেশকর’কে হারিয়েছে।
(ইকনোমিক টাইমস অবলম্বনে)