ভিজয় বার্সে ফুটবলে বস্তির শিশুদের বদলে দিচ্ছেন
নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বিখ্যাত ক্রীড়া শিক্ষক। বস্তির শিশুদের ফুটবলের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করলেন। ২১ বছরে তিনি তাদের জন্য সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে কয়েক একর জমি কিনেছেন, ফুটবল অ্যাকাডেমি করেছেন। ওদের নিয়ে গিয়েছেন গৃহহীনদের ফুটবল বিশ্বকাপে। গল্পের চেয়েও ভিজয় বার্সের জীবনের কাহিনী। লিখেছেন ওমর শাহেদ
তিনি একজন আজীবনের শিক্ষাবিদ। তবে তার শিক্ষা-উপকরণ বই-খাতা নয়-‘ফুটবল’। এই শিক্ষাভাবনা থেকে তার প্রাণ একটি জীবন লক্ষ্যের দিকেই এগিয়েছে-‘প্রতিটি শিশুরই একটি খেলা খেলার অধিকার আছে।’ নামটি তার ভিজয় বার্সে। ফুটবলের মাধ্যমে ২১টি বছর ধরে ভারতের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জীবনগুলোকে ওপরে তুলে দিতে অবদান রেখে চলেছেন। তাদের জন্য তার একটি প্রতিষ্ঠান আছে। বাংলায় ‘বস্তির ফুটবল’; ইংরেজিতে, ‘স্লাম সকার’। এ নামেই ডাকেন তারা। সেখানে এখন কয়েকজন কোচ আছেন। তারা একেবারে কম রোজগার করতে পারা পরিবারগুলোর শিশুদের ফুটবল খেলা শিখিয়ে চলেছেন তিনি। তাদের সারাবিশ্বে পাঠাচ্ছেন ফুটবলের প্রতিযোগিতাগুলোতে অংশ নিতে।
কীভাবে ভিজয়ের শুরু? একটি খেলার মধ্যে তার বস্তির ফুটবলার শিশু ছাত্রদের সঙ্গে ফুটবলে পদাঘাত শুরু করতে, করতে মনে করলেন তিনি-‘এই সবকিছুর শুরু ২০০১ সালের জুলাইতে, একটি বৃষ্টিময় দিনে। সেদিন প্রবল বৃষ্টিতে আমি একটি বড় গাছের নিচে আশ্রয় নিয়েছি। হঠাৎ দেখি, একদল শিশু, বস্তিতে থাকে; গায়ের জামা-কাপড়ই বলে দিচ্ছে। ওরা একটি ভাঙা প্লাস্টিকের বালতিকে ফুটবল বানিয়েছে, বৃষ্টির মধ্যে তুমুল আগ্রহে খেলছে। উদ্দীপ্ত ও উদ্যমী খেলোয়াড়দের গোলকটি কীভাবে যেকোনো অন্ধকার কূপ থেকে পাকাপাকিভাবে দূরে রাখতে পারে-সেই দৃশ্যগুলো দেখে, তাদের মুহূর্তগুলো উপভোগ করে স্পষ্টভাবে বিষয়টি আমি অনুভব করলাম।’
এই ঘটনার পর থেকে কাজে নামলেন ভিজয়। নিজের মতো করে তিনি তাদের বদলে দেবেন। ফলে কাজ শুরু করলেন বস্তি ও পথশিশুদের জন্য, তাদের নিয়ে। তারপর থেকে প্রতিদিন তাদের পাশের একটি খেলার মাঠে খেলতে ডেকে নিয়ে যেতেন। বলেছেন, ‘আমি দেখেছি ও উপলব্ধি করেছি, ফুটবল খেলার প্রতি ভালোবাসা কীভাবে তাদের ভালো কাজে উদ্দীপ্ত করেছে।’ পরে স্ত্রী অধ্যাপক রচনা বার্সেকে নিয়ে তিনি ক্রীড়া বিকাশ সংস্থা নাগপুর (কেএসভিএন) প্রতিষ্ঠা করলেন। সঙ্গে ছিলেন তাদের ছোট ছেলে ডা. অভিজিৎ বার্সে।
কেন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন বস্তির ছেলেমেয়েদের জন্য তিনি? প্রথম উত্তর হলো, অধ্যাপক ভিজয় বার্সে নিজে একজন নামকরা ক্রীড়া শিক্ষক। খেলার কী শক্তি তা তার বিলক্ষণ জানা। নাগপুরের ১৩৯ বছরের পুরোনো হিলসপ কলেজের তিনি ক্রীড়া অধ্যাপক ছিলেন। কলেজটি মিশনারিদের, স্কটিশ পাদ্রী স্টিফেন হিলসপের নামে গড়া। এখানে পড়িয়েছেন টানা ৩৬টি বছর। দ্বিতীয় কারণ হলো তিনি নিজেও একটি সুবিধাবঞ্চিত ঘরের ছেলে। হিন্দু পরিবারে জন্মালেও বাবা-মা ও ভাই- বোনদের সম্পর্কে কখনোই বেশি কিছু বলেননি। তৃতীয় কারণটি হলো শিশুদের প্রতি তার অফুরান ভালোবাসা।
তার জন্ম ১৯৪৫ সালে। নাগপুরের ছেলে। শহরটি মহারাষ্ট্র প্রদেশের তৃতীয় বড় ও শীতকালীন রাজধানী। মারাঠিদের কল্যাণে ইতিহাসে ভুবন বিখ্যাত। এখানেই বম্বে বা মুম্বাই-ভারতের সিনেমা সিটি। স্ত্রী রচনা বার্সেকে নিয়ে গড়া তার ফুটবল প্রতিষ্ঠান, ভিজয়ের স্বপ্নের কেএসভিএনে নানা ধরণের ফুটবল প্রশিক্ষণ কমসূচি পরিচালনা করা শুরু হলো।
বিশ্ববিদ্যালয় কলেজটি থেকে অবসরের সময় তিনি ভারতের টাকায় ১৮ লাখ টাকা সারাজীবনের শ্রমদানের বিনিময়ে পেলেন। সেগুলো দিয়ে মহৎ মানুষটি কয়েক একরের একটি খালি জমি কিনলেন, নাগপুর শহর থেকে নয় কিলোমিটার দূরে। ২০০১ সালে স্ত্রী রচনা ও ছেলে অভিজিৎকে নিয়ে যে ক্রীড়া বিকাশ কেন্দ্রের শুরু করেছিলেন নাগপুরে তিনি, সেটিই পরিণত হলো স্লাম সকারের পৈত্রিক প্রতিষ্ঠানে। স্ত্রী ও ছোট ছেলেকে নিয়ে কাজে নেমে পড়লেন। তাদের বড় ছেলে প্রিয়েশ বার্সেও সাহায্য করেছেন অনেক। ধীরে, ধীরে অনেক শ্রমের বিনিময়ে তার শিশু খেলোয়াড়দের জন্য একে গড়ে তুলেছেন স্লাম সকারে। সেখানে তিনি সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য তার সেই স্বপ্নের ফুটবল অ্যাকাডেমি শুরু করলেন।
নিজের খেলোয়াড় তৈরির কাজটিকে ভিজয় বার্সে মহারাষ্ট্রের অন্য জেলাগুলোতে ছড়িয়ে দেওয়া শুরু করলেন। কয়েকজন প্রিয় বন্ধুর সাহায্য নিয়ে ম্যাচগুলো আয়োজনের পরিকল্পনা করতে লাগলেন তিনি। তিনি প্রথম টুনামেন্টটি নাগপুরে ২০০৩ সালে রাজ্যজুড়ে আয়োজন করা হয়েছিল। তাদের এই প্রথম টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছে ১২৮টি ফুটবল দল। ভিজয় বার্সের আয়োজন করা প্রথম ফুটবল প্রতিযোগিতাটির নাম-‘জোপাধপতি ফুটবল টুর্নামেন্ট’। তাতে পুরো রাজ্যের ওদের বয়সীদের দলগুলো অংশ নিয়েছে। আসরটি বসেছিল নাগপুরে। মহারাষ্ট্র প্রদেশের ১৫টি জেলা থেকেই খেলোয়াড়দের দলগুলো এসেছিল। এমনকী একটি আদিবাসী গোষ্ঠী-গাডচিরোলি; তারা এই নামের জেলাটি (এখন একটি শহরে)’র মানুষ। বনের জন্য বিখ্যাত গাডচিরোলি। তারাও অংশ নিয়েছে বলে খুব খুশি ভিজয়। পরে এই দলটি চ্যাম্পিয়ন হয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছে। এভাবেই কেবল খেলোয়াড় তৈরি নয়, তাদের খেলার ব্যবস্থা করতে প্রতিযোগিতাগুলোর আয়োজন শুরু করলেন ভিজয়। কাদের জন্য তার এই শ্রম? উত্তরে বলেছেন, ‘আমার লক্ষ্য বিশেষত বস্তির শিশুদের জন্য, তাদের স্বার্থ পূরণ।’
একই বছর ‘অল ইন্ডিয়া রাজীব গান্ধী মেমোরিয়াল জোপাধপতি ফুটবল টুনামেন্ট’ আয়োজন করেছেন তিনি সর্বভারতীয় পযায়ে। নাগপুরেই সেটি হয়েছে। ভারতের ১২টি রাজ্য অংশ নিয়েছে। জিতেছে ওড়িষ্যা রাজ্য, তাদের মহারাষ্ট্র রানারস-আপ হয়েছে। এছাড়াও তার স্লাম সকার অ্যাকাডেমিতে সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণীর মানুষদের মাদকাসক্তি পুর্ণবাসন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এভাবেও ভালো পথে নিয়ে আসছেন তিনি বস্তির মানুষদের, তাদের চিকিৎসা দিয়ে চলেছেন।
ওই যে শিশুরা বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলছিল, তাদের স্বপ্ন পূরণের জন্য আরো অনেক দূর এগিয়েছেন ভিজয় বার্সে ধীরে, ধীরে; অনেক কষ্টে। ভারতের জাতীয় দলে যেন তাদের খেলার অধিকার ও সুযোগ লাভ হয়, সেজন্যও তার অ্যাকাডেমি কাজ করে চলেছে। ইন্টারনেটের ওয়েবসাইট থেকে ভিজয় জেনেছিলেন, বছরওয়ারি একটি গৃহহীনদের ফুটবল ওয়াল্র্ড কাপের আয়োজন করা হয়।
২০০৬ সালে বস্তির শিশুদের ফুটবলের ত্রাতা ভিজয় ‘হোমলেস ওয়াল্র্ড কাপ’-এ গেলেন। গৃহহীনদের ফুটবল বিশ্বকাপের চতুথ পর্বটি দেখতে সেবার দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনে যেতে পেরেছেন তিনি। পরের বছর তার সুবাদে ভারত পঞ্চম আসরে পৌছাতে পারলো। এই আসরটি বসেছে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে। ২০০৮ সালের অষ্ট্রেলিয়ার রাজধানী মেলবোর্নের ইভেন্টেও তার দেশকে নিয়ে গিয়েছেন। তার বস্তির শিশু ফুটবলারদের মধ্যে অখিলেশ পাল নামের একটি ছেলে ভারতের গৃহহীনদের জাতীয় ফুটবল দলে খেলার বিরল যোগ্যতা অর্জন করেছে। তিনি পরে ভারতের ফুটবল দলটির অধিনায়ক নির্বাচিত হয়েছেন। তাদের দলটি ব্রাজিলে বস্তিবাসীদের ফুটবল বিশ্বকাপ খেলতেও গিয়েছে।
স্লাম সকারে ভিজয় বার্সের সঙ্গে ছোট ছেলে ডা. অভিজিৎ বার্সে পুরোপুরিভাবে আছেন। ডা. অভিজিৎ প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহি কমকতা। সেই সমস্যাগুলো পূরণে তারা কাজ করছেন, সেই লক্ষ্যাদিতে চলেছেন, যেগুলোতে তাদের অনমনীয় পরিশ্রম, অবিরাম চেষ্টাগুলো আছে; যেগুলোর মাধ্যমে ভারতের ও বিশ্বের সামাজিক নিয়মাবলীগুলো তারা বদলে চলেছেন; লিঙ্গগত বৈষম্যগুলোর মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করছেন। ডা. অভিজিৎ বার্সে বাবার মতো এখন একজন সমাজকমী। তবে তিনি একজন উদ্যোক্তা। ২০০৬ সালে তার এই ছেলে চলে এলেন পাকাপাকিভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। তারও জীবনের লক্ষ্য-বস্তির ছেলেমেয়েদের সমাজে সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে আসা। পুর্ণবাসন করা বস্তিবাসীদের, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের রোজগারের পথ করে দেওয়া। ২০০৭ সালে বছর তাকে স্লাম সকারের সিইও পদটি প্রদান করা হয়েছে।
২০১৪ সালে ‘সত্যমেভ জয়তে’ নামের টিভি সিরিজানুষ্ঠানের সেশন ৩’র প্রথম এপিসোডে বলিউডের সুপার স্টার আমির খানের উপস্থাপনায় তাদের জীবনের গল্প বলতে আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে গিয়েছিলেন ডা. অভিজিৎ বার্সে। তাতে জানিয়েছেন, বস্তির শিশুদের ফুটবল খেলা শেখানো ও ফুটবলের মাধ্যমে জীবনগুলো বদলে দেওয়ার কাজ ছাড়াও তার বাবা ভিজয় বার্সে ভারত-পাকিস্তান শান্তির জন্য কাজ করছেন। তিনি শান্তির জন্য আলোচনা শুরু করতে সহযাত্রীদের নিয়ে পাকিস্তান সীমান্তে একটি মোটর সাইকেল অভিযান পরিচালনা করেছেন।
ভিজয় বার্সে ভারতের স্লাম সকারের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে খুব খ্যাতিমান। বস্তির ছেলেমেয়েদের ফুটবল খেলার সুযোগ দিয়ে জীবনমান বদলে দেওয়ার কারণে সারা দুনিয়াতে নাম করেছেন। বিখ্যাত এই সমাজকর্মী ও বস্তির শিশুদের কোচ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন-‘দুটি ঘন্টা ফুটবল নিয়ে কাটানো সময়গুলো তাদের উদ্দীপ্ত ও শিক্ষিত করে তোলে। যেকোনো ধরণের খারাপ কাজ; যেগুলো করার হরদম সুযোগ আছে-পকেট মারা, নানা ধরণের মাদক সেবন; অন্যান্য অপরাধ ও সমস্যা তৈরির হাত থেকে বস্তির শিশুদের দূরে রাখে। তাদের মাধ্যমে ভালো হয় আরো অনেকেই।’
তার খেলার এই জীবন দিকে, দিকে ছড়িয়েছে। বম্বের সুপারস্টার আমির খান ‘সত্যমেভা জয়তে’ অনুষ্ঠানে জেনেছেন। ভিজয় বার্সের স্লাম সকার কয়েকটি খুব ভালো পুরস্কার জিতেছে। একটি হলো-‘ফিফা ডাইভারসিটি অ্যাওয়ার্ড’। ‘এফআইসিসিআই ইন্ডিয়া স্পোটস অ্যাওয়ার্ড’ এবং ২০১২ সালের ‘মন্থন ই-এনজিও অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেছেন ভিজয় বার্সে ও স্লাম সকার।
স্বপ্নজয়ী এই মানুষটিকে সম্মানিত করেছে ভারতের সবচেয়ে বড় গ্রুপ ধীরুভাই আম্বানীর রিলায়েন্স, ২০১২ সালে। ভারতীয় ক্রিকেটের মহাতারকা শচীন টেন্ডুলকার সেদিন তার হাতে তুলে দিয়েছেন ‘রিলায়েন্স রিয়েল হিরো অ্যাওয়ার্ড’। ২০১৯ সালে তিনি লাভ করেছেন ‘নাগভূষণ অ্যাওয়ার্ড’। ভারতের সিনেমা ভুবনের মহাতারকা অমিতাভ বচ্চন তার চরিত্রে অভিনয় করতে নেমেছেন। ২০২০ সালে মুক্তি দেওয়ার কথা ছিল-‘জুন্ধ’। অমিতাভের চরিত্রটির নামও ভিজয় বার্সে।
এখন তার বয়স হয়েছে অনেক-৭৫ বছর। তারপরও তিনি থেমে যাননি। তার প্রতিষ্ঠানটি রাজ্য ও জাতীয় পযায়ের টুর্নামেন্টগুলোর আয়োজন ও পরিচালনা করে। ভিজয় বার্সের স্লোম সকারও এখন অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। তাদের প্রধান ছোট্ট ফুটবলারদের কোচ ও জীবন বদলের প্রধান কারিগর অনেক লম্বা; যেকোনো ভালো ফুটবলারের মতোই দশাসই। ৫ ফিট ১০ ইঞ্চি। এখনো শরীরের শক্ত বাঁধন অটুট আছে পরিশ্রম ও কোনো কিছুই না পাওয়া শিশুদের জন্য ভালোবাসার জোরে। চুলের রঙ কালো; চোখের মণির রঙ গাঢ় কালো।
(ইংরেজি থেকে অনুবাদ)