৫৬ ফিট লম্বা রোবট ডায়নোসর আগুন ছড়াতে পারে!
ট্রাডিনো নামের নকল ডায়নোসরের গল্প চমকে দেবে আপনাকে নিশ্চিত!
রোবট নিয়ে কত মাতামাতি, কাজ হচ্ছে সারা দুনিয়াতে। আমাদের দেশেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রোবট বানানো এবং তাদের দিয়ে নানা কাজের চেষ্টার কোনো বিরাম নেই। তবে সবাইকে হারিয়ে দিয়েছে একটি বিরাট দানব। আসল ডায়নোসর মানুষ দেখেনি কিন্তু একে দেখলে ভয়ে পালিয়ে যাবেন অতি বড় সাহসীও। কেননা ও মুখ দিয়ে আগুন ছুঁড়তে পারে। নতুন একটি বিশ্বরেকর্ড গড়েছে এই রোবট ডায়নোসর। ২০১৪ সালে সেই যে গিনেজ বুক অব ওয়াল্ড রেকর্ডসে নাম লেখাল নিজের; ট্রাডিনো তারপর থেকে আজও আছে-আট, আটটি বছর হয়ে গেল। কীভাবে হারাবেন তাকে?
সাড়ে ৫৬ ফিট লম্বা, ২৭ ফিট উঁচু, ডানা জোড়া ৪০ ফিট আর নিজের ওজন হলো ১১ টন। হাঁটতে পারে পুরোদমে, পা আছে চার, চারটি। দেখতেও অতিকায় ডায়নোসরের মতোই। ফলে রোবট ভাবলে ভুল হবে। আকাশে উড়ে বেড়ানো প্রাচীন বিশ্বের রাজাদের মতো তারও আছে ওই ডানা জোড়া। সেই তুলনায় ছোট্ট কিন্তু আমাদের খুব ভয় পাইয়ে দেবার মতো। বেশ বড় মাথা আছে তার। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো, মাথাটি দিয়ে আগুন ছুঁড়ে মারতে পারে অতিকায় এই ডায়নোসর। এবার সত্যিই কী চমকে গেলেন?
নাম তার ‘ট্রাডিনো’; ওকে বানিয়েছে চয়না ইলেকটোনিক এজেন্সি-এটি একটি জামান প্রতিষ্ঠান। শব্দটি কিন্তু জামার্ন। ট্রাডিনোর দাম খুব বেশি নয়; ১ লাখ ডলারও ছাড়াবে না। বানানো হয়েছিল তাকে অনেক যত্নে জার্মানির ঐতিহ্যবাহী হাসি-তামাসার উৎসব ‘ড্রাকেনস্ট্রেচ’র জন্য। উৎসবটি এখন আরো অনেক আধুনিক, নানা রকমফের বেরিয়েছে। ড্রাগনকে মেরে ফেলার এই উৎসবটির খবর আছে ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বরে অনলাইনেও। তাতে বরাবরের মতো গিয়েছে ট্রাডিনো। যাকে বানানো হয়েছে একটি অতি কাল্পনিক কাহিনী থেকে।
একটি কল্পনার শহরে আছে একটি অলীক রানী। নাম তার ডেনারেস টারগেরিয়েন। সে উদ্ভট মহাকাব্যিক উপন্যাস সিরিজ-অ্যা সং অব আইস অ্যান্ড ফায়ার’র অন্যতম চরিত্র। মার্কিন ঔপন্যাসিক ও চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার জর্জ আর আর মার্টিনের লেখা। মানুষের কল্পনার এই কাহিনীটিকে নিয়ে, লোককাহিনীটিকে তিনি প্রথম লেখা শুরু করেন ১৯৯১ সালে। সিনেমার নামটি শুনলেই তো চিনে ফেলবেন-‘অ্যা গেইম অব থন’। ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চরিত্রটি এইচবিওর টিভি সিরিজে প্রথম করেছেন এমিলিয়া ক্লার্ক। তিনি এসেছেন বিবিসি ওয়ানের মেডিক্যাল সোপ অপেরা ডক্টরসের মাধ্যমে ২০০৯ সালে। ডেনারেস টারগেরিয়েন চরিত্রটি তাকে কয়েকটি আন্তজাতিক পদকে ভূষিত করে। অ্যামি অ্যাওয়াডের জন্যও মনোনীত হয়েছিলেন। এরপর বিয়ার অব থর্নস-এ করেছেন কেটি উইলসন। 'দি রিয়েল হাউজওয়াভস অব ওয়েষ্টেরোস'-এ ছিলেন লিসা মেরি সামারস্কেলস। আগে বিশ্বজুড়ে খেলা গেমও।
ডেনারেস টারগেরিয়েন থেকে বানানো ট্রাডিনো হলো হাঁটতে পারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় রোবট। ট্রাডিনো নামের প্রকল্পটিতে সে যা দাবী করে, তাই অর্জন করেছে। যন্ত্রচালিত সে-যন্ত্রের মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তাকে। ভয় কাটানোর একমাত্র উপায় হলো রিমোট কনট্রোল। সেটি দিয়ে তার আগুন বের হয় মুখ থেকে, চলাফেরা করতে পারে সে-সবই ঘটে ওর।
মেকানিক্স ও ইলেট্রনিক্সে তৈরি। জলহস্তির চেয়েও বিরাট এই সরীসৃপ তবে শিশু আসল ডায়নোসরের বিচারে। তৈরি করেছেন তারা বিনোদন ব্যবসার উদ্দেশ্যে। জার্মান ট্রাডিনো নামটিতেও একই সঙ্গে ঐতিহ্য ও উদ্ভাবন মিশে আছে। এই ট্রাডিনো ডানা জোড়া দিয়েও আঘাত করতে পারে। ট্রাডিনোকে বানানোর উদ্দেশ্য ছিল একটিই-জার্মানির সবচেয়ে পুরোনো লোকশিল্প উৎসবের ড্রাকেসস্ট্রেচ গ্রামে পুরোনো বয়সী ড্রাগনের তাকে বসানো হবে। উৎসবের মতোই গ্রামের নাম এক।
জার্মানির সীমান্তের বাভারিয়ান শহর ফাথ ইম ওআন্ড-এ আছে এই গ্রাম। প্রতি বছর আগস্টে হয় ট্রাডিনোর আয়োজন। তার গায়ের খোসাটি বানানো হয়েছে পলিইউরেথেইনে। প্লাস্টিকের একটি উপকরণ। খোসাটির ভেতরে আছে ৯শ ৮৪টি হাইড্রোলিক গিয়ার ((জলের মাধ্যমে কাজ করে), শখানেক মিটার করে লম্বা পাইপলাইন, কয়েক হাজার মিটার তারের সারি। আরো যুক্ত হয়েছে ২শ ৩৮টি সেন্সর। এগুলো তার চারপাশের পরিবেশকে নির্ধারণ করে দেয় নিজের ও অন্যদের কাছে। ৬৫টি কাঠের টুকরো আছে ভেতরে। ২শ ৭২টি হাইড্রোলিক বাতি বা জল পরিবহন করে জ্বলে থাকা বাতি আছে। অনেক খেটে বানানো, দারুণ এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি দানবটিকে শিল্পীর আঁচড়ে একটি ছোট্ট শিশুর খেলনার ডায়নোসরের চেহারা দিতে পেরেছেন তারা।
আসল ডায়নোসরের অনেক গুণও তার আছে। সে হাঁটতে তো পারেই, নাড়াচাড়া করতে পারে, পেছন ফিরেও তাকাতে সক্ষম। নিজের ডানাগুলো ঝাপটাতে পারে। বিরাট মাথা নাড়তে পারে। চোখের পাতা পিটপিট করতে পারে। শিশুদের ডায়নোসরগুলোর চেয়ে অনেক, অনেক গুণ বড় ও। এমনকি ওদের সবার চেয়েও লম্বা, চওড়া; দানবীয়। একমাত্র দুঃখ হলো ট্রাডিনোর যে, সে আগের কালের জাতভাইদের মতো উড়তে পারে না। তবে শত, শত বছরের পুরোনো ‘ফাথ ইম ওআন্ড’ আগে একটিই গ্রাম ছিল। এই গ্রামের ৫শ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী উৎসবটিতে খেলা দেখানোর আরামের কাজটিই এখন নিয়েছে নকল কিন্তু আসল ডায়নোসর ট্রাডিনো। তাতে অন্যগুলোকে হারিয়ে দেওয়া বা না দেওয়ার কাজ তার; মানুষকে বিনোদন দেওয়াই প্রধান উদ্দেশ্য।
এই লোকশিল্প মেলার আগের ড্রাগনটি এমন একটি যান্ত্রিক মডেলে বানানো যেটি ৩৫ বছরে তেমন বদলানো হয়নি। তার ভেতরে চারজন অপরারেট বসে কাজ করতেন। ফলে কোনো রোবোটিক বিষয় তার ভেতরে ছিল না।
ট্রাডিনো নামের রোবট ডায়নোসরের চারটি পায়ের প্রতিটি ৭ ডিগ্রি পযন্ত ঘুরতে পারে।
রিমোট কন্ট্রোলে চালাতে হয়-এমন কোনো রোবটের কথা আগে শোনা যায়নি বলে প্রতিষ্ঠানটির পণ্য উন্নয়ন ও নকশাবিদরা আগ্রহী হয়েছেন। একে চালাতে হয় একটি ২ লিটারের টাবো ডিজেল ইঞ্জিনে বা ২৪০ হর্স পাওয়ারে।
এই প্রকল্পের শুরু হয়েছে ২০০৭ সালে। গবেষণার ক্ষেত্রে কাজ করেছেন ১৫ জন। প্রথমে গবেষণা করে এর নকশা ও ভেতরের সব তৈরি করা হলো। এরপর তাকে বানানো শুরু হলো। এতে আলাদা নয়টি কন্ট্রোলার আছে। প্রতিটিকে দুটি করে আইটি বা ইলেকট্রনিক প্রসেসর আছে। আছে একটি ফুজিৎসু মাইক্রোকন্ট্রোলার।
জামানির ওই গ্রামে এই খেলাটি অন্যতম হিসেবে ৫শ বছর ধরে বসে। খেলাটি হলো একটি সুপ্রাচীন নাটক। তাতে শহরের নাইটরা পাশের শহরে জাহাজে যাত্রা করেছেন রাজদ্রৈাহীদের হারাতে; তখন তাদের শহরে হানা দিয়েছে একটি ড্রাগন। ‘ড্রাগনটির প্রতি বর্শা’ নামের এই বার্ষিক লোক উৎসবটিতে রোবটের ড্রাগন ট্রাডিনো আনন্দের একটি নতুন মাত্রা হাজির করেছে ও পুরোনো ঐতিহ্যবাহী খেলাটিতে আরো অনেক মজা এনেছে। উৎসবে যোগ দিতে হয় টিকিটের বিনিময়ে।