বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে, তোমার স্বপ্নের, স্বাধীন বাংলায়
আবার ফিরে গেলাম সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে; ৯০ তে এসে তিনি ফিরিয়ে দিলেন ‘পদ্মশ্রী’। তাকে নিয়ে লিখেছেন ওমর শাহেদ
৯০ বছরের সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। বাঙালি কুলীন ব্রাক্ষ্মণ, ‘মুখার্জি’ নামে এই পদবীধারীদের ডাকা হয়। বিশ্বখ্যাত এই গায়িকা ভারতের সবচেয়ে সম্মানিত জাতীয় পুরস্কারটি ফিরিয়ে দিয়েছেন। ‘পদ্মশ্রী’- দেশের সবচেয়ে বড় বেসামরিক চতুর্থ পুরস্কার। অথচ এই গায়িকার গান বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে একটি মৌলিক ভূমিকা পালন করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনপণ যুদ্ধে অনুপ্রেরণা দানের অসীম কার্যকারণ হয়েছে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মনে দেশাত্মবোধের আবহ, আমেজ ও ভালোবাসা জাগিয়েছে। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে, শেখ মুজিবুর রহমান, তাকে বাংলাদেশ নামের নতুন রাষ্ট্রের পিতা হিসেবে সম্মান জানানো হয়, সম্মানিত করা হয় ‘বঙ্গবন্ধু’ নামে; পাকিস্তানের জেল থেকে তাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া নিজের নতুন দেশটিতে এলেন, সেই ক্ষণে তাকে সম্মাননা ও ভালোবাসা জানানো হয়েছিল এই সন্ধ্যা মুখাজির গানে-‘বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে, তোমার স্বপ্নের, স্বাধীন বাংলায়।’
গানটি বেজেছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান শক্তি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেই। লিখেছিলেন আবিদুর রহমান আর কম্পোজ করেছিলেন সুধীন দাশগুপ্ত। পশ্চিম বাংলা থেকে আসা সবচেয়ে বিখ্যাত ও সবচেয়ে বেশি গানের সঙ্গীত পরিচালকদের একজন; মানুষটি যেমন মার্জিত ও শান্ত ছিলেন, তেমনি ছিলেন শক্তিশালী গান রচয়িতা। তিনি সন্ধ্যার কন্ঠে সবচেয়ে ভালো স্মরণীয় গানগুলো তৈরি করেছেন। ওই গানটি একটি শান্ত ও আবেগী মনে করিয়ে দেওয়া-কষ্ট ও ত্যাগগুলোকে; একটি বিরাট জনগোষ্ঠীর; সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের আরো অনেক গানের মতো; সেগুলোর সবই গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থবহ ভূমিকা রেখেছিল রেডিওতে সঙ্গীতের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে।
এই মানুষটির গানগুলো মুক্তিবাহিনীকে কেবল উদ্দীপ্ত করেনি, খুব ভালো ভূমিকা রেখেছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি দেশাত্মবোধ হৃদয় ও মনে তৈরি করার ক্ষেত্রে। অনেকগুলো বছর পর আবারও চমকে দেবার মতো খবরে পরিণত হলেন জীবনের শেষ সীমানায় চলে আসা এই কিংবদন্তী গায়িকা। এই বছরের ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে, ৯০ বছরের মানুষটি তাকে উপহার দেওয়া সঙ্গীতে অবিস্মরণীয় অবদানের দৌলতে পদ্মশ্রীটিকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এই সম্মানটি গ্রহণ করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন-‘এটি অপমান ও অবমাননার।’ এরপর বলেছেন, ‘আমাকে পদ্মশ্রী দেওয়ার সময়টি অনেক আগেই পেরিয়েছে। একজন জুনিয়র শিল্পী এটির আরো যোগ্য।’
মানুষটির জন্ম ও বেড়ে ওঠা কলকাতাতে। ১৯৩১ সালের ৪ অক্টোবর জন্মেছেন তিনি কলকাতার দাকুড়িয়াতে। তার বাবা সঙ্গীতপ্রেমী নরেন্দ্রনাথ মুখার্জি, একজন রেলওয়ে অফিসার ছিলেন। ফলে ভালো ও স্বচ্ছল পরিবারে জন্মেছেন গানের পাখিটি। মা তার হেমপ্রভা দেবী। তাদের ছয় সন্তানের সবচেয়ে ছোট সন্ধ্যা। এই পরিবারটি ১৯১১ সাল থেকে এখানে বাস করছে। তার দাদু ছিলেন একজন পুলিশ অফিসার।
সন্ধ্যা মুখার্জির গান শেখার শুরু পন্ডিত সন্তোষ কুমার বসুর হাতে। এরপর অধ্যাপক এ টি কানন ও অধ্যাপক চিন্ময় লাহিড়ী তাকে শিখিয়েছেন ভালোবেসে গান। তবে নিজের গুরু বলতে সন্ধ্যা উস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খানের কথা বারবার বলেন। পাতিয়ালা ঘরাণার সঙ্গীত কিংবদন্তী ওস্তাদ বাড়ে গুলাম আলী খানের কাছে গান শেখার সৌভাগ্য অর্জন করেন তিনি। তার ছেলে উস্তাদ মুনাব্বার আলী খানের কছে এরপর তার গান শেখা। তিনি তাকে ভারতীয় ক্ল্যাসিক গানে মাস্টার করে তোলেন।
সন্ধ্যা মুখোপাখ্যায় পেশাদার সঙ্গীত শিল্পীর ক্যারিয়ার শুরু করেন ভারতের মুম্বাইয়ের সিনেমা সিটিতে। প্রথম ছবিটি সন্ধ্যার ছিল মধুবালা ও দিলীপ কুমারের ‘তারানা’! এটি মুক্তি পেয়েছে ১৯৫১ সালে। মুম্বাইয়ে তার প্রথম সঙ্গীত পরিচালক হলেন অনীল বিশ্বাস। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সিনেমাতে প্রথম গানটি হিন্দি; তিনি গেয়েছেন ‘বল, পাপিয়া বল’। এই প্রথম ছবিতে তিনি কাজ করেছেন লতা মঙ্গেশকারের সঙ্গে!
এরপর একে, একে ১৭টি হিন্দি ছবিতে গান গেয়েছেন সন্ধ্যা মুখার্জি। তারপর কলকাতাতে ফিরে এলেন। বাংলা চলচ্চিত্রে উচ্চ আসনের একজন প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছেন তিনি। তার সবচেয়ে ভালো গানগুলো অমর গায়ক হেমন্ত কুমারের সঙ্গে; গানগুলো তাদের সিনেমাতে। সুচিত্রা সেনের প্লেব্যাকে সন্ধ্যা তুলনাহীন। হেমন্ত-সন্ধ্যা হিন্দি সিনেমাতেও জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন।
১৯৭১ সালে তিনি একটি পশ্চিম বাংলায় সিনেমার রাজ্য পুরস্কার লাভ করেন আগের বছর বাংলা সিনেমা ‘নিশি পদ্ম’তে গাওয়ার সুবাদে। এই ১৯৭১ সালেই তিনি ভারতের সবচেয়ে বড় সিনেমার পুরস্কার ‘দি ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়াড’ জয় করেছেন সেরা গায়িকা হিসেবে ‘জয় জয়ন্তী’ ছবিতে। ছবিটি বাংলায় রিমেক। ১৯৬৫ সালে ‘সাউন্ড অব মিউজিক’ নামের আমেরিকান মিউজিক্যাল নাটকীয় গল্প নিয়ে তৈরি প্রথম হলিউডি ছবিটি। জুলি অ্যান্ড্রুজ ও ক্রিস প্লুমেরের ছবিটি সে বছরই সিনেমা হলগুলোকে কাঁপিয়ে দেওয়া মাইলফলক হলিউডি ছবিতে পরিণত হয়েছিল। পাঁচ, পাঁচটি অস্কার জয়ের ঐতিহাসিক রেকড গড়েছে। বাংলা জয় জয়ন্তীতে অভিনয় করেছেন প্রধান নায়ক উত্তম কুমার ও তার বিপরীতে ছিলেন অপণা সেন। প্রতিটি প্রেমিক ও প্রেমিকার এবং ভালোবাসায় আকুল মানুষের হৃদয়টি জয় করে নিয়েছে সিনেমাটি। ছবিটিতে তাদের মতোই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের এভারগ্রিন গানগুলো মন কেড়েছে। সঙ্গীতের অনবদ্য অভিজ্ঞতার স্বাক্ষী দিয়েছে, সেজন্যই কী বেরিয়েছে ১৯৭১ সালে?
কলকাতাতেই তিনি ভারতের পূবের অংশ একই ভাষা ও জীবনাচরণের জনগোষ্ঠী পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে সক্রিয় আসাধারণ, অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বাংলাদেশের বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক সমর দাশকে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছেন। এই রেডিও সম্প্রচার কেন্দ্রটি বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলোর জন্য তারা গড়ে তুলেছিলেন। কাজের গান ও অন্যান্য কার্যক্রম বাদেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বার্তাগুলো বেতারের মাধ্যমে সাধারণ এবং সব মানুষের কাছে পৌছে তারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। কেবল তাই নয়, সন্ধ্যা মুখোপাখ্যায় পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম বাংলাতে সব হারিয়ে জীবন বাঁচাতে চলে আসা লাখ, লাখ বাঙালি শরনাথীদের সাহায্যের জন্য চাঁদা তোলার ক্ষেত্রেও অন্য ভারতীয় বাঙালি শিল্পীদের সঙ্গে যোগদান করেছিলেন। অনন্য ভূমিকা রেখেছেন।
বাংলাদেশ গঠনের পর একটি উৎসবে গান করতে যাওয়া নতুন দেশটির প্রথম বিদেশী শিল্পীদের একজন ছিলেন ভারতে বাংলাদেশের অসাধারণ এই বন্ধু। ১৯৭১ সালে তার ঢাকার পল্টন ময়দানে পারফরমেন্স, যেটির আয়োজন করা হয়েছিল দেশটির ভাষা দিবসের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য; একুশের সেই স্মরণানুষ্ঠান এখনো স্মৃতিময়।
তাকে ‘বাংলা বিভূষণ সম্মান’টি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দেওয়া হয়েছে রাজ্য সরকারের তরফে ২০১১ সালে; পশ্চিম বাংলার পক্ষে।
কিংবদন্তী এই গায়িকা হাজারেরও বেশি গান করেছেন বাংলা সিনেমার জন্য। তার ও হেমন্ত মুখার্জির ডুয়েট কোনোদিন ভোলা যাবে না। অমর সঙ্গীত পরিচালক এস ডি বমণ, রোশান, মদন মোহন, নওশাদ, অনীল বিশ্বাস ও সুনীল চৌধুরীর অধীনে গান গেয়েছেন, কাজ করেছেন তিনি।
একজন অত্যন্ত বিখ্যাত ক্লাসিক্যাল ও সেমি-ক্লাসিক্যাল এই গায়িকা বাংলা ছবিগুলোকে স্মরণীয় করে তোলার জন্য গান করে গিয়েছেন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ও উইকিপিডিয়ার অনুবাদ, ২৯-১-২০২২।