এক টুকরো সাজানো বাগান
যত দূর থেকে চোখে পড়ে মন টানে। মাথার ওপরে এই সড়ক স্থাপনাটির রঙিন মোটা কাঁচ। কেমন যেন অন্যরকম ও নতুন লাগে। কবে তার দেখা পাব, যাব সেখানে এমন বোধ হয়। টিভি ও সংবাদমাধ্যমে যতটুকু বিজ্ঞাপন এবং প্রচার হয়েছে, সেটি নেমে দাঁড়ানোর পর যথেষ্ট মনে হলো না। ঢাকার এমইএসের কোনায় আসার পর চমকে যেতে হলো। এত ভালো, সুন্দর ও দীর্ঘস্থায়ী কাজও করা সম্ভব এই দেশে? পথচারী পারাপারের আন্ডারপাসটি অত্যন্ত যত্নে, দীর্ঘস্থায়িত্ব দিয়ে করা। প্রবেশ পথের আগেই বামে বসার জন্য দুটি স্টিলের আসন সারি পাতা আছে। প্রতিটিতে অন্তত ৫ জন করে বসতে পারেন।
সেগুলোতে বসে তারা উল্টোদিকের মহাসড়কের গাছের সারি ও অক্সিজেন ভান্ডার দেখতে পারবেন। নিয়মকানুনের চাদরে মোড়া, দারুণ চলমান মহাখালী-এয়ারপোর্ট রোডের গাড়ির সারিগুলোকে চলে যেতে ও আসতে দেখবেন। আরো দেখবেন, রোড ডিভাইডারে বাঁধাই করা আছে বড় গাছের সারি। শহরের দুর্লভ বৃক্ষ এখন পথের মাঝে মানুষের মনোযোগ কেড়ে নিচ্ছে বারবার। বলছে, আমাদের বাঁচাও, তোমাদের স্বার্থেই। প্রশস্ত পথচারি হাঁটার পথটি, কোমর সমান উঁচু দালানের প্রাচীরের পেছনে বিরাট চাষের পুকুর, সুরক্ষা প্রাচীরে ঘেরা। এই দালানটি এগিয়ে আন্ডারপাসের দেওয়ালে পরিণত হয়েছে।
উল্টোদিকের ঢাকার এমইএস, সশস্ত্র বাহিনীর মানুষদের বাসাবাড়ি। তার একটু সামনে আর্মড ফোসেস মেডিক্যাল কলেজের সামনে আছে ফ্লাইওভার, তার নীচে এই মহাখালী-বনানী সড়কটি বিরাট। প্রবল ব্যস্ত থাকে সারাক্ষণ। রাতে সড়কবাতি ও গাড়িগুলোর হেডলাইটের আলোতে ঠিক বিদেশের, হলিউডের বা টিভিতে দেখা অন্য কোনো দেশের সড়কের মতো দেখা যায়। মিনিটখানেকের বিরতি নেই কোনো। এখানে অনেক বড় এলাকাজুড়ে রাস্তার মাঝখানের ডিভাইডারগুলোতে শিক দিয়ে উঁচু করে বাঁধানো। বামে এমইএসের সামনে দাঁড়িয়ে মহাখালীর দিকে যেতে ঢাকা-এয়াপোট নামের এই মহাসড়কে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ সংলগ্ন পথচারী আন্ডাপাসটি। একেবারেই নতুন সংযোজন এই রাজধানী, মহানগরে।
একই দিন ঢাকা সিলেট সড়ক বাইপাস-গ্যারিসন লেন মহাসড়ক; বালুখালী (কক্সবাজার) ঘুনধুম (বান্দরবান) সীমান্ত সংযোগ সড়ক এবং রাঙ্গামাটি জেলার নানিয়ারচরে চেংগী নদীর উপর ৫শ মিটার দীঘ সেতুর শুভ উদ্বোধন করেছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্থান-গণভবন, সময়-সকাল ১০টা। তারিখ-১২ জানুয়ারি ২০২২। এই চারটি কাজ করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ ও ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনষ্ট্রকাশন ব্রিগেড। কাজগুলো সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অধীনে সম্পন্ন করা হয়েছে। ‘মুজিব শতবর্ষ’ উপলক্ষে করা এই কাজটির ওপরেও শেখ সাহেবের শিশুতোষ ছবি আঁকা আছে। বামে আছে বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী। তাতে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের বিখ্যাত আঙ্গুলটি রয়েছে। নীচে তার ফিদেল কাস্ত্রো ফেইস।
শহীদ রমিজ উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আন্ডারপাসটির ওপরে লেখা-সুস্বাগতম, পথচারী আন্ডারপাস। তার ওপরে সাদা সিম্বলে সাদা একজন মানুষ রাস্তা পেরুচ্ছেন, ছবিটি আঁকা আছে। রাতে বন্ধ রাখার জন্য প্লাস্টিকের কটি রোড ডিভাইডার বামের কোণায় সাজানো আছে। ভেতরে ঢুকলে আধুনিকতা ও মানবিকতার ছড়াছড়ি দেখবেন যেকোনো মানুষ। সবই তার ও তাদের জন্য। আছে হুইল চেয়ারে চলার জন্য সিঁড়ি। প্রতিবন্ধিতায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা সেখানে সহজে পথে চলতে পারবেন। তারা সিঁড়ি বেয়ে নিচের মূল মোজাইকের সমতল পথে চলে আসতে পারবেন একাই, কারো সাহায্য ছাড়াই। ওপরে আছে বনানী, মহাখালীর পথে ওঠার আলাদা চেনার চিহ্ন। সাদা এই আন্ডারপাস পুরোটা। মাথার ওপরে পুরোটাতেই শক্ত কাঁচের ছাউনি। সেগুলোর প্রতিটি আলাদা, আলাদা কাঁচের টুকরো, জোড়া লাগানো হয়েছে। দারুণ সুন্দর ও টেইসই। রোদ এসে পড়ে ভেতরে। ফলে বাতি জ্বালিয়ে পয়সা খরচের কোনো দরকার হয় না। সেনাবাহিনীর সুনাম এখানেও ধরে রেখেছে। আছে ডানে ও বামে কোমর সমান দেওয়াল শুরুতে, খুব মজবুত এবং চওড়া। বহু বছরের উপযোগী আন্ডারপাসটি। সেখানে চেয়ারে বসে আছেন ২৪ ইসিবি ব্রিগেডের সৈনিক মামুন। তিনি কথা বলতে এগিয়ে এলেন। বললেন, ‘আমাদের এখানে অসুস্থদের জন্য লিফট আছে, হুইল চেয়ার আছে প্রতিবন্ধিতায় আক্রান্তদের জন্য। সুস্থ-সবলদের জন্য আছে সিঁড়ি। আমরা সেনাবাহিনীই এই আন্ডাপাসের রক্ষণাবেক্ষণ করি।’ জানালেন, ২০১৮ কী ২০১৯ সালে কাজ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় ওপরের দিকে ফলক লাগানো আছে চেনার জন্য-বাহির, একজিট, ধন্যবাদ ইত্যাদি। প্রথম ধাপে ১১টি সিঁড়ি দিয়ে নামতে হয় আন্ডারপাসে, এরপর সামান্য পথ হেঁটে আবার ১১টি সিঁড়ি। এভাবে মোট চারটি ধাপ, শেষটিতে ৪টি সিঁড়ি।
বিরাট উঁচু সাদা মোজাইকের দালান পুরো আন্ডারপাস। নানা জায়গাতে শিল্পকর্মের উদাহরণ হিসেবে বাঁধানো বড় ছবি আছে। প্রথমটি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ হাওড়। তাতেও বাংলাদেশের অদম্য সাধারণ নারীরা কাজ করছেন। খুব সুন্দর প্রকৃতি ফুটে উঠেছে বড় করতে গিয়ে ফাটিয়ে ফেলা ছবিটিতে। এমন অনেকগুলো ছবি আছে। বেখেয়ালের আদর্শ উদাহরণ কোনো, কোনোটি। প্রথমটি শেখ মোহাম্মদ তৌফিকুল ইসলামের তোলা। এরপরের হিমছড়ি, কক্সবাজারের ছবিটি তুলনায় ভালো। বিরাট এই আন্ডারপাসটি ভালো কাজের অনন্য উদাহরণ। তাতে ওপরে টাঙানো আছে অগ্নিনির্বাপক ব্যাবস্থা। নীচের পুরোটা পথেই কোনা ধরে স্টিলের জলরোধী বিশেষ ব্যবস্থাটিও খুব ভালো। নীচে ড্রেনেজ সিস্টেমে বৃষ্টির পানি নেমে যাবে। ওপরে সাউন্ডবক্সে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাজের বিবরণ মানুষকে জানানো হচ্ছে। অনেকেই পারাপার হতে ও বেড়াতে এসেছেন। সাউন্ডবক্স বলছে-‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের সেবায় সর্বক্ষণ নিবেদিত।’ এই ছবিটি ভালো-সারি নদী, সিলেট; খুব সুন্দর। মোহাম্মদ আলীর তোলা। প্রতিটি বড় বাঁধাই ছবিতে আলোকচিত্রীর নাম ও মেইল আইডি দেওয়া আছে। মোজাইক করা পুরোটা হাঁটা পথ আন্ডারপাসের। জরুরি প্রয়োজনের কলিংবেল আছে। আরেকটি ছবি আছে-সুনামগঞ্জের লাল শাপলা বিলে নৌকার দুপাশের দুইজন মাঝি জীবিকা উপার্জন করছেন। সবুজ পতাকাটি তাদের বাংলাদেশের পতাকার মতো পত পত করে উড়ছে। এই কাজের কারিগর সেনাবাহিনীর সুরসপ্তকের অফিসারদের ছবি আছে-তারা এই কাজের গর্বিত অংশীদার। এতে প্রাথমিক চিকিৎসার টুল বক্সের সাইন আছে দেওয়ালে। একেবারে শেষে সেই বক্স দেওয়ালে রাখা আছে। পাশে পাসটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সেনা অফিস, পাতাল লিফট রয়েছে। নিজেদের ব্রিগেড, ব্যাটালিয়ন ও ২৫ ইসিবির নাম তারা দেওয়ালে খোদাই করে রেখেছেন ফুলের মতো ভালোবেসে। রাতে বাতি জ্বালানোর বিশেষ ব্যবস্থা ছড়িয়ে আছে। ওপরে আছে সুরক্ষিত বাতির সারির বক্স। বিশেষ ধরণের বাতিগুলো। তারা সবাই রাতের পরিবেশটি অন্যরকম করে ফেলে। তখন ওপরের তারা, চাঁদেরও দেখা মেলে কাঁচের আড়ালে।
ছবি বাঁধানো আছে ঢাকার হোসেনী দালানের ১৯০০ সালের। আজকের সঙ্গে কী মেলে? আছে কোনো ঐতিহ্য সংরক্ষিত? তবে আন্ডারপাসের দেওয়ালের ওপরের দিকে সেন্ট্রাল কারেন্ট বক্স আছে। সুন্দরবনের ছবিটি ভালো নয়, জাভেদ মানিকের তোলা; ফেটেও গিয়েছে। সেনাবাহিনীর খাল, নদী উদ্ধারের ছবি দিয়ে নীচে লেখা-‘সমরে আমরা, শান্তিতে আমরা; সবত্র আমরা দেশের তরে।’ এই ছবিটি ভালো রেজ্যুলেশনের, আশ্চয তো। রায়ের বাজার বধ্যভূমির ছবিটি খুব সুন্দর, মোয়াজ্জেম মোস্তাকিমের তোলা। সিসিটিভিতেও সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে আন্ডারপাসকে। ছবি আছে ঢাকা ক্লাবের প্রথম দিকের-১৮৮০। পুরোনো মডেলের দালানের সামনের ছাউনিটি ছনের ছাউনির মতো। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন উন্নয়ন কমকাণ্ডের ছবি আছে শক্তিশালী, সাদা মোজাইকের দালানে। লেখা একটিতে, ‘দেশমাতৃকার সেবায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।’ ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশনেও তাদের উন্নয়ন কাজের ছবি বাঁধানো আছে। জাভেদ মালিকের সাদাকালো ছবিটি খুব সুন্দর-ঢাকা রংপুর হাইওয়েতে অনেক বছর আগে ছুটে চলছে গাড়ি। আছে পুরোনো আহসান মঞ্জিল।
‘গরমের জন্য স্টিলের বিশেষ ঝুলন্ত ফ্যান এগুলো’-বললেন সেনাবাহিনীর পোশাকের এক অফিসার। লাল রঙের বিরাট ফ্যানের বক্সগুলো। নানা জায়গাতে সুচিন্তিতভাবে লাগানো আছে। অসাধারণ ছবিটি সুন্দরবনে জোয়ার-ভাটায় নৃত্য করছে কয়েকটি ছেলে। দূরে জাহাজ ভাসছে। রেজ্যুলেশন ভালো। আলো চিক, চিক করছে বিরাট জলরাশিতে। সেনাবাহিনীর অফিসের সামনের দালানে ওয়াল টিভিতে দেখানো হচ্ছে আন্ডারপাসের শুরু থেকে শেষ কর্মযজ্ঞ। সেটি দেখতে দেখতে মনে হলো, মাথার ওপরের বিরাট ফ্লাইওভারের নীচে এ এক টুকরো সাজানো বাগান।
সুরসপ্তকের বিশেষ কালো দেওয়াল চিত্রে বঙ্গবন্ধু ও সাত বীরশ্রেষ্ঠের ছবি আঁকা। তিনি সাত মার্চের ভাষণ দিচ্ছেন। সেখানে একটি ছবিতে নোয়াখালীর সুবর্ণচরের সূর্যমুখী বাগানে একটি কিশোরী মাথায় ফুল গুঁজছে। খুব সুন্দর গ্রাম বাংলার অপরূপ ছবিটি। অন্যরকম, অসাধারণ। পাশে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার দুটি লাইফ সাইজ ছবি। আছে কালো বিরাট আরেকটি দেওয়াল চিত্রে শহীদ মিনার ও স্মৃতিসৌধ এবং উন্নয়ন কমকাণ্ড। পাশে বনানীর মহাসড়কে ওঠার সিঁড়ি। আরো সামনে শহীদ রমিজ উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামফলক। এটি ধরে উঠে গেলাম। সামনে পড়লো জিয়া কলোনীর সামনের পথ। একেবারেই নিরাপদ। কতবার যে প্রাণ হাতে নিয়ে এই পথে যেতে হয়েছে। আর এখন ভেবে বিরাট এক স্বস্তির নি:শ্বাস বেরিয়ে এলো। ধন্যবাদ সবাইকে।
ঢাকা, ২৪-১-২০২২।