সম্পাদক কাজী আনোয়ার হোসেন: অনন্য, অপূর্ব
তার সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো একটি বিশেষ বিষয়কে ধরে খুব ভালোমানের নানা ধরণের বই করতে পারা। বিষয়টি অ্যাডভেঞ্চার। এর মধ্যে এসেছে কিশোর অ্যাডভেঞ্চার বা কিশোর অভিযান। যেটি লিখেছেন রকিব হাসান। অন্তত ৩০টি বছর। এরপর অ্যাডভেঞ্চারে এসেছে মাসুদ রানা। রানা পাঠকদের সবাই ও সেবার বেশিরভাগ পাঠক এবং বাংলা সাহিত্যের লেখা পড়েন এমনরা অবশ্যই মাসুদ রানাকে আগে নিয়ে আসবেন। সেটি মান্য করতে হবে। তারপর আছে ওয়েষ্টার্ন। এই সিরিজেও অনেক বই আছে। আছে অভিযানের পুরোনো কাহিনী যেমন বাউন্টিতে বিদ্রোহ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষের দিকে ফিরে যাওয়া জামান সৈনিকদের বেদনাবিধুর কাহিনী নিয়ে স্বপ্ন, মৃত্যু ভালোবাসা। এটি জাহিদ হাসানের অনুবাদ। আরো কত কী যে আছে সেবার ভান্ডারে।
সম্পাদক কাজী আনোয়ার হোসেনের আরেকটি কীতি হলো বইয়ের ব্যবসাকে বাজার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। ঢাকার সবচেয়ে দামী এলাকা ধানমন্ডির পেপার স্টলে যেমন আছে তার বই, তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামের বইয়ের দোকানেও আছে সেটি। প্রতিটি বইতে তিনি লিখে দিয়েছেন-এই বইয়ের কোনো পৃষ্ঠা না থাকলে, বইতে কোনো খুঁত থাকলে সেটি ডাকযোগে পাঠিয়ে দিন। আমরা আরেকটি বই দিয়ে দেব। পাঠকের প্রতি যে ভালোবাসা সেটি কাজী আনোয়ার হোসেনের গড়া।
কীভাবে এই বইগুলোর বিজ্ঞাপন করতেন তিনি? জানলে অবাক হয়ে যাবেন তবে সেবার সব পাঠকের সেই নিয়মটি জানা। নিজের পেপারব্যাকগুলোর একেবারে শেষ পাতায় তিনি নতুন বইগুলোর নাম লিখে দিতেন। এমনকি কোন বইটি আবার প্রিন্ট করবেন সেটিও বলে দিতেন। তাতে লেখা থাকতো রিপ্রিন্ট। এরপর সেটির জন্য অপেক্ষা করতেন পাঠকরা ও গোগ্রাসে গিলতেন।
বইমেলাতে সেবা প্রকাশনীর স্টলে সব সময়ই পাঠকের ভীড় লেগে থাকে। আগের চেয়ে দিনে, দিনে কমেছে তা। তবে একসময় সেখানে ভীড় ঠাসা ছিল। একটি নিউজপ্রিন্ট বুকলেট তার। সেটি পাঠকরা হাতে নিয়ে যেকোনো বই নিয়ে ফিরে যেতে পারেন। কেননা, বইটি তাকে কেবল আনন্দ দেবে না, ইনফরমেশন দেবে। পাশাপাশি দেবে বেড়ানোর অপার আনন্দ রহস্যের ভুবনে। ভালো পাঠকরা ডুবে থাকেন পুরোনো বইগুলোর ভুবনে। নতুন আরেকটি বই ততদিনে চলে আসে।
কাজী আনোয়ার হোসেনের বইয়ের এই ব্যবসাটি পেপারব্যাক বইয়ের। নিউজপ্রিন্টে ছাপা কাগজ। তবে সেগুলো খুব টেকসই। ছেঁড়ে না। নষ্টও হয় না। এতই যত্ন করে তারা বইগুলোর প্রতিটি প্রকাশ করেন। সেবা এখনো তার এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। কাজী আনোয়ার হোসেনের বয়স হয়ে গিয়েছে। সেবা প্রকাশনীর বইগুলোতেও সেই ছাপ আছে। বাজে কাহিনী, বাক্যের রিপিটেশন দেখা যায়। তবে সেসবও ছাপিয়ে গিয়েছে তার কাহিনীর জাদু ও বিষয়ের বিচিত্র উপস্থাপন। ফলে এই বইগুলোও সচেতন এবং ভালো পাঠকরা ফেলে দিতে পারেননি। সবসময়ের সেবা বইয়ের মতো সেগুলো তুলে রেখেছেন কালেকশানে।
কাজী আনোয়ার হোসেনের সম্পাদনার মূল বিষয় হলো বিচিত্র ও অবিশ্বাস্য গতিময়; অ্যাডভেঞ্চারাস কাহিনীগুলোকে তিনি পাঠকদের হাতে নিয়ে এসেছেন। সেগুলো লিখেছেন টান, টান উত্তেজনায় তার লেখকেরা। তারা সবাই জীবনের প্রথম বই তার এই প্রকাশনী থেকে বের করেছেন। এরপর একের পর এক সিরিজ ও নতুন বই তুলে দিয়েছেন পাঠকদের। সেগুলো নির্বাচন করেছেন কাজী আনোয়ার হোসেন নিজে। যার স্বাদ কখনো মিটতো না, যার ক্লান্তি বলে কিছু ছিল না। একটি বই বের করেছেন বাবুল আলম ডোবারম্যান নামে। এই ডোবারম্যান একটি কুকুর। বিশেষ জাতের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একদল খুনীকে খুঁজতে চলে গেলেন নায়ক। চমকপ্রদ কাহিনীর ভান্ডার হয়ে আছে সেটি।
আরেকটি বই হলো অশুভ সংকেত। শয়তানের পুত্র ডেমিয়েনের বিপক্ষে বিশেষ জাতের ছুরি হাতে নেমে পড়েন একদল পাদ্রী। তারা ডেমিয়েনকে মারবেন; যার জন্ম হয়েছে শুকরের পেটে। অমিত শক্তিশালী মানুষটি। তাকে শেষতক মেরে ফেলেন তারা। তারপর আবার আছে পরের পর্ব। তারপরের পর্বও হয়েছে। আরেকটি অসাধারণ বই হলো আয়রন মিসট্রেস। তাহের শামসুদ্দীনের অনুবাদটি পড়ে দেখার আমন্ত্রণ রইলো।
এভাবেই একের পর এক বিচিত্র ও অসাধারণ স্বাদের বইগুলো একজন সম্পাদক হিসেবে তুলে এনেছেন কাজীদা নামের মানুষটি। সেগুলো লিখিয়েছেন যাদের দিয়ে, তাদের সবার লেখাই রস ও রোমাঞ্চ এবং অ্যাডভেঞ্চার সাহিত্যের মাইলফলক হিসেবে।
সেবা বইয়ের দুর্বলতা হলো বিদেশী কাহিনী থেকে প্রচ্ছদ। সেগুলো তাদের ট্রেডমার্ক। ফলে পাঠকরা কিনে নিতে পারেন এক লহমায়। খুব কম বইয়ের প্রচ্ছদই করেছেন তারা। তবে ধ্রুব এষের মতো বিখ্যাত, আজকের নামকরা প্রায় সব প্রচ্ছদ শিল্পীর করা বইও আছে তাদের। এমনকি সাংবাদিক হিসেবে খ্যাতিমান আলীম আজিজও সেবার প্রচ্ছদ করেছেন। সেই তুলনায় তার বই কম এখানে।
দাম সেবার আরেক বিষয়। তাদের বইগুলোর দাম কম। সেগুলো হাতের নাগালে থাকে। একটি বইয়ের দাম তারা এভাবে রেখেছেন যাতে সেটি সে কদিনের জন্য পাঠকের হাতে থাকে। তারা এই বইগুলো সর্বস্বত্ব দিয়েছেন লেখককে।
বিপননের ব্যবসাতে সেবার গোপন রহস্যের একটি হলো তারা বইগুলোর ফাঁকে বের করেছেন রহস্য পত্রিকা। তাতে রহস্য, ওয়েস্টান, প্রয়োজনীয়, অতি জরুরী সবই আছে। রহস্য পত্রিকা পাঠককে ধরে রাখে বাজারে। আর সেই ফাঁকে চলে আসে শেখ আবদুল হাকিম, রকিব হাসান, কাজী মাহবুব হোসেন, রওশন জামিল, শওকত হোসেনের লেখা কোনো না কোনো দারুণ বই।
আলোচনা রেখেছেন অনেকগুলো বইয়ের পেছনে। তাতে পাঠকের রুচি, অভ্যাস, তার চাহিদা তারা ধরে ফেলতে পারেন। তবে কাজী আনোয়ার হোসেন নামের কঠিন, কঠোরের মিশেল মানুষটি তার কোনো গুণগান সেখানে ছাপাননি। তারচেয়ে জোর দিয়েছেন অন্যদের কথা তুলে আনতে। তার গুণগান যে ছাপাননি তা নয়। নিয়মিত কৌতুক রেখে তিনি পাঠকের মন ভালো রেখেছেন। এটিও বিপননের নব কৌশল।
২১-১-২০২২।