কে চলে গেলেন?
পুরানা পল্টনের ২৪/৪, সেগুন বাগিচার নামটি প্রায় সবারই জানা, যারা বই পড়েন। এখানে পা পড়েনি বা শোনেননি এমন মানুষ বিরল। কেননা, সেবা প্রকাশনীর প্রতিটি বইয়ের কাভারের পরের পাতায় লেখা থাকে ঠিকানাটি। প্রকাশকের নাম লেখা কাজী আনোয়ার হোসেন। এই অফিসে ঢুঁ মারতে গিয়ে ফিরেছেন, তাদের সংখ্যা কোনোদিন কী হিসেব করা হয়েছে? তবে আজ সেটি খোলা আছে। খোলা মানে গেটে তালা নেই কোনো। ঠিক যেন কোনো ওয়ের্স্টানের সেলুনের গেটের সমান। সেটি ঠেলে ভেতরে ঢুকে যেতে, যেতে অবাক বনতে হলো। তারপর সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে বারটেন্ডারের মতো বসে আছে একটি ছেলে। তবে বয়স্ক কোনো বারটেন্ডার নয় সে, বয়স তার একেবারে কম। ওয়েসলি হারডিন, রক বেননের মতো মুখে তার কাঁচা দাড়ি ভর্তি। ক্ষুরের অভাবে কাটা হয়নি। তাকে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলাম, কাজী আনোয়ার হোসেনের সাহেবকে কোথায় রাখা হয়েছে? প্রশ্নের সঙ্গে, সঙ্গে আততায়ী বা এমন কোনো নামের পশ্চিমের বইয়ের মতো মোটাসোটা একজন লোক বেরিয়ে এলেন। ছেলেটি উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আমি আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি।’
কাঠের টেবিল-চেয়ার বইগুলোর প্রতিটির মতো, চেয়ার সরিয়ে সে বেরিয়ে এলো আগে। তাকে নিয়ে আবার নামতে, নামতে চোখে পড়লো একটি চৌবাচ্চা। পরিস্কার পানিতে ভরা। তাতে একটি রূপালি অ্যাকুয়ারিয়ামের মাছ একা একা ভেসে বেড়াচ্ছে। সে মুখ হাঁ করে পানিতে শ্বাস নিচ্ছে। ঠিক যেন নি:সঙ্গ আততায়ী। তারপর চমকে যেতে হলো। পাশের যে গলি সেটিই যে সেবা প্রকাশনীর তিন লেখকের বাড়ি কোনোদিন জানা ছিল না। পরতে, পরতে গোপনীয়তায় ঠাসা, উত্তেজনায় ভরা ক্লাসিক বইগুলোর মতো; যেগুলো নামকরা নন, তবে বিদেশী নামের; সেগুলোর মতোই অবিশ্বাস্য বিষয়ের মধ্যে পড়ে যেতে হলো।
এটিই লাগোয়া, সেবা প্রকাশনীর পেছনের বিরাট আটতলা বাড়ি। রঙিন বাড়িতে থাকেন আরো রঙিন তিন লেখক, কাজী আনোয়ার হোসেন ও তার দুই ছেলে কাজী শাহনূর হোসেন এবং কাজী মায়মূর হোসেন। শুরুতেই সেলুনের গেটের মতো অ্যালুমিনিয়ামের গেট। তাদের বইগুলো মতো সাজানো আছে। লেখা-সেলুন পার্লার ফর ম্যান। ঠিকানা লেখা আছে, ২৪/২, সেগুন বাগিচা। এই হলো কাজীদার বাড়ি। কেউ কী জানেন, লেখকরা ছাড়া?
নীচতলায় গাড়ি পার্কিংয়ের কালো একটি কার পড়ে আছে, মাসুদ রানার ব্যবহার করা কোনো কারের মতোই। তার বাতির সামনে শুয়ে আছেন লম্বা মানুষটি। একহারা গড়নের, সবুজ জায়নামাজে মোড়া তার তার শরীর। ঠিক যেন পশ্চিমের ঢেউ খেলানো কোনো তৃণভূমি। তার পায়ের কাছে স্বযত্নে মোড়া ফুলের তোড়ার ভেতরে জ্বলজ্বল করে ফুটে আছে লাল একটি গোলাপ। সেবার বাগানের মালির জন্য অর্ঘ্য সবার। তোড়াটির গায়ে কাগজ ও কস্টটেপ দিয়ে লাগানো একটিই সাদা পৃষ্ঠা-‘নবাবকে শ্রদ্ধাঞ্জলী, গেরিলা ’৭১।”
কে জানাতো, কোনোদিন বলেননি তো তিনি, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের একজন যোদ্ধা ছিলেন। এই নবাব কাজী মোতাহার হোসেনের বড় আদরের দুলাল। তাকে কোনো কোনো সময় দেখানো হচ্ছে দর্শনাথীদের দেখার জন্য। মাথার দুপাশে তার দুটি কালো ক্ষতচিহ্ন। মুখটি একেবারে পান্ডুর। ঠিক তার অতি বিখ্যাত ছাত্র ও সহকমী রকিব হাসানের বিশ্বখ্যাত ক্লাসিক অনুবাদ বাম স্ট্রোকারের ড্রাকুলার মতো। তেমন লম্বা, তেমনি শরীর হয়ে গিয়েছে কাজী সাহেবের। এই সময়ে তার সমাধি যাত্রায় কেউ নেই। মানে কোনো হৈ, চৈ। নানা বয়সের নয়জন নারী বসে আছেন এই বিখ্যাত শবদেহকে ঘিরে।
অতি সুন্দরী এক মহিলা আছেন মুখে সবুজ মাস্ক পরে শবদেহের পাশে। শোকে আকুল একহারা গড়নের এক বয়স্ক নারী দূর থেকে, বাড়ির ছাউনির নীচ থেকে তাকিয়ে আছেন এক দৃষ্টিতে তার দিকে। বহুকালের চেনা তার আপনজন, পরিবেশই বলে দিচ্ছে। সেবার বইগুলোতে এমন পরিবেশের ছড়াছড়ি আছে। সেবার লাখ, লাখ পাঠকরা ভাবতেই পারবেন নির্জন এই গলির ভেতরের বাড়িতে পশ্চিমের দুনিয়ার কোনো বইয়ের মতো মোটে ৩০ থেকে ৩৫ জন মানুষকে সঙ্গী করে শেষ যাত্রায় চলেছেন কিংবদন্তীকে ছাড়িয়ে যাওয়া কাজী আনোয়ার হোসেন। তার ও তাদের নি:স্তব্ধ, চুপচাপ চারধারে শব্দের বাহুল্য নেই। প্রতিটি বইয়ের মতো। কথার তোড়েও নেই কারো ফুলঝুড়ি। কয়েকটি বেতের টুলে বসে আছেন কাজী সাহেবের স্টিলের শবাসনটির ডান পাশে। একেবারে মাথার কাছে বেতের টুলে বসে মাথার পাশের শবাসনের একটি কোনা ধরে আছেন দুই হাতে শক্ত করে কিশোর, তারুণ্যের মাঝামাঝি বয়সের একটি ছেলে। তার মতো বয়সের ছেলেমেয়েরাই তার লক্ষ্য ছিলেন। কাজী সাহেবের উত্তর পুরুষটি চুপচাপ কাঁদছে। থেকে, থেকে কেঁদে উঠছে। কান্নার দমকে শরীর কাঁপছে তার। ভাষাহীন ছেলেটি তাকে ছাড়ছে না। দৃষ্টিও পড়ে আছে ওই মানুষটির ঢেকে থাকা লাশের দিকে। উল্টো দিকের আসনে, তার মতোই লম্বা-চওড়া এক মহিলা; যৌবনে ভরপুর, প্রতিটি বিদেশী কাহিনীর মতো; এই পরিবারেরই একজন; দাপুটে, তিনি ঘুরে, ঘুরে কথা বললেন সবার সঙ্গে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ওই বয়স্ক, শীর্ণ নারীটির সঙ্গে সামান্য ক্ষণ কথা বললেন। তাদের সান্তনা বিনিময় হলো চোখের জলে।
তারপর ভেতরের সাদা দালানের বাড়িটির ভেতর থেকে লিফটে সাদা সালোয়ার কামিজের একটি তরুণী নেমে এলেন। রকিব হাসান ও শেখ আবদুল হাকিমের বহুতল বাড়িগুলোও এমন। আবার তারা দুজনে শোকের সাগরে ভাসলেন। লম্বা সেই নারীর উচ্চারণ স্পষ্ট, কোনো কথাতেই কোনো জড়তা নেই। নাতির দিকে তাকিয়ে অন্য একজনকে বললেন, ‘ও এখানে থাকুক না। থাকুক। দাদার সঙ্গে তার সম্পক খুব ভালো ছিল। সবসময় দাদার কাছে কাছে থাকতো।’ তার পরের বেতের টুলে বসে আছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে নামকরা দুই গায়িকার একজন, সাবিনা ইয়াসমিন। তিনি আছেন মুখের গড়নে চেনা গিয়েছে। মুখে তার কালো মাস্ক, কোনো কথা নেই। চুপচাপ বসে আছেন শান্ত মানুষটি। তার হাতে কালো ভ্যানেটি ব্যাগ, ছোটখাট এই নারী আজ বড় বেশি চুপচাপ। তার পায়ে কালো জুতো। ইস্ত্রি করা পাজামা পরণে। কারা এসেছেন কী আসেননি খোঁজ নিলেন একটু পরে সামান্য হেঁটে। তারপর আবার গিয়ে বসলেন কাজী সাহেবের পায়ের কাছের বেতের চেয়ারে। সাবিনা ইয়াসমিনের মাথা চাদরে মোড়া। সাদা।
এই গলিটি সবসময় চুপচাপ থাকে। কোনো শব্দ, বাহুল্যতা কোনো সময়ই দেখতে পান না কাছের বা দূরের কোনো মানুষ। এমনকি পাশের গাজী টিভি ও সারাবাংলা অনলাইনের অফিসের কেউই কখনো হৈ চৈ করেন না। এটি যে সেবা প্রকাশনীর পিতৃপুরুষের ভিটে। সাবিনা ইয়াসমিন ঘুরে আবার বসে পড়লেন।
‘বাবা জাত যোদ্ধা ছিলেন’
ফর্সা, একহারা গড়নের (আমরা বলি হালকা, পাতলা) সাদা সুয়েটার পরা, হাতে ঘড়ি। তিনি সামনে এসে দাঁড়ালেন। আট, দশটি টিভির ক্যামেরা অন হয়ে গেল। তিনি বললেন, “আপনারা আমার বাবার জন্য দোয়া করবেন। তিনি জন্মযোদ্ধা ছিলেন। জাত যোদ্ধা ছিলেন। তার জীবনের শেষ সময়ে ক্যান্সার ধরা পড়েছিল। তবে তিনি দেশেই চিকিৎসা করিয়েছেন। বিদেশে যেতে রাজি ছিলেন না। বলেছিলেন, ‘যা হয় হোক আমি এই দেশেই মারা যাব।’ এরপর আরো কিছু বললেন যুবক। কেঁপে, কেঁপে কাঁদছেন তিনি। তারপর ক্যামেরা অফ হয়ে গেল। পাশ থেকে জানা গেল তার নাম কাজী শাহনূর হোসেন। কাজী সাহেবের বড় ছেলে, লেখার প্রথম উত্তরাধিকার। লাশবাহী ফ্রিজিং ভ্যান-কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের, তাদের স্বেচ্ছাসেবকরা পেছনের দুটি দরজা খুলে ফেললেন তার বইগুলোর দরজার মতো। সেখানে আত্মীয়, পরিজনরা তাকে নিয়ে নিলেন। সাইরেন বাজাতে, বাজাতে গাড়িটি সামনের দিকে চলে গেল। বাঁক ঘুরলো। আবার সামনের দিকে এগুলো। এমন দৃশ্য কেবল তার বইতেই মেলে। পেছনে সাংবাদিকের দল, তারা হোন্ডা ও পায়ে হেঁটে। দুজন নারী কাঁদতে, কাঁদতে চলেছেন ওদিকে।
নির্জন, পাতা ঝরার দিনের মতো, হালকা পায়ের আওয়াজে মৃদু শব্দ উড়ছে সেগুন বাগিচার এই পথে। যেখানে কচি, কাঁচার মেলার প্রধান অফিস। কাজী মোতাহার হোসেন সড়কের বাড়ির ছেলে কাজী সাহেব আজ চলেছেন।
জানাজার আগে ও পরে
ফ্রিজিং ভ্যানটি কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের। তারা ওই পুরানা পল্টনেরই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন রোডের স্থায়ী বাসিন্দা। চলে এলেন একেবারে লক্ষ্যে। তখন কী আশ্চয, আজান হচ্ছে মসজিদে। সময় ও ক্ষণ পুরোপুরি মিলে গিয়েছে। ১০/এ সেগুন বাগিচা, মসজিদ-ই-নূর’র সামনে এসে থামলো গাড়ি। খুব সুন্দর, সুললিত কন্ঠে আজান ভেসে আসছে। মসজিদে ইমাম সাহেব মাইকে বললেন, ‘সেগুন বাগিচা নিবাসী কাজী আনোয়ার হোসেন সাহেব ইন্তেকাল করেছেন।’ কয়েকবার তিনি বলে গেলেন ঘোষণার মতো। উল্টোদিকে কমিশনারের কার্যালয়টি আছে। তাতে নামফলকে বিএনপির নেতা চৌধুরী আলমের নাম খোদাই। তবে এই পুরো এলাকার সবচেয়ে নামকরা লোকটি আজ চলে গিয়েছেন, জানেন সবাই।
সেবা প্রকাশনীর সুদীর্ঘকালের ম্যানেজার মহিউদ্দিন সাহেব ও কাজী শাহনূর হোসেনের মধ্যে আলাপ হলো। ‘তিনি লেখাপড়ার দিকে খুব জোর দিতেন’ বললেন মহিউদ্দিন। এইখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এমন সব মানুষরা, যারা তার ও তাদের লেখাগুলোর প্রিয় চরিত্র। তিন গোয়েন্দার শুটকি টেরির মতো একজন আছেন, তেমন হালকা গড়নের; আরেকজন ওয়েসলি হারডিনের মতো, শক্ত কাঠামোর, মাথায় টাক। শক্ত শরীর। এই মানুষটি কাজী সাহেবের আত্মীয়। তার পরনে নীল জিন্ম ও গায়ে সাদা পাঞ্জাবি। পশ্চিমের আইনের মানুষের মতো সাদা পোশাকে আজ। কিংবদন্তীর প্রেত ম্যানিটুর মতো একজন মানুষ আছেন হুইল চেয়ারে। তিনি ভিক্ষুক। প্রাচীন রেড ইন্ডিয়ান ওই ওঝাও ছিলেন তাই। তার শরীরের নিচের অংশটি নেই।
নামাজের পর মসজিদের ভেতরে তার নামাজের জানাজা হলো। মানুষজন কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে এলেন, জায়গা ফাঁকা হয়ে গেল। সামনে এগুলেন তারা। জায়গা ভরাট করলেন। সেসব লেখা আছে পশ্চিমের দুনিয়ার ওয়ের্স্টান সিরিজগুলোতে। নামাজ পড়ালেন ইমাম।
কে চলে গেলেন?
‘পত্রিকাটি ছিল পুরোপুরি ভিন্ন ধরণের’
আস্তে, আস্তে কথা বলছেন তারা এখানে, সেখানে। লেখা আছে যেমন তার সম্পাদিত বইগুলোতে। শেখ মহিউদ্দিন বললেন, ‘তার ব্যক্তিত্ব খুব প্রখর ছিল। সময়ের বিষয়ে খুব মনোযোগী ছিলেন। নিয়ম করে চলতেন। সম্পূণ ভিন্ন ধরণের একজন মানুষ ছিলেন।’ তিনি কাজ করেছেন রহস্য পত্রিকাতে। ২০ বছরের বেশি লিখেছেন। জানালেন, ‘তার এই পত্রিকাটিও ছিল পুরো ভিন্ন ধরণের। সেখানে রহস্য গল্পগুলো অনুবাদ করিয়ে ছাপাতেন। রূপান্তরকারী সম্পাদক হিসেবে খুব বড় ও সবচেয়ে নামকরা লোক ছিলেন।’ তার লেখা বই প্রিয়-তিনটি উপন্যাসিকা, পঞ্চ রোমাঞ্চ, ছয় রোমাঞ্চ।
‘প্রতিটি কাজ খুব যত্ন করে করতেন’
মাসুম কাজ করেছেন তার সঙ্গে। আগে সময় টিভিতে কাজ করতেন। এখন বেকার। বললেন, “নানা লোকের কাছ থেকে তিনি তার ও তাদের উপন্যাসগুলোর রশদ যোগাড় করতেন। সেগুলোর বেশিরভাগই ছিল ইংরেজি। কাজী আনোয়ার হোসেন প্রতিটি কাজ খুব যত্ন করে করতেন বলে সেগুলো মানোত্তীর্ণ হয়েছে। সম্পাদক হিসেবে অসাধারণ ছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ তার স্টাইল বদলাতে চাননি বলে সেবা প্রকাশনী থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন। কাজীদা বলেছিলেন, ‘আমার ছেলেদের স্টাইলে লেখা ছাপা হবে আপনারও।’ তাতে অবশ্য হুমায়ূনের কোনো খেদ ছিল না। নিজেও বিরাট লেখক। বলেছেন, ‘কাজী আনোয়ার হোসেনের লেখাপড়া খুব ভালো ছিল। তার বাবা ছিলেন নামকরা শিক্ষাবিদ। বইয়ের প্রতি অফুরান ভালোবাসা ছিল যার। বোনরাও খুব লেখাপড়া করেছেন। এই পরিবারটি লেখালেখির মানুষ।’ কাজী সাহেবই সেটিকে ধারণ করেছেন পূর্ণভাবে।
‘আমি পদকের কাঙাল নই’
আত্মীয় কাজী রওনক হোসেন বলেছেন, “বেতার ও সিনেমাতে গান লিখেছেন সঙ্গীতপ্রেমী দুই বোনের মতো কাজী আনোয়ার হোসেন। তবে শেষ পযন্ত সাহিত্যতেই ডুবে গেলেন; তাও আবার বিদেশী! গড়লেন সেবা প্রকাশনীর ভুবন। তবে তিনি তার জীবদ্দশাতে কোনো পদক লাভ করেননি। একুশে বা স্বাধীনতা পুরস্কার কোনোটিই নয়। তিনি বলেছেন, ‘আমি পদকের কাঙাল নই’।”
‘তাকে ছোট থেকে গড়ে তুলেছেন নিজের হাতে’
এ বি এম সাদী তাদের আত্মীয়। তার শ্যালিকা আয়েশা তাহনূর টিংকুর বিয়ে হয়েছে এই পরিবারে। সাদী ব্যবসা করতেন। এখন বয়স হয়েছে। বললেন, ‘চমৎকার ছিলেন। কোনো ধরণের ঝামেলার মধ্যে থাকতেন না খালু। সেবা প্রকাশনীর পুরোনো লেখক ও তার স্টাফরা সবাই জানেনÑকেমন মানুষ ছিলেন। স্বাভাবিক মানুষ ছিলেন। যেসব কাজ ভালো তাই করতেন। তারা মানে কাজী মাহবুব হোসেন, সন্জীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন ও কাজী আনোয়ার হোসেন এবং তার স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিন খুব নরমাল ছিলেন। অন্যদের সঙ্গেও তারা খুব স্বাভাবিক ব্যবহার করতেন। দেখলে মনে হতো না, বিখ্যাত পরিবারের অত্যন্ত বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। কারো সঙ্গেই কোনো রাগারাগি তারা করেননি।’
নিজের প্রথম বইয়ের কথা বললেন ১৯৭৪ সালে পড়া ‘কুয়াশা’ সিরিজের একটি বই। এটিই কাজী আনোয়ার হোসেনের প্রথম সিরিজ। জানিয়েছেন, “খালু সবার সঙ্গে খুব আন্তরিকতা নিয়ে মিশতেন। আন্তরিকভাবে কথা বলতেন। গল্প করতেন মন দিয়ে। পরিবার ও আশপাশের এবং অন্যদের খোঁজখবর রাখতেন। প্রচুর বই পড়তেন। কাজী আনোয়ার হোসেন প্রথম পড়েছিলেন বিখ্যাত রবিন হুড’। সেটিই তাকে অনুবাদ ও এই সাহিত্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তারপর তো সুদীর্ঘ জীবন। দুই বছর ধরে মানুষটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। আমি গিয়ে বলতাম, ‘খালু কেমন আছেন?’ বলেছেন, ‘ভালো আছি।’ মানুষটি কী না শেষ ছয় মাসে ক্যান্সারে বিছানায় পড়ে ছিলেন। যখন মাসুদ রানা নিয়ে আলোচনার শুরু হলো, তিনি শারীরিকভাবে সক্ষম ছিলেন না। খালু কী করতেন? হঠাৎ তো তাকে বিষয়টি জানানো হয়েছিল। যে মানুষটিকে দিয়ে তিনি কাজ করিয়েছেন, যাকে ছোট থেকে গড়ে তুলেছেন নিজের হাতে; সেই শেখ আবদুল হাকিম বিপক্ষে যাবার পর তিনি এত ব্যথা পেয়েছেন যে এই নিয়ে একটি কথাও বলতে আগ্রহী ছিলেন না। তিনি দুঃখ পেয়েছেন। তবে এই নিয়ে তিনি ও হাকিম সাহেব কেউই বাড়াবাড়ি করেননি। তার ছেলেরা তো নিরীহ প্রকৃতির, লেখক মানুষ। তারাও এই বিষয়ে সবার মধ্যে ফাইট করতে আগ্রহী নন।”
তার জীবন কেমন ছিল, বলেছেন, ‘তিনি সকাল সাতটা থেকে আটটার মধ্যে সকালের নাস্তা করে ফেলতেন। এই বাড়ির সবারই এমন অভ্যাস তিনি গড়ে দিয়েছেন। দুপুরে সময় মতো খেতেন। একেবারে রুটিন লাইফ কাটাতেন তার উপন্যাসগুলোর চরিত্রের মতো। টেলিফোনে সবার নিয়মিত খোঁজখবর নিতেন।’
চলে যাচ্ছেন
আস্তে, আস্তে আঁধার নেমে এলো। লাল সাইরেন বাজাতে, বাজাতে ভ্যানটি চলে যাচ্ছে। পেছনে ওয়েস্টানের যেকোনো সিরিজের মতো আলোচনায় মগ্ন একদল মানুষ। কে চলে গেলেন?