আগুনের তীব্র তাপে আজও মুড়ি ভাজছেন যসোতা রানীরা
আগুনের তীব্র দাহতাপেই ৪০ বছর ধরে মুড়ি ভাজেন সনাতন ধর্মাবলম্বী আন্না রানীরা। ভোলার ইলিশা মহাসড়কের পাশেই ২ নম্বর ইলিশা ইউনিয়নের মধ্যে পড়েছে সোনাঢুগি গ্রামটি। ৪০ বছর ধরে এই গ্রামেরই বাসিন্দা যুগল তেলি, সংকর তেলি,বিউটি রানি, সিতা রানী ও আন্না রানী মুড়ি ভাজার কাজ করছেন। এক সময় গাজিপুরের বাসিন্দা ছিলেন তারা কিন্তু মেঘনার কড়াল গ্রাসে তাদের আদিবাস স্থান বিলীন হয়ে যায়। পরে তাদের মাথা গোজার ঠাঁই হয় সোনাঢুগি গাঁয়ে। সোনাঢুগি আসার আগ থেকেই মুড়ি ভাজার কাজ শুরু করেন তারা। জীবিকা নির্বাহ করেন মুড়ি ভাজা আয়ের টাকায় ।
৫০ বছর আগে যসোতা রানীর স্বামী মারা যায়। ৭০ বছর বয়সি এই বিধবা বলেন, একমাত্র ছেলে শঙ্করকে নিয়ে শুরু করি মুড়ি ভাজার কাজ। আজও জলছি আগুনের তাপে । চিতার আগুনের আগে মুড়ি ভাজার আগুন শেষ হবার নয়। কারণ মুড়ি ভাজার চুলার আগুন জ্বলা বন্ধ হলে বন্ধ হয়ে যাবে তাদের আয় রোজগারের পথ। তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক হলেও তাদের হাতে ভাজা মুড়ির কদর এখনো ভোলায় বেশ সমাদৃত। বিশেষ করে পবিত্র রমজানে ইফতারের অন্যতম খাবার মুড়ি। আর এই মুড়ির প্রকৃত ঘ্রাণ ও অতুলনীয় স্বাধ গ্রহন করতে হাতে ভাজা মুড়ির কোনো জুড়ি নেই । যদিও হাতে ভাজা মোটা চালের মুড়ি মেশিনে তৈরি মুড়ির চেয়ে দামে দ্বিগুণ তবে স্বাধেও দ্বিগুণ।
মুড়ির ব্যবসায়ী যুগল তেলি বলেন, এখন রমজান শুরু হয়েছে রমজানে আমাদের তৈরি করা মুড়ির বেশ চাহিদা থাকে। আমরা বছরের এই একমাসকে আমাদের ব্যাবসায়িক সিজন হিসেবে ধরি। কারণ বাজারে এখন সস্তা দামে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি মুড়ির বেশ সয়লাভ। তবে রমজান মাসে ওই মুড়ির চাহিদা কম থাকে আমাদের মুড়ি বেশি চলে।
তিনি আরও বলেন, এখন আর আগের মতো ভালো নেই মুড়ির ব্যবসা, চালের দাম বাড়ছে, লাকড়ির দাম বাড়ছে।
যুগল তেলি বলেন, ৪০ বছর ধরে মুড়ির ভাজার কাজ করি। আর এই কাজে আমাকে সহায়তা করছেন আমার স্ত্রী আন্না রানী।
আন্না রানী বলেন, মুড়ি বিক্রি করা আয় দিয়ে ছেলে-মেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। ছেলেকে বিয়ে দিয়েছি। ঘর করেছি। আমরা ভালোই আছি। তবে বয়স হয়েছে এখন আর আগুনের তাপদাহ সহ্য করতে পারছেন না তিনি। তাই দুই বেলা খাবার দিয়ে দেড়শ টাকা মজুরিতে একজন নারী শ্রমিককে যুক্ত করেছেন আন্না রানী ।
তবে সাড়া দিনে দুই বেলা খাইয়ে দেড়শো টাকা মজুরি পেয়ে সন্তোস প্রকাশ করেন শ্রমিক বিউটি রানী। কারণ বিউটি রানীর স্বামী কোন কাজ-কর্ম করতে পারেন না। বিউটি রানীর আয়ের উপর চলে তার সংসার।
ছোলাবুট ও মুড়ি গ্রাম বাংলায় ইফতারের প্রধান দুটি উপাদান। রোজার সময় হাটবাজারে ছোলা ভাজা পাওয়া গেলেও বাড়িতে বাড়িতে মুড়ি ভাজার রেওয়াজ এখনো রয়েছে। ইলিশার সোনাঢুগি গ্রামের যুগল তেলির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাপদাহ গরমকে উপেক্ষা করে মাটির তৈরি চুলায় চলছে মুড়ি ভাজার কাজ। এরা অবশ্য বানিজ্যিক ভাবেই মুড়ি ভাজার কাজ করছেন। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরেই মুড়ির ব্যাবসা করছেন তারা।
এই এলাকার সর্বজন পরিচিত ব্যক্তি আলহাজ্ব শিরাজ মিয়া বলেন, বাড়িতে ভাজা মুড়ির স্বাদই আলাদা। শুধু রোজায় নয় সারাবছর খাওয়ার জন্য মুড়ি ভাজা হয়। তবে এ সময় মুড়ির চাহিদা বেড়ে যায়। এখনো গ্রামের মানুষ এই মুড়ি বেশ পছন্দ করেন।
মুড়ি ব্যাবসায়ী সংকর জানান, আমি ছোট বেলা থেকেই দেখি মা মুড়ি ভাজেন। মুড়ি ভেজে অন্য মানুষের বাড়িতে বাড়িতে পাঠাতে হয়। এখনো মুড়ি ভাজার বিক্রির কাজই করি আমরা। রোজায় মুড়ি বেশি বিক্রি হয় তাই বেশি মুড়ি ভাজতে হয়। এ জন্য মুড়ি ভাজতে পারা পটু নারীদের এ সময় কদর বেড়ে যায়। তাদের মজুরি দিতাম ১৫০ টাকা এখন ২০০ টাকা দিতে হয়।
মুড়ি ভাজার কাজ জীবিকা নির্বাহ করেন স্বামীহারা নারী সিতা রানী। ৪০ বছর ধরে মুড়ি ভাজার কাজ করলেও ১৫ বছর ধরে ভাজছেন অন্যের মুড়ি। ১ কেজি চালের মুড়ি ভাজতে ৮ থেকে ১০ টাকা মজুরি নেন বলে জানান তিনি।
সিতা রানী বলেন , ‘সারা বছর মুড়ি ভাজার প্রয়োজন না পড়লেও অনেকেই রোজার সময় মুড়ি ভাজার জন্য আমাদের কাছে আসেন। লবণ, চাল,লাকড়ি সবই তাদের আমি শুধু ভাজার সরঞ্জাম দিয়ে ভাজি আর এই রোজগারের উপর চলে আমার সংসার। আমার এখানে অনেক দূর-দূরান্ত থেকে মুড়ি ভাজার জন্য মানুষ আসেন।’
তাদের দাবি, সরকারি কোনো সহায়তা পাচ্ছে না তারা। সরকারি সহায়তায় তাদের আধুনিক প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম দিয়ে মুড়ি ভাজতে সহায়তা করলে অগ্নিদাহ থেকে মুক্তি পেতেন তারা।
এসআইএইচ