কার্টুনদের কাছে ফিরলেন নারায়ণ দেবনাথ
বাংলার প্রথম পেশাদার পূর্ণাঙ্গ কাটুন স্রষ্টা, সবচেয়ে নামকরা এই ভুবনে বলতে গেলে নারায়ণ দেবনাথ’র নামটি চলে আসে শ্রদ্ধায়। অনেকগুলো তুমুল খ্যাতিমান সিরিজের তিনি জনক। কোনটির না না বলি? হাঁদা-ভোঁদা, বাঁটুল দি গ্রেট, নন্টে-ফন্টে জনক তিনি। চলে গেলেন ওপারে। তাকে মনে রাখবে বহুকাল বাঙালি শিশুরা ও শিশুতোষ মনের বুড়োরা। রুচি বদলেছেন বলে, আধুনিকতায় যাত্রা শুরু করিয়ে দিয়েছিলেন নব একটি মাধ্যমে। ভারত সরকার তাকে উপহার দিয়েছে ‘পদ্মশ্রী’।
নারায়ণ দেবনাথের জন্ম হয়েছিল ১৯২৫ সালের ২৫ নভেম্বর। ১৮ জানুয়ারি, গতকাল চলে গেলেন। তবে এই বিরাট জীবনে বিপুলভাবে আনন্দ দিয়েছেন বাঙালি শিশুদের। তাকে বড় হয়ে যাওয়া শিশুরাও মনে রাখবে। কেননা, প্রথম কাহিনী ‘হাঁদা ভোঁদার কাণ্ডকারখানা’ শুরু করেছিলেন ১৯৬২ সালে। আজ থেকে ৬০ বছর আগে, নিজের ৩৭ বছর বয়সে। নিজেকে কেবল এই একটি কার্টুন সিরিজে আটকে রাখেননি অমিত প্রতিভাধর ভারতীয় বাঙালি এই কমিক আর্টিস্ট, শিশুদের জন্য হয়েছেন লেখক ও ইলাসট্রেটর। আরো তৈরি করেছেন ‘বাঁটুল দি গ্রেট’। প্রথমটির তিনটি বছর পর এর শুরু। তার সবচেয়ে বিখ্যাত সিরিজ হলো বোধহয় কলকাতার বাংলা ভাষার বিখ্যাত কমিক প্রকাশনী ডায়মন্ড ওয়াল্ডসের সৌজন্যে বেরুনো আরেকটি সিরিজ ‘নন্টে-ফন্টে’। আরও তিনটি বছর সিরিজটির শুরু। গিনেজ বুকে রেকর্ড গড়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বছর-টানা ৫৩ বছর হাঁদা, ভোঁদা সিরিজটি চালু রাখার জন্য।
তিনিই পুরো ভারতের এবং বাংলা ভাষার একমাত্র কমিক চরিত্র লেখক যিনি ‘ডি-লিট’ উপাধি লাভ করেছেন। ভারত সরকার তার বিখ্যাত মানুষটিকে ‘পদ্মশ্রী’তে সম্মানিত করেছে। এটি ভারতের চতুথ সবচেয়ে বড় বেসামরিক পদক। ৯৬-এ পা রেখে গতবছর তিনি সম্মাননাটি লাভ করেছেন। আরো কাজ আছে কিন্তু নারায়ণ দেবনাথের। সেটির একটি হলো ‘রবি-ছবি’। ১৯৬১ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শতবর্ষ পালনের উপলক্ষে তিনি নিজেকে এভাবে নিবেদন করেছেন সে বছরের মে মাসে। এটি বেরিয়েছিল ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত বাংলা ভাষার প্রকাশনী আনন্দমেলার ওই বিশেষ সংখ্যায়। পুরো ৫০ পৃষ্ঠার সম্পূর্ণ কমিক সিরিজটি বানারসের সর্বোদয় সাহিত্য প্রকাশন থেকে প্রকাশিত। মহান বাঙালি সমাজ সংস্কারক স্বামী বিবেকান্দের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ১৯৬২ সালে তার জন্মবার্ষিকীটির আগের বছর তিনি কমিক সিরিজ লিখেছেন ‘রাজার রাজা’। এটির চিত্রনাট্য বাঙালি সাহিত্যিক বিমল ঘোষের।
এমন মানুষের জন্ম হয়েছিল উত্তাল এক সময়ে। তখন ব্রিটিশদের আমল। পুরোনো আর প্রাচীনে পড়ে আছে বাঙালি সমাজ। সেখানেই একটি নতুন ছেলের জন্ম হলো পশ্চিম বাংলার হাওড়া জেলার শিবপুর উপজেলাতে। তবে তাদের বাড়ি কিন্তু এই বাংলাদেশে। বিক্রমপুরে আদিবাড়ি। তার জন্মের আগে তারা চলে গিয়েছেন ওপারে। বিখ্যাত এই কমিক শিল্পী তার নারায়ণ দেবনাথ কমিক সমগ্রতে স্বীকার বলেছেন, একেবারে ছোট থেকে তিনি লোকশিল্পের নানা ভুবনের প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়েন। তখন তো আর টিভি ছিল না। অন্যকিছু তো দূরের কথা। ফলে রেডিও নয়, তার ভালোবাসা ছিল গ্রামের কীর্তন, লোকগান, লোককবি, ছড়া আর প্রবাদের ওপর। নানা গ্রামের খেলাতেও মুগ্ধ ছিলেন এই সৃজনশীল মানুষটি। সেখানে তিনি আরো বলেছেন, তাদের স্বর্ণের দোকান ছিল। পেশায় তারা স্বর্ণকার বা বণিক ছিলেন। নানা ধরণের স্বর্ণগয়নার তিনি ডিজাইন করার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিলেন তখন। এই বিদ্যেও জীবনে নারায়ণের খুব কাজে লেগেছে। লেখাপড়া করতে গিয়ে তার ছবি আঁকার দিকে মন চলে গেল। গ্রামের অবারিত প্রকৃতি আর নির্মল জীবন তাকে গড়ে দিয়েছিল অনেকটা। তাতে অবশ্য পরিবার মোটেও অবাক হয়নি। তারাও তো তাকে গড়েছেন। ফলে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাল, ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে (কলকাতা আর্ট কলেজ নামেও পরিচিত) পড়তে চলে গেলেন তিনি।
তাদের ফাইন আর্টস পড়ানো হতো। টানা পাঁচটি বছর সেথায় পড়তে গিয়েছিলেন নারায়ণ। তবে তিনি পড়ালেখা চালিয়ে যাননি। শেষ বছরে পড়া ছেড়ে দিলেন খেয়ালী ও প্রতিভাবান এই শিল্পী ছাত্র। এর পরের কটি বছর কলকাতার টালিউডের সিনেমা শিল্পে অবদান রাখেন তিনি। কাজ করতেন পয়সার বিনিময়ে বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোতে সিনেমার স্লাইড ও লোগো বানানোয়। নারায়ণ তার নারায়ণ দেবনাথ কমিক সমগ্র-২তে বলেছেন, যেদিন তার বিয়ে হয়েছে, সেদিনই ‘বাপুজী’ মহাত্মা গান্ধী আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন। ফলে বিয়ের উৎসব তার মাটি হয়ে গিয়েছে শোকে ভেসে। তাতে বিয়ের অতিথিদের খুব অসুবিধা হয়েছিল মনে আছে বরের। তার ওই চারখন্ডের সমগ্রে সিরিজগুলোর লেখক ও শিল্পীর জীবনের খুব ভালো, ভালো তথ্য আছে।
ফ্রিল্যান্স এই শিল্পী ১৯৫০ সালে চলে যেতে পারলেন দেব সাহিত্য কুটিরের কাছে। সে আমলেই অন্যতম সেরা শিশুতোষ ভুবনের অধিকারী ছিলেন তারা। নামজাদা এই প্রকাশনী সংস্থাতে তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন একজন বন্ধু। প্রতুলচন্দ্র ব্যানার্জি, শৈল চক্রবতী, বলাইবন্ধু রায়, পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তীর মতো মানুষরা তখন প্রকাশনীটিতে কাজ করতেন নানাভাবে। টানা ১০টি বছর তাদের সান্নিধ্যে থাকার দুর্লভ সৌভাগ্য হলো নারায়ণের ওখানে। ১৯৬১ সাল পযন্ত অনেকগুলো শিশুদের বইয়ের প্রচ্ছদের শিল্পী ও ইলাসট্রেটরের কাজ করেছেন। সেগুলোর মধ্যে আছে অভিযানের কাহিনীগুলো, পশ্চিমের শিশুদের উপযোগী সাহিত্যের অনুবাদ। কমিক সিরিজে চলে এলেন এই অবিস্মরণীয় শিল্পী ১৯৬২ সালে শুকতারার হাঁদা-ভোঁদার মাধ্যমে। একজন ফ্রিল্যান্স কমিক আর্টিষ্ট হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করলেও সেখানে ফল পেতে তার দেরি হলো না। নিজের ভুবন খুঁজে পেলেন তিনি। যখন খেয়ে না খেয়ে কাজ করতে হতো, তখন প্রকাশক তাকে বলেছিলেন সহজে ও ভালোভাবে ব্যবসা করতে উন্নতমানের বিদেশী কমিকগুলোকে বাংলাতে অনুবাদ কর। এভাবেও তার প্রতিভাকে চিনতে পেরেছিলেন তারা। বাংলা ভাষা পেয়েছিল নিজের প্রথম কমিক স্রষ্টাকে। যার সমতুল্য আজও নেই।
বাংলার এই বিরল প্রতিভাকে দেব সাহিত্য কুটিরের সম্পাদকরা বাংলায় কমিক লিখতে বলেছিলেন। তারাই ‘হাঁদা-ভোঁদার কাণ্ডকারখানা’ নামটি সিরিজের দিয়ে তাকে শুরু করিয়ে দিয়েছিলেন এই পথে। আস্তে, আস্তে ভালোবাসা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকলো। তাতে বিদেশী কমিগুলো তার হাতের তালুতে চলে এলো। এর আগে যুগান্তর পত্রিকাতে কমিক লিখতেন প্রতুলচন্দ্র লাহিড়ী। সেটির নাম হলো বিখ্যাত ‘শিয়াল পন্ডিত’ সিরিজ। এটিই প্রথম দিকের কমিক সিরিজগুলোর অন্যতম। তবে তারটি শুরু থেকেই সাফল্য পেতে থাকে। তাতে প্রতি মাসেই শুকতারা সিরিজটি বের করেছে। শুরুতে পেন্সিলে আঁকতেন তিনি। কালি ব্যবহার করতেন সেখানে ঝর্ণা কলমের। কোনো রঙিন ফ্রেম দিতে পারেননি। এরপর সিরিজটিকে গ্রে-স্কেলে প্রকাশ করতে পেরেছেন নারায়ণ দেবনাথ।
তার প্রথম রঙিন কমিক সিরিজ হলো চরিত্র নির্ভর ‘বাটুল দি গ্রেট’। এটি বই আকারেও ওভাবে শুরু হয়েছে। এই সুপার হিরোর আইডিয়াটি তিনি পেয়েছিলেন বিখ্যাত কলেজ স্ট্রিট থেকে ফেরার সময়। সুপার হিরোর নামটি ও একটি কাহিনী মাথায় আসার পর তখনই তিনি নামটি পেয়ে গিয়েছিলেন। লাল ও কালো কালিতে আঁকা এবং লেখা সিরিজটিরও শুরু হলো শুকতারা নামের সেই শিশুদের বিখ্যাত প্রতি মাসের সাময়িকীর বৈশাখ সংখ্যাতে। সেটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৬৫ সালের মে-জুন সংখ্যায়; বিশেষ সংখ্যা ছিল ওটি-বাঙালি বৈশাখ। প্রকাশ করতো দেব সাহিত্য কুটিরই। তার রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষের বিশেষ নিবেদনের কাজটি রবীন্দ্রনাথের শিশু বয়স নিয়ে করা। আর ‘রাজার রাজা’ বা ‘ছবিতে বিবেকানন্দ’ স্বামীজির জীবন ও কর্মের ওপর করা। ১৯৬২ সালে আরেকটি কাজ করেছেন তিনি-‘চিত্রে দুর্গেশনন্দিনী’। সেটি চমকে দেবার তথ্য দেয়, বিখ্যাত বাঙালি লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আরো বিখ্যাত দুর্গেশনন্দিনীর চিত্রময় উপন্যাসরূপ হলো এটি। ফলে এই কাজে তিনি অন্যতম পুরোধা বলা চলে এক মুহূর্তে।
হাঁদা-ভোঁদা, নন্টে-ফন্টে ও শুটকি আর মুটকি (১৯৬৪ সালে শুরু) বাংলার কমিকের ধারাতে রীতিমত বিপ্লব করে। এর বাদে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ যখন তুমুল অবস্থায় চলে গেল, উদ্দীপ্ত নারায়ণ দেবনাথ বিভিন্ন সংবাদপত্র, সাময়িকী ও প্রকাশকদের অনুরোধ করলেন তাতে আভা ও বাঙালিদের নানাভাবে সাহায্য করতে। নিজেও তার সুপার হিরো বাটুলকে নিয়ে এলেন ট্যাংক, যুদ্ধবিমান ও মিসাইল নিয়ে। সে এমনকী বুলেটকেও ঠেকিয়ে দিচ্ছে তখন। এভাবেই পূর্বপুরুষের ঋণশোধ করলেন নারায়ণ দেবনাথ নামের এপার বাংলার ছেলেটি। তখনও শুকতারাতে বেরুতো বাটুল।
তার নিজের নামে করা আরেকটি কাটুন সিরিজ ‘নন্টে-ফন্টে’ও তুমুল বিখ্যাত। সেটি প্রকাশ হয়েছে কিশোর ভারতীতে নিয়মিত। এবার বলি, শুকতারার জন্য ১৯৫০ সালে যে ফ্রিল্যান্স আর্টিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন নারায়ণ দেবনাথ, সেই কার্টুন নিমাতার জীবন পুরো বাংলার সবচেয়ে বেশি ইলাসট্রেশনের আঁকিয়ে হিসেবে রেকর্ডের মালিক করেছিল তাকে। নিজের সময়ের সবচেয়ে খ্যাতিমান ইলাসট্রেটর আর্টিস্টও ছিলেন তিনি। এমনকী তিনি টারজান সিরিজটি অনুবাদ করেছেন টানা ৪২ বছর। বিদেশী সাহিত্যের বাংলায় অনুবাদ করেছেন লেখক হিসেবে।
এই মহান ও অতি বিখ্যাত কার্টুন চরিত্র নির্মাতা অসুখে ভুগে ২০২১ সালের ২৪ ডিসেম্বর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। হৃদরোগের অসুখে ভুগে নারায়ণ দেবনাথ তার কার্টুনদের কাছে ফিরে গেলেন ১৮ জানুয়ারি ২০২২ সালে, কলকাতা শহরে। চরিত্রগুলোর মতো তারও বয়স হয়েছিল অনেক-৯৬ বছর। বেশি তবে খুব বেশি নয়! তার কার্টুন সিরিজগুলোও কালকে জয় করেছে, তার মতোই। তিনিও হয়েছেন বহুকালের স্বাক্ষী।
(উইকিপিডিয়া থেকে অনুবাদ, ১৮-১-২০২২)