পিঠা দিয়ে গ্রামে শীত বরণ
শীতকাল মানে পিঠার সময়। ভোরের কুয়াশা ভেদ করে সকালের সূর্যের দেখা মিলতেই নতুন পিঠার ঘ্রাণে সুবাসিত হয়ে যায় চারদিক। বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে চলে পিঠা উৎসব। সকালের শীত উপেক্ষা করে গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে চুলোর কাছে বসে পিঠা খাওয়ার মজায় আলাদা।
শীতকাল এসেছে আর আপনি কোনো পিঠাই খাননি, তাহলে আপনার শীতের সময়টাই বৃথা। আর গ্রামাঞ্চলে শীত উদযাপন মানে তো পিঠা উৎসব, রস উৎসব এসবই।
পিঠা বাংলার চিরায়ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি অংশ। শীতকালের শুরুতেই মাঠের পাকা ধান বাড়িতে এনে সে ধান রোদে শুকিয়ে নতুন আতপ চালের গুঁড়ো থেকে পিঠা বানানো বাঙালির শত বছরের সংস্কৃতি। শীতকালের শুরুতে আমাদের দেশের কৃষকেরা তাদের ঘরে নতুন ধান তোলে থাকে। আর এ খুশিতেই তারা পিঠা উৎসবের মধ্যে দিয়ে শীত বরণ করে নেয়।
শীতকালে সাধারণত ভাপা, দুধ চিতই, রসে ভেজানো পিঠা, দুধপুলি, ক্ষিরকুলি, নকশি পিঠা, পাটিসাপটা, পাকান পিঠা, সেমাই পিঠা, ম্যারা বা মুঠো পিঠা খাওয়া হয়। তৈরি পদ্ধতি সহজ ও কম উপাদান লাগে বলে এসময় সবচেয়ে বেশি তৈরি হয় ম্যারা পিঠা ও ভাপা পিঠা।
ম্যারা পিঠা
ময়দা বা চালের গুঁড়ো, লবণ, চিনি বা গুড় ও নারকেল দিয়ে বানানো এ পিঠা বেশ জনপ্রিয়। এ পিঠা সিলেট ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ এবং পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে বেশ জনপ্রিয়। এ ছাড়া উত্তরবঙ্গের কিছু এলাকায়ও বেশ জনপ্রিয়। ম্যারা পিঠা সাধারণত শুঁটকি ভর্তা, গুড় বা মাংস দিয়ে পরিবেশন করা হয়। অনেক সময় কড়াইয়ে তেল বা তেলছাড়া ভেজে কিংবা আগুনে পুড়িয়ে খাওয়া হয়। তবে, গুড় দিয়ে বানানো মিষ্টি ম্যারা পিঠা পরিবেশন করতে তেমন কিছু যুক্ত করতে হয় না।
ভাপা পিঠা
ভাপা পিঠা বাংলাদেশ ও ভারতের একটি ঐতিহ্যবাহী পিঠা। এটি প্রধানত চালের গুঁড়া দিয়ে জলীয় বাষ্পের ভাপে তৈরি করা হয়। মিষ্টি করার জন্য দেওয়া হয় গুড়। স্বাদ বৃদ্ধির জন্য নারকেলের শাঁস দেওয়া হয়। ঐতিহ্যগতভাবে এটি গ্রামীণ নাশতা হিসেবে প্রচলিত। তা ছাড়া চালের গুঁড়ার সঙ্গে সদ্য জমি থেকে তোলা সতেজ ধনিয়া পাতা যুক্ত করেও এ পিঠা তৈরি করা হয়। যেটি কচি লাউয়ের তরকারির সঙ্গে খাওয়া যায়। এ খাবারটি অনেকেই পছন্দ করে খেয়ে থাকেন।
শীতকাল আসলে পিঠা না খেলে যেন চলেই না। তাই অনেকেই শহর ছেড়ে ছুটে চলে নিজের মাতৃ নীড়ে। ঈদের মতো নাড়ির টানে শীতকালেও অনেকেই বাড়ি ফিরেন পরিবারের সঙ্গে শীতের পিঠা উৎসবে সামিল হতে। তা ছাড়া পৌষে (ডিসেম্বর-জানুয়ারি) যখন পিঠা উৎসব চলে, এসময় শিশুদের স্কুল-কলেজও ছুটি থাকে। ফলে অনেকে সন্তান নিয়ে আনন্দে মেতে উঠতে বাড়ি ছুটেন। পরিবার সবাই একসঙ্গে হয়ে গ্রামীণ পরিবেশে পিঠা খাওয়ায় মেতে ওঠা জীবনকে আরও অর্থবহ করে তোলে।
নতুন চাল, খেজুরের রসের নতুন গুড়ে টইটম্বুর পিঠা বাঙালির শীত উদযাপনকে করে তোলে রঙিন। শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠে মায়ের চুলার কাছে গিয়ে আগুন পোহানোর স্মৃতি আবহমান বাংলার গ্রামীণ ঐতিহ্য। ভোরের কুয়াশা বেধ করে সকালের সূর্যের দেখা মিলতেই নতুন পিঠার ঘ্রাণে সুবাসিত হয়ে যায় চারদিক। বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে চলে পিঠা উৎসব। সকালের শীতকে উপেক্ষা করে গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে চুলোর কাছে বসে পিঠা খাওয়ার মজায় আলাদা। এসময় প্রকৃতি যেনো এক নতুন রূপে ফিরে।
পৌষসংক্রান্তি, নবান্ন সহ শীতকাল ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক উৎসব ও রীতি-নীতি পালনের ক্ষেত্রেও পিঠার ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন-ধর্মীয় উৎসব, বিয়ে, গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান, নাইওর বা ফিরানি, অষ্টমঙ্গলা, মুখে ভাত, সুন্নত-এ খাতনা, সাতোশা, নববর্ষ, সাকরাইন, অতিথি আগমন ইত্যাদি।
আজকাল শহরের অভিজাত রেস্তোরাঁতেও গ্রামবাংলার পিঠাপুলি জায়গা করে নিয়েছে। তা ছাড়া শহরের প্রতিটি গলিতে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে এখন পিঠা বিক্রি হয়। এসময় অনেক ভাসমান পিঠার দোকান তৈরি হয়। প্রায় সব দোকানেই ভাপা ও খোলা পিঠাই বেশি বিক্রি হয়। বানাতে সহজ হওয়ায় এটিকেই বেছে নিয়েছে বিক্রেতারা। পাশাপাশি শহরের পিঠাপ্রেমী নাগরিকরাও তা সাদরে গ্রহণ করেছে। সন্ধ্যা নেমে এলে শহরের প্রতিটি পিঠার দোকানেই বাড়তে থাকে। এভাবেই পিঠার স্বাধে নিয়ন আলোর শহরের শীতকে বরণ করে নেই পিঠাপ্রেমীরা।
এসএন