খাঁচায় হচ্ছে খাঁটি মধু, কৃষকের মুখে হাসি
হিমেল হাওয়া ও ঘন কুয়াশায় শীতের তীব্রতাকে বাড়িয়ে তুলছে উত্তরের জনপদ জয়পুরহাট। মাঝে মাঝে দুপুরের দিকে মাথার উপর উঁকি দিচ্ছে সূর্য। সেই সূর্যের আলোতে এ জেলার মাঠে মাঠে যেন সরিষার হলুদ ফুলের অপরূপ দৃশ্য ফুটে উঠেছে। পুরো মাঠ যেন ঢেকে আছে সুন্দর এক হলুদের চাদরে। এমন চাদরে ঘেরা প্রকৃতিতে ফুলের গন্ধ আর মৌমাছির গুঞ্জন জয়পুরহাটের মাঠে মাঠে। রাস্তার দুধারে বিস্তীর্ণ হলুদ চাদরের মাঠে মধ্যে মন চাইবে নিজের ছবি টুকু স্মৃতি সংরক্ষণ করতে। আর সরিষা ক্ষেতে মৌমাছির ভনভন গুঞ্জনের শব্দ মুগ্ধ করে শিশু থেকে বৃদ্ধ মানুষকে।
জয়পুরহটে বিভিন্ন উপজেলায় মধু চাষীরাও ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন সরিষার ক্ষেত থেকে মধু সংগ্রহে। ফসলির জমির পাশে পোষা মৌমাছির শত শত বাক্স নিয়ে হাজির হয়েছেন মৌয়ালরা। ওই সব বাক্স থেকে হাজার হাজার মৌমাছি উড়ে গিয়ে মধু সংগ্রহে ঘুরে বেড়াচ্ছে সরিষা ফুলের মাঠে। এ জেলার সদর উপজেলার পুরানাপৈল এলাকার হাতিগাড়া, পাঁচবিবি, কালাই, আক্কেলপুর ও ক্ষেতলালসহ জেলার বিভিন্ন এলাকার ফসলের মাঠ ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
জয়পুরহাট সদর উপজেলার হাতিগাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, গাইবান্ধা জেলা থেকে আগত আপেল ইসলাম নামে এক মৌয়ালী তার পছন্দের সরিষা ক্ষেতের পাশে খোলা জায়গায় চাক ভরা বাক্স ফেলে রাখেন। একেকটি বাক্সে মোম দিয়ে তৈরি ছয় থেকে সাতটি মৌচাকের ফ্রেম রাখা হয়। আর তার ভেতর রাখা হয় একটি রাণী মৌমাছি। রাণী মৌমাছির কারণে ওই বাক্সে মৌমাছিরা আসতে থাকে। মৌমাছিরা ফুল থেকে মধু এনে বাক্সের ভেতরের চাকে জমা করে। আর এই চাক থেকেই মধু সংগ্রহ করেন মৌমাছি চাষীরা।
প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত মৌ-চাষিরা এসব মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করেন। মৌ চাষের মাধ্যমে চাষীরা একদিকে যেমন আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন, অন্যদিকে দূর হচ্ছে বেকারত্ব। এসব সরিষা ফুলের মধু খাঁটি ও সুস্বাদু হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানসহ বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।
মধু সংগ্রাহক আপেল ইসলাম বলেন, আমরা মধু সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছি। মধু সংগ্রহের জন্য স্টিল ও কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয় বাক্স। যার উপরের অংশটা কালো রঙের পলিথিন ও চট দিয়ে মোড়ানো থাকে। বাক্সের ভেতরে কাঠের তৈরি সাতটি ফ্রেমের সঙ্গে মোম দিয়ে বানানো বিশেষ কায়দায় লাগানো থাকে এক ধরনের সিট।
পরবর্তীতে বাক্সগুলো সরিষা ক্ষেতের পাশে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়। পাশাপাশি বাক্সগুলোর ভেতরে দেওয়া হয় রাণী মৌমাছি। যাকে ঘিরে আনাগোনা করে হাজারো পুরুষ মৌমাছি। রানির আকর্ষণে সরিষা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে মৌমাছিরা। একটি রাণী মৌমাছির বিপরীতে প্রায় তিন থেকে চার হাজারের মতো পুরুষ মৌমাছি থাকে একেকটি বাক্সে।
মুশফিক ইসলাম বলেন, আমরা সরিষা ক্ষেত থেকে বছরে চার মাস মধু সংগ্রহ করে থাকি। অন্য আট মাস কৃত্রিম পদ্ধতিতে চিনি খাইয়ে মৌমাছিদের পুষে রাখি। ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সরিষা থেকে মধু সংগ্রহের উপযুক্ত সময়। আকার ভেদে একটি বাক্সে ২০ থেকে ৪০ কেজি পর্যন্ত মধু পাওয়া যায়। এখানে মৌ চাষের বিশেষ বাক্স কলনি রয়েছে ১০০টি। প্রতিটি কলনিতে খরচ হয় আট থেকে ১০ হাজার টাকা। যা এক দিকে সরিষা বিক্রি করি আর অন্য দিকে মধু সংগ্রহ করে অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হচ্ছি।
মধু কিনতে আসা হাচান আলী বলেন, মধু স্বাস্থ্যের জন্য উপকার তাই জয়পুরহাট শহর থেকে মধু কিনতে এসেছি। প্রতি কেজি মধু ৩০০ টাকা কিনেছি। এখানে খাঁটি মধু পাই তাই প্রতি বছর এখান থেকে মধু কিনে নিয়ে যাই।
জেলা কৃষি উপপরিচালক মোছাঃ রাহেলা পরভীন জানান, চলতি মৌসুমে জেলায় সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪ হাজার হেক্টর। তবে কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় বিনা মূল্যে কৃষকদের বীজ ও রাসায়নিক সার বিতরণ, রাজস্ব প্রদর্শনী ও ফলোআপ কার্যক্রমসহ অন্যান্য প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের সহায়তা ও উদ্বুদ্ধকরণের ফলে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ১৪ হাজার ৬৬০ হেক্টর সরিষা আবাদ হয়েছে। যার মধ্যে জয়পুরহাট সদরে ৪৭৬০ হেক্টর, আক্কেলপুরে ২১২০ হেক্টর, কালাইয়ে ৫৫৫ হেক্টর, ক্ষেতলালে ১২০৫ হেক্টর ও পাঁচবিবিতে ৫৯৫৫ হেক্টর সরিষা আবাদ হয়েছে।
তিনি জানান, সরিষা ফুল থেকে সংগ্রহ করা মধু গুণে ও মানে অত্যন্ত ভালো। সরিষা ফুলের মধুতে কোনো প্রকার ভেজাল থাকে না। একেবারে খাঁটি। আর এভাবে অনেকটা সহজ প্রক্রিয়ায় মধু আহরণের মাধ্যমে বাড়তি আয় করতে পারেন সংশ্লিষ্টরা। সরিষা ক্ষেতে মৌমাছির বিচরণ থাকায় ফুলের পরাগায়নে সহায়তা হয়, ফলে সরিষার ফলনও হয় বেশি।
জয়পুরহাট বিসিক কার্যালয়ের উপব্যবস্থাপক লিটন চন্দ্র ঘোষ জানান, চলতি মৌসুমে এ জেলায় ৩০ মেট্রিকটন মধু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে ১০০ জন কৃষকে পরামর্শ ও উৎসাহিত করছি। যাতে সরিষা ক্ষেতে মৌ বাক্স স্থাপনের মাধ্যমে মৌচাষ করে তারা আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন। কৃষকরা আগ্রহ প্রকাশ করলে তাদের জন্য প্রয়োজনে আবারও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।
এএজেড